পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বেশ কিছুদিন থেকেই দেশি বিদেশি পত্রপত্রিকা এবং থিংক ট্যাংকে জল্পনা-কল্পনা চলছে করোনা উত্তর বিশ্ব ব্যবস্থা কেমন হবে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, করোনা উত্তর আন্তর্জাতিক তথা ভূমন্ডলীয় রাজনীতি কেমন হবে। সেটি কি এককেন্দ্রিক হবে? এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। নব্বই দশকের আগে পৃথিবীর রাজনীতি ছিলো দুই মেরুভিত্তিক বা দ্বিকেন্দ্রিক। অর্থাৎ পৃথিবী দুইটি শিবিরে বিভক্ত ছিলো। একদিকে পশ্চিমা শিবির বা পুঁজিবাদী শিবির। এই শিবিরের নেতৃত্বে ছিলো আমেরিকা। আরেক দিকে ছিলো কমিউনিস্ট শিবির। জোট নিরপেক্ষ শিবিরের কয়েকটি অকমিউনিস্ট দেশও কমিউনিস্ট শিবিরের সাথে ছিলো। এই শিবিরের নেতৃত্বে ছিলো সোভিয়েট ইউনিয়ন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এক শিবিরের নেতা ছিলো আমেরিকা এবং অপর শিবিরের নেতা ছিলো সোভিয়েট ইউনিয়ন। এভাবে দুইটি পরাশক্তির নেতৃত্বে বৈশ্বিক রাজনীতি বিভক্ত হওয়ায় তখনকার পৃথিবীকে বলা হতো বাই পোলার ওয়ার্ল্ড বা দ্বিকেন্দ্রিক বা দুই মেরুর পৃথিবী।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে তার জঠর থেকে উৎপত্তি হয় ১৫টি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে বিশ্বে একটি মাত্র পরাশক্তি রইলো। আর সেটি হলো আমেরিকা। নব্বই দশকের পর থেকে পৃথিবী যেভাবে চলছে সেটিকে বলা হয় ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড বা এককেন্দ্রিক পৃথিবী বা এক মেরুর পৃথিবী। এখন পর্যন্ত এই অবস্থাই চলছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের স্থান দখল করেছে রুশ ফেডারেশন বা রাশিয়া। সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কোনো দিক দিয়েই রাশিয়া আমেরিকার সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা, তার ধারে-পাশেও নেই। তাই আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক পৃথিবী অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে হয়েছে এক নতুন ডেভেলপমেন্ট। বিগত দুই আড়াই দশক ধরে চীন অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছে। তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কোনো কোনো বছর ১০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এই দুই আড়াই দশক ধরে চীনের প্রবৃদ্ধি ছিলো গড়ে ৮ শতাংশ। আয়তনে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হওয়ায় এই লাগাতার উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি চীনের সামষ্টিক ধন-সম্পদকে বিপুলভাবে বৃদ্ধি করেছে। চীনের অর্থনীতির আকার বাড়তে বাড়তে অর্থনৈতিকভাবে চীন এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে এখনো বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। গণচীনের এই বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্যে বিশাল অবদান রেখেছে তাদের রপ্তানি খাত। বলতে গেলে চীনা পণ্য বিশ্ববাজার দখল করেছে। এমন কি আমেরিকার নিত্যপণ্যের বাজারও দখল করেছে চীনা পণ্য। এখন পৃথিবীতে রপ্তানী আয়ের দিক দিয়ে এক নম্বরে আছে চীন। সারা বিশ্বের রপ্তানি বাজার আরো জোরেসোরে দখল করতে রপ্তানি আয় বহুগুণ বৃদ্ধি করতে এবং সামগ্রিক অর্থনীতির আকারকে আরো অনেক বড় করার জন্য চীন এক উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই মহাপরিকল্পনার নাম হলো, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’। সংক্ষেপে বিআরআই। এশিয়ার জাপান থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্ক হয়ে ইউরোপে এই মহাসড়ক প্রবেশ করবে।
দুই
