পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ছোটগল্পের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সোনারতরী’ কাব্যের ‘বর্ষাযাপন’’ কবিতায় লিখেছেন, ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা/ নিতান্ত সহজ সরল / সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু-চারটি অশ্রু জল। নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা / নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ/ জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত/ অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল/ অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা/ কত ভাব, কত ভয় ভুল। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের এই ব্যাখ্যা করোনাকালে অসীম বিপদে পড়া দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে করুণ বাস্তবতা হয়ে ধরা দিয়েছে। শুধু দরিদ্র মানুষ কেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রেও অব্যক্ত বেদনার সাক্ষী হয়ে উঠেছে। যত দিন যাচ্ছে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট যাতনা তীব্র হচ্ছে। তীব্রতা সইতে না পেরে স্বপ্নের ঢাকা শহর ছেড়ে অসংখ্য মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে চিরতরে গ্রামে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় হয়তো ঢাকার দিকে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অক্ষম হয়ে পড়া ছোট ছোট এসব মানুষের ঢাকা ত্যাগের বিষয়টি হয়তো অনেকের কাছে, বিশেষ করে যারা ঢাকাকে ভারমুক্ত করার কথা বলেন, তাদের মনে পুলক জাগাতে পারে। তবে এ কথাও ঠিক, এসব মানুষ যতদিন ঢাকায় ছিলেন, তাদের বোঝা হয়ে থাকেনি কিংবা তাদের কাছে হাত পাতেনি। তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিন গুজরান করেছেন। তাদের কর্মের সেবা রাজধানীবাসীও পেয়েছে। একজন ছোট্ট চা-পানের দোকানদার, একজন ছোট্ট চাকরিজীবী, একজন ছোট্ট উদ্যোক্তা, কিংবা একজন স্বচ্ছল ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবীর যখন রাজধানীতে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন এ শহর ছেড়ে যেতে তার কেমন লাগে তা তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। রাজধানীতে জন্ম নেয়া এবং এর আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে সন্তানকে যখন গ্রামের স্কুলে ভর্তি করাতে যাবে, তখন তার মনের অবস্থা কি হবে? কিংবা সন্তান যখন বাবাকে জিজ্ঞেস করবে, আমরা আবার কবে ঢাকা যাব? তখন তার কি দুঃখের সীমা থাকবে? অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের ঢাকা ফেরা এক অনিশ্চিত সময়ের হাতে সমর্পিত। আবার গ্রামে গিয়েও যে তারা কাজ পাবে, ভাল থাকবে, এ নিশ্চয়তাও নেই। নিশ্চয়তা শুধু এটুকু, বাড়ি ভাড়া দেয়া থেকে রক্ষা পাবে। তবে রাজধানীতে সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে যে রঙিন স্বপ্ন ছিল, তা আজীবন তাদের পুড়িয়ে মারবে। প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের দুঃখগাথা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিবেদন অনুযায়ী, জীবনযাপনের ব্যয় কুলাতে না পেরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে গেছে। অনেকে পরিবার-পরিজন গ্রামে পাঠিয়ে নিজে মেসে কিংবা ছোট্ট একটি রুম ভাড়া করে থাকছে। তাও কতদিন থাকতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
দুই.
