পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পাটের রাজধানী খ্যাত বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনে যেতে বসেছে পাটকল। কথাটা ভাবতেই কষ্ট লাগছে। একসময় সোনালী আঁশের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিল। পাট ছিল বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরি ফসল। সোনালী আঁশের প্রিয় দেশ এখন পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের দেশে পরিণত হয়েছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে যদি পাটের উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেত তাহলে হয়ত সরকারকে পাটকলগুলো বন্ধ করার মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সরকারি পাটকলগুলো আজ ধবংসের দ্বারপ্রান্তে।
বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্তে¡ও শুধু মাত্র ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, শ্রমিক নেতৃবৃন্দের দৌরাত্ম্য, সরকারি নীতিনির্ধারক শ্রেণির সীমাহীন উদাসীনতা দেশের ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্পের সার্বজনিন ব্যবহারকে বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। পলিথিন দখল করে নিয়েছে পাটজাত পণ্যের বাজার। পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে, খাল-বিল নদী-নালা পলিথিনে ভরাট হয়ে গেছে। বড় বড় শহরের ড্রেনেজ সিসটেমগুলো অনেকাংশে অচল হয়ে পড়া সত্তে¡ও এক অজানা কারণে আমরা পলিথিনের ব্যবহারকে রুখতে পারিনি। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার দেশে আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। বাড়তে থাকলো পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিনের ব্যবহার।
পাট একসময় আমাদের জাতীয় কৃষিজ ফসল হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমাদৃত ছিলো। ছিলো একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশজ কৃষি ফসল। অবহেলা আর অবজ্ঞায় পাট আজ বিলুপ্তপ্রায়।
পাটকে কেন্দ্র করে দেশের নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল ‘আদমজি জুট মিলস’। প্রায় লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিলো। বিশ্বের মোড়ল সংস্থা ও দেশসমূহের পরামর্শে আমরা সেটাও বন্ধ করে দিয়েছি। দেশে পাটজাত পণ্যের বাজারকে নিরুৎসাহিত করার জন্য আইন বহিভূর্তভাবে পরিবেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর পলিথিন কারখানা দেশে তৈরি হলো। আইনগত বিধিনিষেধ থাকা সত্তে¡ও পলিথিনে ছেয়ে গেল আমাদের হাট-ঘাট ও বাজার। আমরা দেখেও না দেখার ভান করলাম। অথচ সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পরিবেশ সহায়ক হওয়া সত্তে¡ও পাটজাত পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলাম না। সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তদারকির অভাবে পাট আজ দেশ থেকে নির্বাসিত হবার পথে। অথচ পাটের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, কৃষকের ভালবাসা।
ভাবতে অবাক লাগে যে, যখন লোকসানের অজুহাতে দেশে একের পর এক পাটকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নতুন নতুন পাটকল সীমান্ত ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে। পাটচাষের জন্য বাংলাদেশের মাটি যে পরিমাণ ঊর্বর ও উপযোগী তা কিন্তু ভারতসহ অন্যান্য দেশের মোটেই নয়। তাহলে কেন আমরা পাটকল চালাতে পারছি না? ভারত পারছে কী করে? আমরা পারলাম না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা দেশ ও দেশের কৃষকের স্বার্থে আজ খুবই জরুরি। পাটকে বাঁচাতে এবং এর বিকাশে দেশে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় রয়েছে। আছে আলাদা পাট অধিদপ্তর। তাদেরই বা কাজ কী? রাষ্টীয় অর্থে পরিচালিত বিভিন্ন সংস্থা একাজে নিয়োজিত থাকলেও এ সেক্টরের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাঁচানো যাচ্ছে না পাট শিল্পকে। শত সমস্যা, শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কিন্তু দেশের কৃষক আশায় বুক বেঁধে পাট চাষ করে গেছে। পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাটে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারপর আবার দেশের পাট চাষিরা সুদিনের আশায় পাটচাষ করেছে ঐতিহ্যবাহী পাটকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
সরকারি পাটকল সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলের সংখ্যা ২৭টি। তবে এর মধ্যে তিনটি আবার ননজুটমিলস্। ৬টি নতুন পাটকলসহ এসংখ্যা এখন ৩৩টি। এই ৩৩টির মধ্যে বন্ধ পাটকলের সংখ্যা ৭টি। বাঁকিগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার মধ্যদিয়ে।
সরকার করোনা মহামারির মধ্যেই অতিসম্প্রতি ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে সমুদয় পাওনাদি পরিশোধ করে বিদায় করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে মোট ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারাবে। নাম লেখাবে বেকারের খাতায়। এদিকে ২০১৩ থেকে আজ অবধি ৯৫৪ জন শ্রমিক সাধারণ নিয়মে অবসরে গেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অর্থ সংকটের কারণে তাদের অবসর ভাতা এখনও পরিশোধ করা যায়নি। গত ৪৮ বছরে সরকারকে এখাতে মোট ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে, যা পরিশোধ করতে হয়েছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়।
সরকারি খাতের পাটকলগুলো দিন দিন রুগ্ন হলেও বেসরকারি খাতের পাটগুলো কিন্তু ঠিকই লাভ করছে এবং ভালভাবে টিকে আছে। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো মুনাফা করলেও সরকারি পাটকলগুলো কেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েও কোটি কোটি টাকা প্রতিবছর লোকসান দিলো তা কি খতিয়ে দেখা হবে কোনদিন? যারা এ খাতকে রুগ্ন করার জন্য দায়ী তারা কি কোনদিন বিচারের মুখোমুখি হবে?
বেসরকারি খাতে দেশে মোট পাটকলের সংখ্যা ২৮১টি, যার মধ্যে বন্ধ ৫৬টি। সরকার পাটকলগুলিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে মিলগুলোকে আধুনিকায়ন করার পর তা সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপে চালু করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। খুবই ভালো কথা। তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধ করাটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকার করনোকালে একদিকে শ্রমিক ছাঁটাই না করতে বেসরকারি খাতের শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রতি আহবান জানিয়েছে। শ্রমিকদের সাথে মানবিক আচরণ করতে অনুরোধ করেছে অন্যদিকে সরকার নিজেই ২৫টি পাটকল বন্ধ করে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিককে কর্মহীন করে দিয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তাদের কর্মী ছাঁটাই করতে উৎসাহিত করতে পারে, যা সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের অর্থনীতির উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া চাকরি হারোনো প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিকের পরিবার কীভাবে দিনাতিপাত করবে তা এক বিরাট প্রশ্ন পরিবারগুলোর সামনে। অনেকের মতো আমারও জানতে ইচ্ছে করে, দেশের পাটকলগুলো কি কোনভাবেই চালোনো যেত না? যাদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে গেলো তাদের কি কোনদিন বিচারের মুখোমুখি করা হবে? নাকি তারাও ব্যাংকের টাকা তছরুফকারী ও বিদেশে টাকা পাচারকারীদের মতো অধরাই থেকে যাবে? যারা শ্রমিকদের শোষণ করে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করে সুইস ব্যাংকে জমা করেছে তা কি কোনদিন ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে? অবৈধভাবে পাচারকৃত এই বিপুল পরিমাণ টাকা ফিরিয়ে এনে পাটকলসহ দেশের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা গেলে অসংখ্য কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান হতো। দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতো।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।