Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যয়সংকোচন নীতি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনা ভাইরাসের কারনে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে এখন মন্দার ঢেউ এবং প্রত্যেক দেশের অর্থনীতিই বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি। মন্দার কারণে শিল্প, ব্যবসা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই আর্থিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় এখন অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বনের কথা ভাবছে। এর অংশ হিসাবে বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানো, কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাঁটাই, বেতন-ভাতা কমানো এবং নিয়োগ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রয়োগ হচ্ছে। সরকারী চাকরীজীবিদের এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ব্যয়সংকোচন নীতির অংশ হিসাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই, নিয়োগ বন্ধ ও বেতন ভাতা কমানো অর্থনীতির মন্দা মোকাবেলার ক্ষেত্রে কোন সমাধান নয়, বরং এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এতে অর্থনীতির চাকা ভেঙ্গে পড়বে এবং সর্বত্রই বির্পযয় সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিবর্তে ক্ষতি হবে বেশি।
যারা চাকুরীজিবি তাদের আয় সীমাবদ্ধ। একজন ব্যক্তি যেখানেই চাকরী করুক না কেন, মাস শেষে তিনি নির্দিষ্ট পরিমান বেতন পান এবং তাতেই সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানো হয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে বেতন কমে গেলে টিকে থাকার জন্য তার ব্যয়সংকোচন নীতি গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই। অধিকাংশ চাকুরীজীবি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন এর বিপরীতে তাকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা পরিশোধ করতে হয়। বেতন কমে যাবার কারণে প্রথমেই তিনি বাসা ভাড়া বাবদ খরচ কমাবেন। বেশি ভাড়ার বসবাসরত বাসা ছেড়ে কম ভাড়ার বাসায় উঠবেন। এর ফলে বাড়িওয়ালারও আয় কমে যাবে। বাড়িওয়ালাও ব্যয়সংকোচন নীতি গ্রহণ করবেন । বাড়িওয়ালার বাড়িটি যদি ব্যাংক ঋণে নির্মিত হয়ে থাকে, তার পক্ষে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বেতন কমে যাওয়াও চাকরীজীবিও ব্যয় কমানোর জন্য বাসার কাজের লোক বিদায় করে দিবেন। কাজের লোকের চাকরী হারানোর ফলে তার পরিবারেও বির্পযয় নেমে আসবে। চাকরীজীবি গাড়ি ব্যবহার করে থাকলে, খরচ কমানোর জন্য গাড়ির ব্যবহার কমাবেন এবং এর অংশ হিসাবে গাড়ির ড্রাইভার বিদায় করে দেবেন। ফলে ড্রাইভারের পরিবারের বির্পযয় নেমে আসবে। গাড়ির তেল ক্রয় কমিয়ে দেয়ার ফলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে । খরচ কমাতে চাকরীজীবি বাসায় পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন রাখলে, তা বন্ধ করে দিবেন। এতে পত্রিকা বিক্রেতাদের আয় কমে যাবে, পত্রিকা বিক্রি কমে যাবে এবং পত্রিকার মালিকের আয় কমে যাবে। ফলে সাংবাদিকদেরও আয় কমে যাবে । পত্রিকার সার্কুলেশন কমে যাবার কারণে কাগজ/রঙ সহ এই শিল্পে জড়িত সকলের আয় কমে যাবে। ব্যয়সংকোচন নীতির অংশ হিসাবে অনেকে পোশাক কেনা কমিয়ে দিবে। এতে কাপড়ের চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি কাপড় ব্যবসায়ী, কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং এর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ এ সেক্টরে জড়িত সবারই আয় কমে যাবে এবং সবাই সমস্যায় পড়বে। এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ ইলেকট্রনিক পণ্য কেনা কমে যাওয়ার কারণে এখাতে জড়িত সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ অথবা ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পণ থাকলে তা আপাতত স্থগিত রাখবেন। এতে আবাসন খাত এবং এ সংশ্লিষ্ট সবাই সমস্যার মধ্যে পড়বেন। জমি এবং ফ্ল্যাটের কেনাবেচা কমে যাবার কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে।আয় কমে যাবার কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে। এদিকে চাকরীজীবি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসাবে যে অর্থ ব্যয় করত, তা এখন কমিয়ে দিবেন। ফলে সমাজের বঞ্চিত এবং অসহায় মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। খরচ কমানোর জন্য মোবাইলে কথা বলা কমে যাবে। এতে মোবাইল কোম্পানীগুলোর আয় কমবে, সরকারের রাজস্ব আয় কমবে। একইভাবে চাকরিজীবীর ভ্রমণ এবং বেড়ানো কমে যাবে। ফলে র্পযটন খাত ক্ষতিগ্রস্থ হবে, সাথে সাথে পরিবহন খাতও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এভাবে একজন ব্যক্তির আয় কমার কারণে সমাজের আরো দশজন ব্যক্তির আয় কমে যাবে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। ব্যয়সংকোচন নীতির অংশ হিসাবে একটি প্রতিষ্ঠান যখন বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয় তখন সংবাদপত্র এবং মিডিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সুতরাং ব্যয়সংকোচন নীতি গ্রহণ, চাকুরীজীবিদের ছাঁটাই, নিয়োগ বন্ধ এবং বেতন কমানো কোনো সমাধান নয় বরং তা অর্থনীতিকে আরো মন্দা অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে ।
