পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, জালিয়াতি, ধাপ্পাবাজি, ধোঁকাবাজি, ফেরেববাজি, ভাঁওতাবাজির যে কত ঘৃণ্য, কদর্য, পঙ্কিল ও বিচিত্র রূপ হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে তার কিছুটা নমুনা উদঘাটিত হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত কয়েকটি সফল অভিযানে। অপরাধ জাগতের এসব বিভৎস কান্ড-অকান্ডের কর্তাদের ছবি ও দুষ্কর্মের বিবরণ প্রতিদিন প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়, পত্র-পত্রিকায়। সর্বত্র আলোচনা চলছে মুখে মুখে।
এর মধ্যে সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের ঘটনা একেবারে তাজা। করোনাভাইরাসের মহাতঙ্কে দেশ তথা সারাবিশ্ব যখন দিশেহারা তখন তাই নিয়ে চালিয়েছেন তিনি জমজমাট জালিয়াতি ব্যবসা। কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। রোগীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন, পরীক্ষা না করেই দিয়েছেন ভুয়া রিপোর্ট। আবার বিনে পয়সায় চিকিৎসা করিয়েছেন দাবি করে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারের কাছে পেশ করেছেন এক কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ টাকার বিল। ২০০৯ সালে এক জালিয়াতি মামলার আসামী ছিলেন যিনি, সেই তিনি ক্রমে পরিণত হন বিশাল ব্যক্তিত্বে। সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে এমপি-মন্ত্রীদের সাথে মেলামেশা ছিল তার। তাদের সাথে কায়দা করে ছবি তুলে, সেই ছবি প্রদর্শন করে ব্ল্যাকমেইল করা ছিল তার অভিনব কৌশল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অসংখ্য, উচ্চ বেতনে কর্মচারী রেখেছেন কিন্তু বেতন দেননি। জালটাকার কারবার ছিল তার। পাওনা পরিশোধ করতেন জালটাকা দিয়ে। দিতেন ভুয়া চেকও, ব্যাংকে সেই চেক ডিজ-অনার হলে এবং পাওনাদার টাকা চাইতে এলে হুমকি ধমকি দিতেন, ভয় দেখাতেন। ঠিকাদারী ব্যবসা ছিল তার। সরবরাহ করতেন নির্মাণের জন্য পাথর। পাথরের মালিকের কাছ থেকে বাকীতে যে দাম দিয়ে কিনতেন, কাজ বাগানোর জন্য কেনা দামের চেয়ে কম দামে দরপত্র দাখিল করতেন। মালিক দাম নিতে এলে হয় ভুয়া চেক, নয় জালটাকা দিতেন। প্রতারিত মালিক অভিযোগ নিয়ে আসলে পুরনো কৌশলের আশ্রয় নিতেন। তিনি গঠন করেন রিজেন্ট গ্রুপ নামের প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের নামে উত্তরায় প্রতিষ্ঠা করেন হাসপাতাল। মিরপুরেও প্রতিষ্ঠা করেন এর শাখা। প্রতিষ্ঠা করেন কলেজ। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ নামক প্রতিষ্ঠান কায়েমেরও পদক্ষেপ নেন। মালামাল ক্রয় করে টাকা দেননি। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করে কাজ বাগিয়ে নিতেন। কুরিয়ার সার্ভিস চালু করে কৌশলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতেন। ব্যাংক একাউন্ট ছিল অনেকগুলো। কিন্তু স্বাক্ষর ছিল ভিন্ন ভিন্ন। চলতেন নামি দামী গাড়িতে দাপটের সঙ্গে, পাহারায় থাকত সশস্ত্র বডিগার্ড। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাথে ম্যানেজ করে টকশোতে অংশগ্রহণ করে সেজে ছিলেন বুদ্ধিজীবী। অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। কখনো কখনো সাবেক আর্মি অফিসারের পরিচয় দিয়ে প্রতারিত করতেন। মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে পরিশোধ না করায় ব্যাংক তার বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের করেছে। তার দুর্নীতি, জালিয়াতির সংখ্যা অনেক। অবশেষে ফেঁসে গেলেন করোনাভাইরাসের রিপোর্ট জালিয়াতির ফাঁদে। ৬ হাজার ভুয়া করোনা পরীক্ষার সনদ প্রদানের প্রমাণ মিলেছে এ পর্যন্ত। গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতাল এবং তার মূল কার্যালয় সিলগালা করে দেয় র্যাব। সিলগালা করে দেয়া হয়েছে তার মিরপুর শাখাও। সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে জারী করা হয় গ্রেফতারী পরোয়ানা। ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয় ঘটনাস্থল থেকে। পলায়ন করেন সাহেদ। যেই করোনাভাইরাসের জাল রিপোর্ট তৈরির ব্যবসা করতেন তিনি, সেই রোগেই আক্রান্ত হন তার পিতা সিরাজুল করিম এবং মারা যান ৯ জুলাই। কী দুর্ভাগ্য! পিতার মৃত্যু শয্যার পাশে থাকতে পারলেন না অভিশপ্ত পুত্র। অংশগ্রহণ করতে পারলেন না তার দাফন-কাফনে। গ্রেফতার এড়াতে নানা ছদ্মবেশে টানা ৯ দিন পালিয়ে পালিয়ে ভারতে প্রবেশের উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরা সীমান্তের দেবহাটা থানায় ইছামতী নদীতে এক নৌকায় আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায় ১৫ জুলাই শেষ রাতে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। তারপর হেলিকপ্টারে করে আনা হয় ঢাকায়। হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে হাজির করা হয় আদালতে। র্যাব ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। এখন তিনি ডিবির হেফাজতে আছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে ৬০টিরও অধিক। প্রতারিতরা, ভুক্তভোগীরা আরও কত যে মামলা দায়ের করবে কে জানে! জীবন নিয়ে মরণ বাণিজ্য যেভাবে সে চালিয়ে এসেছে দুনিয়াতে তার পরিণতি দেখার অপেক্ষায় এখন সকলে। আর পরকালের শাস্তি তো রয়েছেই।
এবার আরও দু-একজন মহাপ্রতারকের কথা উল্লেখ করতঃ আত্মম্ভরিতা, দাম্ভিকতা ও প্রতারণা-প্রবঞ্চনার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) কী বলেন, তার সামান্য আলোচনা করে এ নিবন্ধের ইতি টানব।
জেকেজির চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি না নিয়ে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হতে পারেন না। অথচ জেকেজির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি। আর তার স্বামী আরিফ চৌধুরী ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাদের মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করত। তারা পরীক্ষা করে প্রতি রিপোর্টের ফী নিতেন ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নিতেন ৮০ থেকে ১০০ ডলার করে। প্রথমে কয়েকদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও পরে পরীক্ষা ছাড়াই দিতেন ভুয়া রিপোর্ট। এভাবে তাদের বিরুদ্ধে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে। সীমা ছিল না তাদের দাপটের ও গর্ব-অহংকারের। মন্ত্রীদের নাম ব্যবহার করে হুমকি-ধমকি দিতেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাসচিবকেও দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরী। তিনি কেবল একদিনে ৭৮১টি নমুনা পাঠিয়ে ছিলেন। অবশেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডা. সাবরিনাকে বরখাস্ত করেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে জালিয়াতির অভিযোগে। তারা এখন জেল হাজতে।
গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংবাদ ছিল শামীমা নূর পাপিয়া কেলেঙ্কারি। সে ছিল নরসিংদী শহরের যুব মহিলা লীগের নেত্রী (বহিষ্কৃত)। সে আর তার স্বামী মিলে গড়ে তুলে ঘৃণ্য এক পাপের সাম্রাজ্য। সুন্দরী নারীদের দ্বারা দেহ ব্যবসা (জেনা-ব্যভিচার) পরিচালনা মূল বাণিজ্য হলেও হেন দুষ্কর্ম নেই যা তারা করেনি। যেমন: জালটাকা, অস্ত্র ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, অবৈধ গ্যাস সংযোগ, জমি দখল করাসহ বিভিন্ন কাজের দালালী। তাদের নেটওয়ার্ক ছিল দেশের সীমা ছাড়িয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজধানীর ফাইভ স্টার হোটেলে ছিল তাদের ভাড়া করা স্যুইট। সেখানে সুন্দরী ললনাদের দ্বারা