এই বিআরআই চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংয়ের এক স্বপ্নের পরিকল্পনা। আজকের এই চীন আর সেদিনের সেই চীন নেই। আগেই বলেছি, অর্থনৈতিকভাবে চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, তেমনি প্রযুক্তিগতভাবেও চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। একমাত্র সামরিক শক্তিতে চীন পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। সামরিক শক্তিতে এক নম্বরে আমেরিকা, দুই নম্বরে রাশিয়া এবং তিন নম্বরে চীন। বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তি এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হলো ভারত। প্রিয় পাঠক, অর্থনৈতিক শক্তি আরো সহজ করে বোঝাবার জন্য আমাকে এখানে কতগুলো টেকনিক্যাল পরিভাষা ব্যবহার করতে হচ্ছে। বিশ্বের ১১টি অর্থনৈতিক শক্তির নাম আমি ক্রম অনুসারে সাজিয়ে দিচ্ছি। সাজাতে গিয়ে আমি কয়েকটি পরিভাষা ব্যবহার করছি। সেগুলো হলো, মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন। ১ মিলিয়ন সমান ১০ লক্ষ। এক বিলিয়ন সমান ১ হাজার মিলিয়ন। অংক শাস্ত্রে এটাকে এভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে, টেন টুদি পাওয়ার টুয়েলভ। এক ট্রিলিয়ন সমান ১ হাজার বিলিয়ন। অংকের ভাষায় টেন টুদি পাওয়ার এইটিন। একটি দেশের অর্থনীতি কত বড় বা ছোট সেটি বোঝাতে গেলে বলতে হয় সেই অর্থনীতির আকার। উদাহরণ স্বরূপ, আমেরিকার অর্থনীতির আকার হলো ২০ হাজার ২ শত ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ট্রিলিয়নের হিসাবে এটি হবে ২০.২৩ ট্রিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হলো চীনের। আকার ১৪ হাজার ৩ শত ৪২ মার্কিন ডলার। ট্রিলিয়নের হিসাবে ১৪.৩৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। লক্ষ করুন, আমেরিকা ও চীনের অর্থনীতিতে ফারাক হলো ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পরে রয়েছে তিন নম্বরে জাপান। চার নম্বরে জার্মানি। পাঁচ নম্বরে ইন্ডিয়া। ছয় নম্বরে বৃটেন। সাত নম্বরে ফ্রান্স। আট নম্বরে ইটালি। নয় নম্বরে ব্রাজিল। দশ নম্বরে কানাডা এবং এগারো নম্বরে রাশিয়া। জাপানের অর্থনীতির আকার হলো ৫.১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের অবস্থান পঞ্চম স্থানে থাকলেও তার অর্থনীতির আকার ২.৯৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাশিয়া ১১ নম্বরে আছে। তার অর্থনীতির আকার ১.৬৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিন
প্রিয় পাঠক, পরিসংখ্যান দিয়ে আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তবে যেটুকু দিয়েছি সেটুকু থেকে আপনারা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা হচ্ছে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে। অন্যেরা যে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, তাদের সাথে অর্থনীতির আকারের দিক দিয়ে আমেরিকা ও চীনের সাথে তাদের অর্থনীতির আকার বিস্তর ফারাক। সুতরাং আগামী দিনে যদি আমেরিকার সাথে অন্য কারো প্রতিদ্ব›িদ্বতা হয় তাহলে সেটি হবে চীনের সাথে।
চীন এখনো পরাশক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়নি সামরিক শক্তির কারণে। তবে কোনো দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী হয় এবং প্রযুক্তিগতভাবে অনেক অগ্রসর হয় তাহলে তার পক্ষে সামরিক শক্তি অর্জন করা খুব কঠিন কোনো বিষয় নয়। আমার মনে হয়, পরাশক্তি হওয়ার যে দুটি পূর্বশর্ত সেই দুটি পূর্বশর্তই পালন করে চলেছে চীন। আজ চীনের যে সামরিক শক্তি বিশেষ করে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর যে সমরাস্ত্র সম্ভার, তার সমস্তই নিজ দেশে উৎপাদিত। একই কথা প্রযোজ্য রাশিয়া এবং আমেরিকার ক্ষেত্রেও। কিন্তু রাশিয়ার জিডিপি বা অর্থনীতির আকার ১.৬৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার পক্ষে নিত্য নতুন সমরাস্ত্র উৎপাদন এবং পরাশক্তি হওয়ার জন্য সেগুলি সংরক্ষণের চাপ তার অর্থনীতি বহন করতে পারবে না। যেমনটি ঘটেছিলো ৩০ বছর আগে সোভিয়েট ইউনিয়নের ক্ষেত্রে। সেখানে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়ে গিয়েছিলো। ৫০ লক্ষ মানুষের সামরিক বাহিনীর ভার সোভিয়েট অর্থনীতি বহন করতে পারছিলো না। ঐ ভারে দেশটিই ভেঙে যায়। কিন্তু গণচীনের সেই অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিআরআইয়ের কাজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে গণচীন পরাশক্তি হিসাবে এবং আমেরিকার প্রতিদ্ব›দ্বী রূপে উত্থিত হওয়ার চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যেই চীনকে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য আমেরিকা চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে।
চার
আমরা ফিরে যাচ্ছি আমাদের প্রথম প্রশ্নে। আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতি তথা বিশ্ব ব্যবস্থা কেমন হবে? তবে ঠিক এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় একটি কারণে। আর সেটি হলো, করোনা প্যান্ডেমিকে কোন দেশ কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিদিনই কোন দেশের কত লোক আক্রান্ত হয়েছেন এবং কত লোক মৃত্যু বরণ করেছেন সেই পরিসংখ্যান আমরা পাচ্ছি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে কোন দেশ কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই ধরনের কোনো তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শনিবার রাতে যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১ লক্ষ ৩২ হাজার। তালিকার ২২ নম্বরে নেমে গেছে গণচীন। শনিবার চীনে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৮৩ হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজার ৬৩৪ জন। রাশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার, মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৬ লক্ষ এবং মৃত্যু সাড়ে ১৮ হাজারের বেশি।
এসব পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায় যে, চীনের করোনা উত্তর বিশ্বে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রশ্নটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৪ বছর পর ১৯৪৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সময় তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ মার্শালের নাম অনুযায়ী মার্শাল প্ল্যান নামক যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্ল্যান বাস্তবায়ন শুরু হয়। এই প্ল্যানের তহবিল ছিলো ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৭২ বছর আগে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আজ ৭২ বছর ধরে কত শত বিলিয়ন ডলার হতে পারে সেটি কল্পনা করুন। এই মার্শাল প্ল্যানই ভিত্তি রচনা করেছিলো আজকে বিশ্বে চতুর্থ অর্থনৈতিক শক্তিশালী জার্মানির।
করোনা উত্তর এই ধরনের কোনো পুনর্গঠন পরিকল্পনা কোনো দেশ থেকে আসবে কিনা আমরা জানি না। আমেরিকা নিজেই যেখানে বিধ্বস্ত, সেখানে এসম্পর্কে মন্তব্য করা আরো কঠিন। তবে এরই মধ্যে তিনটি বিশ্ব সংস্থায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো হলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ। আগামী দিনে আমেরিকা, চীন এবং রাশিয়া নয়া বিশ্ব শক্তি হওয়ার চেষ্টা করলেও রাশিয়া এই দৌড়ে পেছনে থাকবে। আমেরিকার প্রভাব ইতোমধ্যেই হ্রাস পেয়েছে। চীনকে সকলেই গণনার মধ্যে আনছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সমীক্ষক একটি তৃতীয় মেরুর উত্থানের জল্পনা কল্পনা করছেন। এই মেরুতে থাকতে পারে জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং কানাডা।
সব কিছু পরিষ্কার হবে করোনা অবসানের পর।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।