দেশের অর্থনীতির অবস্থা কি, তা সকলেরই জানা। যাদের অঢেল সম্পদ ও অর্থকড়ি আছে, তারাও জানে। তবে এ জানায় কোনো ফলাফল নেই। দুর্বল অর্থনীতি সহসা সবল হবে, এমন সম্ভাবনাও কম। এর ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে, নিম্নবিত্ত দরিদ্রে এবং মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছে। ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দিলে এ চিত্রটি বোঝা যাবে। সম্প্রতি ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে সারাদেশে ৯৫ ভাগ মানুষের আয় কমেছে। রাজধানীতে বসবাসরত ৮৩ ভাগ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে ৬২ ভাগ কাজ হারিয়েছে। মূলত এই দুই শ্রেণীর মানুষই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। এতো গেল নিম্ন ও নিম্নবিত্তদের কথা। যে শ্রেণীটির কথা সবসময়ই উহ্য থাকে বা তাদের দুঃখগাঁথা অব্যক্ত বেদনায় আটকে থাকে, সেই মধ্যবিত্তরা এখন কতটা যাতনার মধ্যে আছে, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো সম্ভব নয়। ধরা যাক, একজন বেসরকারী চাকরিজীবী যিনি কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকে চাকরি করেন, প্রতিষ্ঠানের খরচ কমাতে তাঁকে যদি ছাঁটাইয়ের শিকার হতে হয় বা বেতন কমানো হয়, তখন তার যে নিত্যদিনের জীবনযাপন, তা কি ঝুপ করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাবে না? করোনাকালের সময় থেকেই শোনা যাচ্ছে, গার্মেন্টসহ বেসরকারি অসংখ্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই বা বেতন কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গার্মেন্ট খাতে ইতোমধ্যে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এখন কর্পোরেট ক্ষেত্রে ছাঁটাই বা বেতন কমানোর প্রক্রিয়া চলছে। গত সপ্তাহে আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হয়। সে একটি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত। তার ব্যাংকের মালিক বা কর্তৃপক্ষ খরচ কমাতে কর্মচারী ছাঁটাই বা বেতন কমানোর মনোভাব পোষণ করছে। এ জন্য কর্তৃপক্ষ সরাসরি এ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে কর্মকর্তাদের ব্যাংক ডিপোজিট বাড়াতে লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে। বলেছে, আগামী তিন মাস পর এ লক্ষ্য অর্জনে কে কতটা সফল হয়েছে, তা মূল্যায়ণ করা হবে। বন্ধুটির ভাষ্য, এটা কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের একটি কূটনীতিক প্রক্রিয়া। কারণ, এ সময়ের মধ্যে অনেকেই টার্গেট পূরণ করতে সক্ষম হবে না। ফলে কর্তৃপক্ষ তার পারফরম্যান্স দুর্বলের অজুহাতে তাকে হয় ছাঁটাই করবে, না হয় বেতন কমিয়ে দেবে। ইতোমধ্যে সবার টেন পার্সেন্ট বেতনও কমানো হয়েছে। বন্ধুটি আরেক ব্যাংকে তার পরিচিত এক কর্মকর্তার উদাহরণ দিয়ে বলেন, উক্ত কর্মকর্তা অত্যন্ত দক্ষ। রাজধানীতে ব্যাংকটির যে কয়টি নতুন শাখা হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি শাখায় তাকে ব্যাংক ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তিনি দক্ষতার সাথে শাখাগুলোকে সফল করে তোলেন। সেই ব্যাংক কর্মকর্তাকে ব্যাংকটি ছাঁটাই করে দিয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, যোগ্য এবং দক্ষ লোকের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানই তাদের খরচ কমানোর উছিলায় ছাঁটাই করে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের আচরণ এক ধরনের অকৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ সুদিনের বন্ধুকে দুর্দিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া। এতে চাকরি হারিয়ে ব্যক্তিটি মহাসমস্যায় পড়লেও, প্রতিষ্ঠান কি উপকৃত হলো? প্রতিষ্ঠানের গতি কি স্থবির করে দেয়া হলো না? অথচ দুঃসময়ে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে এই দক্ষ লোকরাই কান্ডারির ভূমিকা পালন করতে পারত। সুকানির হাতে যদি জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন সে জাহাজ কি চালানো সম্ভব? এই কাজ করতে গিয়েই তো বুড়িগঙ্গায় সম্প্রতি মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তদ্রুপ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি দক্ষ লোকদের পরিবর্তে নবিশ লোক দিয়ে পরিচালনার প্রবণতার দিকে ঝুঁকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানকে শুধু ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে দেয়া হয় না, দুর্ঘটনার আশাঙ্কার মধ্যেও ঠেলে দেয়া হয়। আমার বন্ধুটি আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বলল, তার ব্যাংক বছরে সাত-আট শ’ কোটি টাকা লাভ করত। সরকার ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট করায় কর্তৃপক্ষের মধ্যে হায় হায় শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে লাভ দেড়-দুইশ’ কোটি টাকায় নেমেছে। তার মানে লোকসান হয়নি। কর্তৃপক্ষের এমন হা-হুতাশ দেখে মনে হচ্ছে, তারা পানিতে পড়ে গেছে। দেড়-দুইশ’ কোটি টাকা যেন কোনো টাকা নয়। এজন্যও লোকবল কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। শুধু এই ব্যাংকেই নয় অন্যান্য ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের মধ্যেও এমন প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এতো গেল বড় লোকদের গরীব হওয়ার নমুনা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার এই দুঃসময়ে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই মানবিক আচরণ করা উচিৎ। কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাঁটাই না করে তাদের ধরে রেখে এবং নিজেদের লাভের অধিক লোভের দিকে না তাকিয়ে আপৎকালীণ পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্ট চালানো উচিৎ। কারণ, এই দুঃসময় সবসময় থাকবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ কমানোর এই প্রক্রিয়ায় এখন যেসব মানুষকে বেকার করা হচ্ছে, এটি যেমন অর্থনীতির ক্ষতি ও বেকারসংখ্যা বৃদ্ধি করছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানও দক্ষ কর্মী হারিয়ে স্থবির হতে বাধ্য।
তিন.
কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ যেমন রাজধানী ছাড়ছে, তেমনি বিদেশ থেকেও লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরছে। মূলত এই দুই শ্রেণীর গন্তব্য গ্রামের দিকে। কর্মহীন হয়ে রাজধানী ছেড়ে যাওয়া মানুষ যেমন গ্রামে কাজ খুঁজবে, তেমনি বিদেশ ফেরত প্রবাসীরাও কাজের সন্ধান করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামে কাজের সুযোগ খুব কম। একমাত্র কৃষিকাজ ছাড়া কিংবা বাজারে দোকানদারি করা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। আবার সবার পক্ষে কৃষিকাজ কারাও সম্ভব হবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির প্রধানতম স্তম্ভ কৃষিখাতের দিকে যদি অধিক মনোযোগ দেয়া যায়, তবে হয়তো এসব মানুষের কিছুটা হলেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে কৃষি খাতে যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তা যদি দ্রুত সম্পন্ন হয়, তবে এর সুফল বেকার হওয়া লোকজন পেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জীবনের প্রয়োজনে, জীবনের তাকিদে মানুষকে দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। তা নাহলে, জীবন সচল থাকে না। এখন মানুষকে জীবনের পুরনো হিসাবের খাতা বন্ধ করে নতুন হিসাবের খাতা খুলতে হচ্ছে। করোনার এই সময়ে পুরনো বেকারের সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়া নতুন বেকারদের নুতন করে জীবনের হিসাব মিলাতে হচ্ছে। এ সংখ্যাটা এখন দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকারও তা ভালভাবেই জানে। জানে বলেই বিপদে পড়ে যাওয়া মানুষের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে সরকারের বেশিরভাগ প্রণোদনার সুবিধাভোগী হচ্ছে সেই ধনীক শ্রেণী। স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে প্রণোদনার বেশিরভাগই তারা পাচ্ছে। যেমন যেসব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করত, এখন তাদের অনেকেই এ ঋণ না নিয়ে গলা শুকিয়ে প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার আশায় বসে আছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বা অলস অর্থ জমার পরিমাণ বাড়ছে এবং তারা কিছুটা হলেও ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারের প্রণোদনাকেও কোনো কোনো সুবিধাবাদী শ্রেণী তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে এবং করোনা সংকট দেখিয়ে লোকবল ছাঁটাই করছে। এ কথা অনস্বীকার্য, কোনো সরকারই চায় না, দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়–ক এবং মানুষ বেকার হোক বা না খেয়ে কষ্টে থাকুক। বর্তমান সরকারও যে চায় না, তা বিভিন্ন প্রণোদনামূলক উদ্যোগ নেয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করাটাই এখন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। দরিদ্র মানুষের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা, সুষ্ঠু ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে বা করছে, সরকার সংশ্লিষ্ট লোকজনই। সরকারের ঘোষিত প্রণোদনামূলক অর্থের প্রবাহ যদি দ্রুত গতিতে শুরু হতো, তাহলে দেখা যেত এতদিনে তার ফলাফল দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব ঋণ এবং প্রণোদনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বেড়াজালে আটকে পড়েছে। অর্থাৎ অর্থ ছাড়ে শম্ভুক গতি অবলম্বন পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাঠে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতিও চাঙা হয়ে উঠে। বিভিন্ন খাত হয়ে মানুষের হাতে অর্থ যায়, সেই অর্থে তাদের জীবন সচল হয়ে উঠে। এখন এই অর্থের প্রবাহটাই পুরোপুরি চালু করা যায়নি। অথচ অর্থের সংকট নেই। আমাদের রিজার্ভ সর্বকালের মধ্যে রেকর্ড অবস্থানে রয়েছে। ৩৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। খাদ্যেরও কোনো ঘাটতি নেই। দেখা যাচ্ছে, এই সুবিধা থাকা সত্তে¡ও মানুষকে কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। অর্থনীতিতে এই অবস্থা মোটেও ভাল ইঙ্গিত দিচ্ছে না। অর্থাৎ গভীর সংকটকালে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা এবং অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এ ব্যবস্থা যদি ভেঙ্গে পড়ে বা সফলভাবে করা না যায়, তবে দেশের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়াও অস্বাভাবিক নয়। ’৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তার জন্য যথাযথ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকা এবং দুর্নীতিকে দায়ী করা হয়েছে। নোভেল জয়ী অর্মত্য দেখিয়েছেন, সে সময় খাদ্য সংকট ছিল না, ছিল এর সুষ্ঠু সরবরাহের অভাব ও দুর্নীতি। করোনাকালে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্যে সেই আলামত দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। এর রাশ টেনে ধরা না গেলে চলমান ভয়াবহ পরিস্থিতি যে আরও অবনতির দিকে ধাবিত হবে, তা আগেভাগে বলা যায়। যদি এমন হয়, পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে, অর্থও আছে, অথচ মানুষ অর্ধপেটে বা অনাহারের মধ্যে রয়েছে, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
চার.