চালাত দেহ ব্যবসা। মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের এনে লাগাত অশ্লীল কাজে। ভিডিও করা হতো সেই পাপাচারের। অবাধ্য হলে তা ভাইরাল করে দেয়ার হুমকি দিয়ে বাধ্য করা হতো। আবার সেসব ক্লিপ ধনাঢ্য ও ক্ষমতাবান লোকদের নিকট গোপনে পাঠিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলত। তাদেরও ব্ল্যাকমেইল করত। লোক লজ্জার ভয়ে তারা অর্থের জোগান দিত, তাদের ফরমায়েশ পূরণ করতে বাধ্য হতো। এ সব উপায়ে তারা গড়ে তুলেছিল সম্পদের পাহাড়, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, দেশি-বিদেশি ব্যাংকে বিপুল সঞ্চয়। কী ছিল না তাদের! এভাবে পাপের ঘড়া যখন পূর্ণ হলো, তখন আর শেষ রক্ষা হলো না। ভারতে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইল। কিন্তু বিধিবাম! গত ২২ ফেব্রুয়ারি তাদের গ্রেফতার করা হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে। তাদের ঢাকার ও নরসিংদীর ভবন ও কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে নারী ব্যবসার বিপুল সংখ্যক ক্লিপ, নগদ ৪৮ লক্ষ ৪১ হাজার টাকা, অনেকগুলো পাসপোর্ট, চেক বই ও কিছু বিদেশি মুদ্রা। তারা এখন জেল হাজতে পচছে। এপারে তাদের বিচার কবে হবে তা কে জানে! তবে ওপারে যে জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আজাব অপেক্ষা করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গ্রাম্য কবির ভাষায় বলতে হয়:
‘হায়রে কপাল মন্দ
চোখ থাকিতে অন্ধ
খোশবু ছিল ক্ষণেক আগে
এখন তা দুর্গন্ধ।’
পরিণতি কার না আছে? দাম্ভিকতার মাতাল অশ্বে আরোহণ করে ধরাকে সরাজ্ঞান করেছে অনেকেই। লিপ্ত হয়েছে পাপাচারে। সয়লাব বইয়ে দিয়েছে দুর্নীতির-দুষ্কৃতির। তবে স্বহস্তে রোপিত বিষবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে হবে তাদের সবাইকেই। এখানে হয়ত বা এড়িয়েও যেতে পারবে। কিন্তু তা কদিনের জন্য? পরকালীন অনন্ত জীবনের তুলনায় এ জীবনের সময়টা তো এক পলের সমানো না। আসল কর্মফল ভোগের সময় তো তখন। তবে এখানেও যে কিছু ফল ভোগ করতে হয় না, তেমনটা নয়। যাদের দাপট ছিল সীমাহীন, অহঙ্কার ছিল গগন স্পর্শী, সাধারণ মানুষকে ভাবত তুচ্ছ, ওঠা-বসা করত মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সঙ্গে, আগেপাছে থাকত সিকিউরিটি কার, থাকত সশস্ত্র দেহরক্ষী, বাস করত প্রাসাদোপম ভবনে, চলাফেরা করত বিলাসবহুল গাড়িতে, মানুষ যাদের মান্য করত শ্রদ্ধা-সম্মানে নয়, অত্যাচারিত, অপদস্ত হবার ভয়ে। অবস্থার পরিবর্তনে এমন অনেকের প্রতি ঘৃণায় থুথু নিক্ষেপ করতে, তাদের বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল করতে, অভিসম্পাত বর্ষণ করতে ইদানীংকালেও মানুষ দেখেছে। উদাহরণ স্বরূপ ক্যাসিনো সম্রাট যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, জিকে শামীম, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এমপি শহিদুল ইসলাম পাপুল গংয়ের কথা বলা যেতে পারে। এদের দুষ্কৃতি, দুর্নীতি, প্রতারণা, ভন্ডামি, ষন্ডামি জালিয়াতির খবরাখবর দেশি-বিদেশি প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ও লোক মুখে মুখে এত বেশি প্রকাশিত, প্রচারিত ও আলোচিত হয়েছে ও হচ্ছে যে তার বিবরণী আর নতুন করে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবু দাম্ভিকতা ও আত্মম্ভরিতার মাত্রা কত দূর হতে পারে তার নমুনা পেশ করার জন্য এমপি শহিদুল ইসলাম পাপুলের একটি উক্তি প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলা যেতে পারে।