মন্দার কারণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই আর্থিক সংকটে নিপতিত এবং এটাই বাস্তবতা। এ সংকট উত্তরণে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়সংকোচন করা স্বাভাবিক। তবে তার জন্য বিদ্যমান লোকজনকে চাকুরীচ্যুত করা যাবে না, বেতন ভাতা কমানো যাবে না এবং নতুন নিয়োগও বন্ধ করা যাবে না। এ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করেও ব্যয় কমানো যায়। একটি নির্দিষ্ট সময়, যেমন এক/দুই বছরের জন্য কর্মকতা/কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল না দিয়ে, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করে এবং প্রমোশন না দিয়ে ব্যয় কমানো সম্ভব। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হবে বিদ্যমান আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। প্রবৃদ্ধি অর্জনের টার্গেট নয়, এক/দুই বছর অর্থাৎ মন্দাকালে সবার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ বর্তমান অবস্থানকে ধরে রাখা এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনে মানোযোগী হওয়া। প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক ঋণ প্রদান করা। বাংলাদেশ ব্যাংকে যে বিরাট অংকের রিজার্ভ ফান্ড রয়েছে, সেই রিজার্ভ ফান্ড থেকে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য ঋনের ব্যবস্থা করা। এ জন্য নতুন পলিসি প্রণয়ন করতে হবে। বলা বাহুল্য, একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন ঐ প্রতিষ্ঠানের মোট ব্যয় নয়, একটি অংশ মাত্র। এর বাইরে আরো অনেক খরচ রয়েছে যেমন ব্যাংক ঋণের সুদ, অফিস ভাড়া, স্টেশনারী , পরিবহন খরচ, বিজ্ঞাপন খরচ, সরকারী ট্যাক্স ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ঋনের সুদ একটি বড় খরচ। সুতরাং স্টাফ ছাঁটাই এবং বেতন কমানো কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। তাছাড়া এক অর্থ বছরে একটি প্রতিষ্ঠানের আয়ের পুরো অংশ ব্যয় হয় না। আয়ের একটি অংশ ভবিষ্যতের জন্য রিজার্ভ রাখা হয়। সুতরাং সংকটকালে এই রিজার্ভ ফান্ডের অর্থ ব্যয় করা হোক এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা হোক। এদিকে প্রতি বছর নতুন করে কয়েক লাখ মানুষ চাকরী বাজারে প্রবেশ করছে । এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়সংকোচন নীতির কারণে নতুন জনবল নিয়োগ বন্ধ রাখলে বেকার সমস্যা আরও তীব্র হয়ে উঠবে । ফলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে এবং অর্থনীতি আরো খারাপ হবে । অন্যদিকে একজন চাকরীজীবি যদি চাকরি হারানোর ভয়ে চিন্তাগ্রস্থ থাকে এবং তার বেতন কমিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সে উদ্দীপনা হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এতে তার কর্মস্পৃহা এবং কর্মদক্ষতা কমে যায়। প্রতিষ্ঠানের গতিশীলতা কমে যাওয়া থেকে শুরু করে আয় এবং প্রবৃদ্ধি কমে যায়। সুতরাং চাকরীচ্যুতি এবং বেতন ভাতা কমানো যাবে না । যেহেতু সর্বত্রই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তাই এই সংকট চাকরীজীবিদেরকেও মানতে হবে। এটা চাকুরীজীবিদেরকে হাসি মুখে মানতে হবে এবং সংকট উত্তরনে সবাইকে অধিকতর সততা , কর্তব্যনিষ্ঠা এবং ত্যাগ তিতিক্ষার সাথে কাজ করতে হবে। এসময় প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করতে হবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় না বাড়া মানে আয় বাড়া। কাজেই একটি প্রতিষ্ঠান তার জনশক্তির বেতন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য না বাড়িয়ে এবং না কমিয়ে, বিদ্যমান বেতন বহাল রেখে তার ব্যয় কমাতে পারে। এভাবে সংকট কালীন সময়ের সমাধান করা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই শ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে উন্নত করেছে। সংকটকালে প্রতিষ্ঠানের উচিৎ সেই কর্মীদের পাশে থাকা। আর এই সংকট বেশি দিন থাকবে না। দ্রæতই ঘুরে দাঁড়াবে। প্রতিষ্ঠান মালিকদের উচিত হবে একটু র্ধৈয্য ধারন করা এবং সবার সহযোগিতা নিয়ে এই সংকটকাল অতিক্রম করা ।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনীতি

৩ জানুয়ারি, ২০২৩
২১ নভেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন