পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভয়ংকর করোনার মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূলে আঘাত হানে। এখন বর্ষার শুরুতেই বানের পানি ঝাপিয়ে পড়েছে। একের পর এক আপতিত দুর্যোগে মানুষের দুর্ভোগ, বিপর্যয় ও ক্ষতির শেষ নেই। করোনায় এমন কোন খাত নেই যার অপূরনীয় ক্ষতি না হয়েছে। ব্র্যাকের হিসাবে করোনায় কেবল কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, আম্পানে ধান ও ফলের ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার। আর ইতোমধ্যেই শুরু হওয়া বন্যায় দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আমনের বীজতলা, শীষ বোরোনোর পর্যায়ে থাকা আউশ ধান, আখ, পাট, ভুট্টা, শাকসবজি ও তরিতরকারির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির যত অবনতি ঘটছে, ক্ষতির পরিমাণও তত বাড়ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে বন্যায় অন্তত ২০ জেলার আবাদ-উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। কুড়িগ্রাম, নীলফামারী থেকে বগুড়া পর্যন্ত নীচু এলাকা তলিয়ে গেছে। ১০ জেলায় বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য জেলার নীচু এলাকায়ও পানি বাড়ছে এবং বাড়িঘর, ফসলাদি, মাছের পুকুর ডুবছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত চলে এসেছে। কয়েক দিনের মধ্যে তা মানিকগঞ্জে প্রবেশ করবে। দু’চার দিনে বৃহত্তর ফরিদপুরসহ মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চলও ডুববে। বর্ষণ ও উজানের ঢলে নদনদীর পানি ক্রমাগত বাড়ছে। ১২ জেলায় কমপক্ষে ৯টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদীর পানিও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রামের ৫০টি ইউনিয়ন, গাইবান্ধার ১৩টি ইউনিয়ন, রংপুরের ২টি ইউনিয়ন, নীলফামারীর কয়েকটি গ্রাম ও চরাঞ্চল, সিরাজগঞ্জের ২০টি ইউনিয়ন, জামালপুরের ১৬টি ইউনিয়ন ও নেত্রকোনার ৮টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ওদিকে সুনামগঞ্জের প্রায় সব উপজেলা ও সিলেটের নিম্মাঞ্চল নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যাক্রান্ত এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তাদের দু:খ-দুর্ভোগের শেষ নেই।
চলতি বন্যাকে আগাম বন্যা বা আকস্মিক বন্যাও বলা যেতে পারে। বর্ষাকাল কেবল শুরু হয়েছে; এত আগে বন্যা দেখা দেয়ার কথা নয়। এর মধ্যে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতও হয়নি। দুয়েক দিন কিংবা দু’চার দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হলেও এমন পরিস্থিতি হতে পারে না। আসলে এই বন্যার জন্য ভারতের ঠেলে দেয়া পানিই দায়ী। এটা ইতোমধ্যেই সকলের জানা হয়ে গেছে, সে দেশের আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। ওইসব এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, ভারত তার ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ একযোগে খুলে দিয়েছে। বিপুল পানি রাশি হুড়মুড় করে বাংলাদেশের সীমায় ঢুকে পড়েছে, সৃষ্টি করেছে এই দুর্ঘট। নদী ও পানির ব্যাপারে তথ্য আদান-প্রদান করার একটা সমঝোতা আছে দু’দেশের মধ্যে। ভারত সেই সমাঝোতা মোতাবেক তথ্য দেয় খুব কমই। পানির, বিশেষ করে বাঁধ খুলে দেয়ার তথ্য যদি আগেই ভারত দিত তবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ সাবধান হতে পারতো, ক্ষতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে পারত। ভারতের অসহযোগিতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ভারত বরাবরই ‘এটা করে এবং সেজন্য বাংলাদেশকে ব্যাপক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এটা যে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। সেই ১৯৫৭ সালে ক্রুগ মিশন বন্যা মোকাবিলায় সে সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে ভারতের সঙ্গে তথ্যের লেনদেন করার কথাও ছিল। বাংলাদেশে প্রবাহিত প্রায় সব নদীই ভারত থেকে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা দিয়ে আসা পুরো পানি বাংলাদেশ হয়েই সাগরে পতিত হয়। কাজেই, তথ্যর আদান-প্রদান দু’ দেশের জন্যই আবশ্যকীয়। ভারত কেন তথ্য প্রদানে আগ্রহ দেখায় না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ যেহেতু সর্বশেষ ভাটির দেশ সুতরাং এখানে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রমবাদে প্রতিবছরই বন্যা হয়। কখনো বড়, কখনো ছোট, কখনো একাধিক। বন্যা শুধু মানুষকে ডুবিয়েই মারে না, তাদের বাড়িঘর, স্থাপনা, ফসল, বাগান ইত্যাদি ধ্বংস করে। নদী ভাঙনে এ পর্যন্ত যে কত মানুষ পথের ভিখারীতে পরিণত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেশের প্রকৃতিক অবস্থান অনুযায়ী বন্যা ও বন্যার আশংকার মধ্যেই আমাদের বসবাস করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা ও বন্যার ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। উজান থেকে পানি যেমন আসবে তেমনি নদ-নদীর বুকে পলি-বালি জমে ভরাট হবে। এবং বন্যাও হবে। বন্যা মোকাবিলার উপায় হিসাবে বিশেষজ্ঞরা, ছোট ছোট বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিকাশ প্রকল্প গ্রহণ, ব্যাপক ড্রেজিং, পরিকল্পিত ফ্লাড জোন গড়ে তোলা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আমরা দেখেছি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো অত্যন্ত ভংগুর। পানির একটু ধাক্কাতেই ভেঙ্গে যায়। এগুলো সেভাবে শক্ত করে বানানো নয়। বাঁধের অর্থ সরিয়ে নেয়াই এর কারণ। ড্রেজিং অত্যন্ত কার্যকর বিবেচিত হলেও তা যথাযথ গুরুত্ব পায় না। ড্রেজিংয়ের টাকা নয়-ছয় হওয়া অতি সাধারণ ব্যাপার। পানি সমস্যার সমাধান ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফারাক্কার বিপরীতে অনুরূপ একটি বাঁধ নির্মাণের তাকিদ থাকলেও তা এখনো নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এই পানি ব্যবস্থাপনাও খুব দুর্বল। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চীনসহ বহু দেশ সফল হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয় কমাতে আগের বিভিন্ন সুপারিশ এবং ডেল্ট প্লান বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। পরিশেষে বলবো, চলতি বন্যার গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাদের সহায়তা করতে হবে। আর যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।