করোনার কারণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার হয়েছে এবং বেকারত্বের হার জনসংখ্যার অর্ধেকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা কমাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতেই হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সক্রিয় এবং উদ্যোগী হতে হবে। খরচ কমিয়ে বেকারত্ব বৃদ্ধির পরিবর্তে আয় বাড়ানোর উদ্যোগে সক্রিয় হওয়া উচিৎ। কর্মসংস্থানের প্রধানতম উৎস হচ্ছে বিনিয়োগ। দেশে আগে থেকেই বিনিয়োগে মন্দাবস্থা ছিল। করোনাকালে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এ অবস্থা কাটাতে সরকারকেই সর্বাগ্রে উদ্যোগী হতে হবে। এ ব্যাপারে বিনিয়োগ বোর্ডকে অধিক সক্রিয় হতে হবে। বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের উৎসের সন্ধানে নামতে হবে। করোনার কারণে বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি বিনিয়োগের উপযুক্ত স্থান খুঁজছে। সেসব কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করতে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার কি কি সুবিধা দিচ্ছে। সরকারের যেসব মেগা প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোর কাজ পুর্নোদ্যমে শুরু করার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। কম প্রয়োজনীয় বা যেগুলো এখন বাস্তবায়ন না করলেও সমস্যা হবে না, সেসব প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে কিছুটা হলেও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সরকারে নির্ধারিত একশ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে দ্রুত তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। এখন শহরভিত্তিক কর্মসংস্থানকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জেলা ও গ্রামভিত্তিক করার ওপর জোর দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। গ্রাম ছেড়ে রাজধানীতে আসা মানুষ স্বাভাবিক সময়ে জীবনযাপন করতে পারলেও কঠিন ও জরুরি পরিস্থিতি যে তাদের জন্য উপযোগী নয়, তা রাজধানী ছেড়ে যাওয়া মানুষের পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে। রাজধানী সবার জন্য নয়, করোনা তা ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। যেসব মানুষ রাজধানী ছেড়ে গেছে তারা তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে। তাদের এই অভিজ্ঞতা থেকে যারা রাজধানীমুখী হতে ইচ্ছুক, তাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। তা নাহলে, রাজধানীতে এসে আবার ফিরে যাওয়ার কঠিন ও করুণ বেদনার মুখোমুখি হতে হবে। আর এখন গ্রামেও অনেক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে গেছে। রাজধানীর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহজ হয়েছে। ফলে গ্রামে থেকে স্বউদ্যোগে জীবিকার ব্যবস্থা করাই হবে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত। এখন বিভিন্ন ধরনের খামার করে স্বাবলম্বী হওয়ার দিকে মানুষ ঝুঁকেছে। গবাদি পশু, মৎস্য, হাঁস-মুরগী, বিভিন্ন বিশেষায়িত ফল, শাক-সবজির খামার করে অনেক মানুষ সাফল্য পাচ্ছে। এতে অনেকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। অর্থাৎ বেকার হয়ে পড়া মানুষকে এখন নিজেকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে আরও সক্রিয় হতে হবে। সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তির সুবিধা দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন উদ্যোগে উৎসাহমূলক পরামর্শ দেয়া এবং তার ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বেকার হয়ে হতাশায় নিপতিত মানুষের মনে আশা ও উৎসাহের সৃষ্টি হবে। তারা নতুন করে জীবন গোছাতে ও সাজাতে উদ্বুদ্ধ হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।