পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নিজ দেশকে শিল্পে উন্নত করতে চায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তারা মডেল হিসাবে ধরে নিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নেই। বাংলাদেশের মত দেশগুলোর কাছে উন্নয়ন মানেই শিল্পায়ন- শিল্প স্থাপন এবং অধুনা শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ। শিল্পায়ন বস্তু সভ্যতার বিবর্তনের এক অনিবার্য ফসল। কাজেই শিল্প উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে কারো পক্ষে বস্তু সভ্যতা সংলগ্ন হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু, সারাদেশ শিল্পে শিল্পে ভরিয়ে তুলতে হবে- একথাও কেউ বলবেন না। উৎপাদনের ঐতিহ্যবাহী ম্যানুয়েল ব্যবস্থাকে যান্ত্রিকীকরণ করার কথা বলা যায়, এতে অন্ততঃ যুক্তি দেখানো যাবে। কিন্তু, উৎপাদনের যে বড় সেক্টর কৃষি- তার প্রতি উদাসীন থেকে অবহেলায় তাকে রুগ্ন করে তুলে শুধু শিল্পায়নের পেছনে ধাবিত হওয়াটা সুস্থ চিন্তার ফসল নয়। বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলা যায়, শুধুমাত্র শিল্প-কারখানার সংখ্যা বা শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিই কোন জাতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। সর্বোপরি, শুধুমাত্র শিল্প উৎপাদন এখনো মানুষের জীবন ধারনের একমাত্র নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে এমন ভরসা খোদ বিজ্ঞান সাধকরাই করতে পারছেন না। বরং তারাই প্রকৃতিকে- প্রাকৃতিক বিধি-ব্যবস্থাকে সংরক্ষণের জোর তাগিদ দিচ্ছেন। এমন কথাও বলছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে না পারলে মানব জাতির ভবিষৎ বিপন্ন হবে। তারা এ-ও বলেছেন যে, গত দু’শতাব্দীর শিল্পসভ্যতা গোটা পৃথিবীকে পয়মাল করে ফেলেছে। পৃথিবীর বৃহত্তর অংশ এখন মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন যে, একুশ শতক হবে প্রকৃতি উদ্ধারের শতক। এসবের বিরোধিতা কেউ করছেন না, বরং, প্রকৃতি রক্ষা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা জোরদার হয়ে উঠেছে খোদ শিল্পোন্নত দেশগুলোতেই।
শুরুতে দরিদ্র, অনুন্নত ও উন্নয়নগামী দেশগুলোর যে মনোভাবের কথা বলা হয়েছে, তারা কিন্তু প্রকৃতি সংলগ্ন হওয়ার নয়া কর্মোদ্যোগের প্রতি মোটেই দৃষ্টি দিচ্ছে না। তাদের চোখে এখনও শিল্পই জীবন-যাপনের কৃত্রিম যান্ত্রিক উপকরণ সমৃদ্ধ স্বপ্নের জগত। শিল্পোন্নত দেশের লোকজন যখন এই জগত থেকে বেরিয়ে এই বস্তু সভ্যতার কৃত্রিম জগতের সাথে প্রকৃতির সমন্বয় ঘটাতে উঠে-পড়ে লেগেছে তখন উন্নয়নগামী দেশগুলো প্রাকৃতিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে শুরু প্রকৃতির প্রাণবন্ত পরিবেশ বিঘ্নিত করে বস্তু সভ্যতার কৃত্রিমতায় পৌছার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। শিল্পায়নের জন্য কে কত বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণ আনতে পারে, এটা এখন এসব দেশের সরকারগুলোর যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে উঠেছে বলা যায়। হালে দেশীয় এনজিওগুলোতে বিদেশী ফান্ড কত বেশী এল, বিদেশী কত এনজিও দেশে কর্মকান্ড শুরু করল- তাও গর্বের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও দু-একটি ব্যতিক্রম যে চোখে পড়ছে না তা নয়। সম্প্রতি কৃষি পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নীতিমালার বিরোধে ব্রাজিল কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কৃষি পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য সুবিধা প্রদান না করলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর ব্যাপারে অবাধ বাণিজ্য আর চলতে দেয়া হবে না।
এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে কোস্টরিকায় বাণিজ্য মন্ত্রীদের এক সভায় ব্রাজিলের প্রতিনিধি পরিষ্কার বলেছেন, আমেরিকার সাথে ও ‘আমেরিকা’ সমূহের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য এলাকা যদি কেউ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে কৃষি পণ্যের বাণিজ্যকে ‘প্রধান বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে’। অথচ কিউবা ব্যতীত এই গোলার্ধের সবক’টি দেশ ১৯৯৪ সালে মায়ামিতে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে আলাস্কা থেকে পেতাগোনিয়া পর্যন্ত সকল অঞ্চল ও দেশকে যুক্ত করে একটি অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু এ অঞ্চলের কৃষি প্রধান দেশগুলো যখন তাদের আমদানী শুল্ক হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি পণ্য এসে দক্ষিণ আমেরিকার বাজার সয়লাব হয়ে যাবে, তখন তারা নিজেদের কৃষি পণ্যের স্বার্থে কথা বলেছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এখন দাবি জানাচ্ছে, সমগ্র আমেরিকার কৃষি পণ্যের বাজার খুলে দেয়ার জন্য। অর্থাৎ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কৃষি পণ্য উৎপাদন করছে তা শুধু দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর বাজার ভাসিয়ে দেবে তা হতে দিচ্ছে না তারা। প্রসঙ্গক্রমে, এখানে বলতে হয়, শিল্পোন্নত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে তার কৃষিকে অনাদরে-অবহেলায় সরিয়ে রাখেনি। বরং, কৃষি খাতেও কম্পারেবল এডভানটেজ-এর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ থেকে যেমন কৃষি প্রধান উন্নয়নগামী দেশগুলোর বোধোদয় হওয়া উচিত, তেমনি ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো কৃষি পণ্যের স্বার্থ সংরক্ষণে শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে তা থেকেও শিক্ষা নেয়া আবশ্যক। এখানে শুধু কৃষি খাতের প্রতিই গুরুত্বের প্রকাশ ঘটছে না, বরং অবাধ বাণিজ্যের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত বা দুর্বল দেশগুলোর গ্রহণযোগ্য অবস্থানের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্রাজিল এর আগেও বিদেশী ঋণের সুদ নিয়েও দৃঢ় বক্তব্য রেখে ঋণগ্রস্ত উন্নয়নগামী দেশগুলোর কাছে অনুকরণীয় নজির হয়ে উঠেছিল। অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকসহ সকল আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা ও ঋণদাতাদের ঋণের সুদ পরিশোধ করবো না এমন কথা কোন উন্নয়নশীল দেশই আর উচ্চারণের সাহস দেখাতে পারেনি। তবে এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কথা বলা যায়। পাকিস্তান কয়েক বছর আগে একবার জার্মান ঋণের সাথে অনিবার্যভাবে জুড়ে দেয়া ‘বিশেষজ্ঞদের’ বাতিল করে দিয়েছিল। এ তৎপরতা ছিল যথেষ্ট যৌক্তিক। কেননা, প্রতিটি ঋণ গ্রহীতা উন্নয়নগামী দেশেরই এই অভিজ্ঞতা ভালমতই হয়েছে যে, গৃহীত ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যয় করতে হয় ঋণের সাথে ঋণদাতাদের জুড়ে দেয়া বিশেষজ্ঞদের পুষতে। যাহোক, এই অনুকরণীয় দৃষ্টান্তটিও বিশেষ কেউ অনুকরণ করেছে এমন বলা যাবে না।
বাংলাদেশের মত উন্নয়নগামী বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর বদ্ধমূল ধারণা, ঋণ যত বেশী আনা যাবে, দেশ তত বেশি উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে। এ ধারণা জেঁকে বসার আসল কারণটি দুর্নীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিদেশী ঋণ যত আসবে, তত বেশী প্রজেক্ট হবে তত বেশী অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিদেশী দান অনুদানতো বটেই এমনকি, ঋণের টাকাকেও উন্নয়নগামী দেশের সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকল মহল মনে করেন মুফতে পাওয়া টাকা। ফলে, শিল্প উন্নয়ন বা উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে হয় না, বরং গরীব দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধনী লোকের প্রাদুর্ভাব ঘটে মাত্র। ঋণ আনাটা যে কোনো ক্রেডিটের বিষয় নয়, এটা উপলব্ধি করার অবকাশ যেন কারো নেই। প্রায় একই কথা বলা যায়, বিদেশী বিনিয়োগ আনার ব্যাপারে। কেননা, শিল্পায়নটাই বড় কথা নয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বিনিয়োগ শিল্প বাড়ায় একথা ঠিক, কিন্তু সে শিল্প যদি দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করতে না পারে তাহলে উন্নয়নটা হয় বড়জোর