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এই পাপুল। মানব পাচার, অবৈধ অর্থ পাচার, রেসিডেন্স পারমিট বিক্রি, ঘুষ দেয়া ইত্যাদি অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন কুয়েতে। এখন রয়েছেন সেখানকার জেল হাজতে। অবৈধ কাজ হাসিল করার জন্য তিনি ঘুষ দিয়েছেন কুয়েতের এটর্নি জেনারেলসহ কুয়েত-পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যকে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কুয়েত সরকার। তাকে মদদ দেয়ার অভিযোগে দু’জন কুয়েতী নাগরিককে রাখা হয়েছে কারাগারে। তিনি অবৈধ অর্থ পাচার করেছেন কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে এবং ইউরোপে। কত হাজার কোটি টাকা তিনি অবৈধ পন্থায় উপার্জন করেছেন তার পূর্ণ হিসাব অবশ্য এখনও মেলেনি। এই টাকার জোরেই হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া ও মাত্রাতিরিক্ত অহঙ্কারী। তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘সাগরের পানি শুকিয়ে যাবে কিন্তু আমার টাকা শেষ হবে না। কুয়েতে ৩০ বছরে কাঁচের পাহাড় তৈরি করিনি, পাথরের পাহাড় তৈরি করেছি- যা কোনও দিন ভেঙে যাবে না।’ কিন্তু সেই পাথরের পাহাড় মাত্র কয়েক মুহূর্তে যে গুঁড়িয়ে গেল, ধ্বংস হয়ে গেল, বিশ্ববাসী সবিস্ময়ে তা প্রত্যক্ষ করেছে।
প্রসঙ্গত, এখানে সাদ্দাদের কাহিনী উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্ণিত আছে, সাদ্দাদকে ঈমানের প্রতি আহবান জানানো হলে সে জিজ্ঞাসা করল, কী পাওয়া যাবে তাতে? বলা হলো, আল্লাহ বেহেশত দিবেন। আল্লাহর বেহেশত চাই না। আমি নিজেই বানিয়ে নেব বেহেশত, বলল সাদ্দাদ। সে অঢেল সোনা, রূপা, হিরা-মানিক পুঞ্জীভূত করে সুদক্ষ কারিগরদের লাগিয়ে দিল বেহেশত বানাতে। বছরের পর বছর পরিশ্রম করে তারা সমাপ্ত করল নির্মাণ কাজ। এতদিন সাদ্দাদ শুধু প্রতীক্ষা করেছে, যায়নি সেখানে। এবার মহাসমারোহে দেখতে চলল সেই বেহেশত। অশ্বারোহণ করে পৌঁছল দ্বারোদেশে। আর মাত্র এক কদম! ঠিক সে মুহূর্তে হযরত আজ্রাইল (আ.) হাজির হলেন তার জান কবজ করতে। সাদ্দাদ বলল, একবার মাত্র আমার সাধের বেহেশতে প্রবেশ করতে দাও। আজ্রাইল (আ.) বললেন, না। আর এক পাও নয়। সাদ্দাদ মিনতির সাথে আরজ করল, তবে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে দাও। মালাকুল মউত বললেন, আজ এই মুহূর্তে এ অবস্থায়ই তোমার জান কবজ করা আল্লাহর হুকুম। বলা মাত্রই হরণ করলেন তার প্রাণ। তাই, কীসের গর্ব! কীসের অহংকার!
প্রখ্যাত ওলী হযরত ইয়াহিয়া ইবনে মায়াজ (রহ.) এর একটি বাণী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘টাকা-পয়সা হলো ভীষণ বিষধর স্বর্পতুল্য। সাবধান! মন্ত্র না শিখে তা স্পর্শ করো না। অন্যথায় তুমি বিষযন্ত্রণায় ধ্বংস হয়ে যাবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, মন্ত্রটি কী? তিনি বললেন, হালাল উপায়ে অর্জন এবং ন্যায়ভাবে যথাযথ স্থানে তা ব্যয় করা।’ তাই ধনকুবের হোক, আর রাজা-বাদশাই হোক কিংবা যে স্তরের লোকই হোক না কেন, এই উপদেশ স্মরণ রাখা উচিত, কারোরই অহংকার করা ঠিক নয়।
আজাজিল ফেরেশতাদের উস্তাদ ছিল। দাম্ভিকতার জন্য, অহংকারের কারণে তার হাজার হাজার বছরের ইবাদত বরবাদ হয়ে গেল। পরিণত হল চির অভিশপ্ত ইবলিস শয়তানে। আত্মম্ভরিতা ও অহংকারের কারণে অতীতে অনেক জাতির পতন হয়েছে, ধ্বংস-নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাদের অনেকের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। যেমন: ধ্বংস হয়েছে কওমে আদ, কওমে সামুদ, হযরত নূহ (আ.) এর অবাধ্য কওম, কওমে লূত, আসহাবে আইকা, আসহাবে উখদুদ, আসহাবে ফীল। যে নমরুদ খোদায়ী দাবি করেছিল, আকাশের খোদাকে হত্যা করার ঘোষণা দিয়ে সৈন্য সামন্ত নিয়ে ময়দানে নেমেছিল, খোদা-প্রেরিত ক্ষুদ্র মশক বাহিনী নাস্তানাবুদ করেছিল তার বাহিনীকে। প্রাসাদের গোপন প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারল না সেই নকল খোদা। ক্ষুদ্র একটি মশার কামড়ে সাঙ্গ হলো তার ভবলীলা।
ফেরাউন দম্ভভরে ঘোষণা করেছিল: ‘আনা রাব্বুকুমুল আ’লা’ অর্থ ‘আমিই বড় খোদা’- কীভাবে সে স্বদলবলে ধ্বংস হয়েছিল সে কাহিনী পবিত্র কুরআনে বিধৃত রয়েছে। বিশাল হস্তি বাহিনী নিয়ে পবিত্র খানায়ে কাবাকে ধ্বংস করতে এসেছিল উদ্ধত, দুর্বিনীত বাদশা আবরাহা। কাবার মালিক মহান আল্লাহ ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি পাঠিয়ে তাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আবু জেহেল কেবল ধ্বংস ও নিহতই হয়নি, তার মক্কাস্থিত বসত-বাড়ি এবং বদরের ময়দানে তার লাশ নিক্ষিপ্ত হওয়ার জায়গাটি এখন বিশ্ব মুসলিমের মল-মূত্র ত্যাগের স্থান-পায়খানা।
‘তারা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুত আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী।’ (সূরা আল ইমরান: আয়াত ৫৪)। ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না’। (কুরআন: সূরা লুকমান- ১৮ আয়াত)। ‘এবং যারা অহংকার করেছে তাদেরকে আল্লাহ দেবেন মর্মন্তুদ শাস্তি’। (সূরা নিসা: আয়াত ১৭৩)। ‘পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে দম্ভ করে বেড়ায় তাদের দৃষ্টি আমার নিদর্শন হতে ফিরিয়ে রাখবো। যদি তারা আমার সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে ফেলে তবুও তা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তারা ভ্রান্ত পথ দেখলে গ্রহণ করবে।’ (সূরা আরাফ: আয়াত ১৪৬)। ‘আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী স্বৈরচারী ব্যক্তির অন্তরকে মোহর করেদেন।’ (সূরা মুমিন: আয়াত ৩৫)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘(আল্লাহ বলেন) অহংকার আমার চাদর, শ্রেষ্ঠত্ব আমার পোশাক। যে কেউ এর একটি নিয়ে আমার সাথে বাড়াবাড়ি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (মুসনাদে আহমাদ)। ‘যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম, তিরমিযি)। ‘একদা হযরত মূসা (আ.) আরজ করলেন, ইয়া রাব্বুল আলামীন! আপনার ঘোরতর দুশমন কে কে? আল্লাহ বললেন, অহংকারী, কর্কশভাষী, সত্য গোপনারী, দুশ্চরিত্র। অহংকারী এই দুনিয়াতে অপমানিত ও শাস্তি প্রাপ্ত হবে। আখেরাতে অহংকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর গজব ও জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুন।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অহংকারী লোকদেরকে (কেয়ামতের দিন) আল্লাহতায়ালার সম্মুখে পিপিলিকার আকারে উপস্থিত করা হবে। তারা অন্যান্য লোকদের পাদতলে পিষ্ট হয়ে লাঞ্ছিত, অপদস্ত, হতে থাকবে। জাহান্নামের মধ্যে রয়েছে হাবহাব নামে একটি কুৎসিত ও ঘৃণিত কূপ। অবাধ্য ও অহংকারী লোকদের সেই কূপে নিক্ষেপ করা হবে।’ (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)।
‘প্রখ্যাত ওলী হযরত মুতাররফ (রহ.) একদিন মুহাল্লাব নামক এক ব্যক্তিকে গর্বভরে পায়চারি করতে দেখে বললেন, এরূপ চলাকে আল্লাহ ঘৃণা করেন। মুহাল্লাব বললেন, তুমি হয়তো আমাকে চিন না। তিনি বললেন, বিলক্ষণ চিনি। প্রথমে তুমি একবিন্দু নাপাক পানি ছিলে, পরিশেষে মৃতদেহে পরিণত হয়ে পচেগেলে ঘৃণিত অবস্থা প্রাপ্ত হবে। এর মধ্যবর্তী সময়ে মল-মূত্রাদি অপবিত্র বস্তুসমূহের ভার বহন করে বেড়াচ্ছ।’ (কিমিয়ায়ে সায়াদাত)। এই যখন জীবনের পরিণতি, তখন কর্তব্য হলো: গর্ব-অহংকার, আত্মম্ভরিতা, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে সংযমী হওয়া, বিনয়ী হওয়া, অল্পেতুষ্টি গুণ অর্জন করা। মন্দ স্বভাব পরিত্যাগ করে সৎ স্বভাবে ভূষিত হওয়া এবং এজন্য রাহমানুর রাহিমের দরবারে বিনীতভাবে প্রার্থনা করা।
বিশ্বকবির ভাষায়,
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে ।।
নিজেরে করিতে গৌরব দান
নিজেরে কেবলি করি অপমান
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।