অর্ধেক। আর অর্ধেক উন্নয়ন কোনো উন্নয়ন হিসেবে গণ্য হতে পারে না। সর্বোপরি, আমরা যদি বাংলাদেশের কথাই ধরি তাহলে দেখা যাবে, কৃষি প্রধান এই দেশটির বেশ কিছু কৃষিপণ্য রয়েছে- যা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হলে যে শিল্পপণ্য উৎপাদিত হবে তা বহির্বিশ্বে পেতে পারে একচেটিয়ে বাজার। কিন্তু, দেশীয় কৃষিপণ্যভিত্তিক শিল্পয়ানের প্রচেষ্টা আশানুরূপ নয়। অথচ, এটা করা গেলে একদিকে, দেশের কৃষিখাতে নয়া প্রাণ সঞ্চার ঘটতো, অন্যদিকে, শিল্পায়নও হতো। এছাড়া, দেশের রফতানী বানিজ্যও প্রসারিত হতে পারতো। এমন একটা ধারণা এখন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা পাচ্ছে যে, এনজিও কার্যক্রম ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশেতো এনজিও কর্মকান্ড ভালই চলছে এবং অনেক দিন ধরেই চলছে, কিন্তু উন্নয়ন কতটুকু ঘটেছে, এ প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নেই। কেননা, এনজিওদের সাফল্যের খবরাদি যতটা প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তাদের ভূমিকার বস্তুগত মূল্যায়ন ততটা হয়নি। আসলে ততটা কেন, কিছুটাও হয়নি। সরকারের দায়িত্ব ছিল নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই মূল্যায়ন করা। কিন্তু তা হয়নি এবং অদূর ভবিষ্যতে হবে এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই। কেননা, প্রায় সব সরকারকেই বিদেশী দাতাগোষ্ঠীকে তুষ্ট রাখার জন্য কোনো না কোনোভাবে এনজিও তোষণে নামতে দেখা যায়। গ্রামে গ্রামে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মানুষজন কৃষির ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে, কৃষি এখন খুবই ব্যয়বহুল উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে, কৃষিপণ্যের বাজার তুলনামূলকভাবে বাড়ছে না। অলাভজনক হয়ে ওঠা এই কৃষিখাতে বিনিয়োগ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু, কৃষি এমন একটি খাত যা থেকে হাত গুটিয়ে থাকার কোন উপায় নেই। কেননা, মানুষকে খাদ্যশস্যের জন্য কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত থাকতে হবেই। এর বিকল্প এখনো হয়নি, অদূর ভবিষ্যতেও হবে এমন আশা করার কোনো কারণ দেখা দেয়নি। অথচ ইতোমধ্যে কৃত্রিম সার, বিষাক্ত কীটনাশক ইত্যাদির নির্বিচার ব্যবহার বাংলাদেশের মত উন্নয়নগামী দেশগুলোর জমি বিনষ্ট করে ফেলছে, জমির উর্বরতা হ্রাস করে ফেলছে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। আরেকটি ক্ষতি হয়ে গেছে। আর তা হল হাজার বছর ধরে পরীক্ষিত শস্যবীজ হারিয়ে গেছে। সারনির্ভর যে শস্যবীজ উদ্ভাবিত হয়েছে এবং এখন দেদার ব্যবহৃত হচ্ছে তা কতদিন স্থায়ী হবে এবং আদৌ প্রকৃতিনির্ভর হতে পারবে কিনা তা এখনো কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যুগযুগ ধরে যা ছিল নির্ভরযোগ্য তা হারিয়ে গেছে এবং যা এসেছে তা ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয়তা মিটাতে পারে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সারা বিশ্ব এখন প্রকৃতির কাছে ফিরতে চাচ্ছে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারের তাগিদ উচ্চারিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে জৈব সার ব্যবহারের ফলে আজকের রাসায়নিক সারের উপযোগী শস্যবীজ কতটা কার্যকর হবে- এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনো হয়নি। তবু মানব জাতিকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকৃতির কাছেই ফিরতে হবে। প্রকৃতি উদ্ধার করতে হবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে এবং সর্বোপরি নির্ভর করতে হবে প্রকৃতি সংলগ্ন্ উৎপাদন ব্যবসার উপর। আর এজন্যই বাংলাদেশের মত কৃষি প্রধান দেশগুলোকে কৃষি খাতের প্রতি হেলাফেলার মনোভাব অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। কৃষি উৎপাদনকে তার নিজস্ব শক্তির ওপর দাঁড় করাবার উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করতে হবে। আর এটাই হতে হবে একুশ শতকের প্রধান অবলম্বন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।