পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ২৫ জুন বৃহস্পতিবার দেশের বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবে ‘এইচ টি ইমামকে সরিয়ে দিন’ শীর্ষক একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে গত শনিবার ব্যারিস্টার সৌমিত্র সরকার বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেছেন। গুলশান থানার ডিউটি অফিসার এসআই নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, মন্তব্য প্রতিবেদনে মানবপাচারের দায়ে কুয়েতে আটক হওয়া লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে জড়িয়ে নানা মন্তব্য করা হয়। এতে তার ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং দেশ ও সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এর আগে দৈনিক ইনকিলাবসহ অন্যান্য দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ায় কুয়েতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল গ্রেফতারের পর টাকা দিয়ে এমপি হওয়ার নেপথ্য কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। ভোটের কয়েক দিন আগে কেন্দ্র থেকে সাংগঠনিক চিঠি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহিদের পক্ষে প্রচারণায় নামার নির্দেশনা পাওয়া নিয়ে লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদন যেন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়ার মতোই।’ মন্তব্য প্রতিবেদনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সম্পর্কে চরম আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, বিকৃত ও মানহানিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে বলে মামলার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং এর কোনো কোনো ধারার অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে বহুদিন ধরেই দেশের পত্র-পত্রিকার সম্পাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, আইনজ্ঞ, বিশিষ্টজন, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংগঠন এবং সংস্থা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছে। এতে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমসহ সবক্ষেত্রে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে বলে তাদের সুস্পষ্ট অভিমত। আইনটির কোনো কোনো ধারা বাতিল করার দাবী এবং পরামর্শও দেয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আইনটির অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের আশঙ্কা বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে। করোনার মহামারির সময়েও এর ব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত এ আইনের শিকার হয়েছে। সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুনালের হিসাব অনুযায়ী, এ আইনে এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৩২৭ টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৮৬ টি, ফেব্রুয়ারিতে ১১৯টি এবং মার্চে ১২২ টি মামলা হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিক সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে এবং যুক্তি দিয়ে খন্ডণ করতে না পেরে যে কেউ এই আইনের কোনো কোনো ধারার অপব্যবহার করে মামলা ঠুকে দিচ্ছে। এতে বাকস্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশে যৌক্তিক ও গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করতে না পারার এ প্রবণতা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের কারণে মানুষ সামাজিক নানা অসংগতি, জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট না হয়ে কিংবা সরকারের নেয়া নানা সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে তাদের মতামত প্রকাশ করছে। সবক্ষেত্রেই যে এসব সমালোচনা বা মত প্রকাশ যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে, তা বলার সুযোগ নেই। যদিও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সব ধরনের মতামত প্রকাশের উদারতা এবং তা সহিষ্ণুতার সাথে গ্রহণের রীতি-নীতি সমর্থন করে। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমার মতের সাথে আমি একমত না হতে পারি, তবে তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে পারি।’ ভলতেয়ারের এই অমোঘ বাণী যুগে যুগে গণতন্ত্রমনস্ক সরকার এবং জনগণ ধারণ করে আসছে। তার এ কথা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, যৌক্তিক ও গঠনমূলক মতামত গ্রহণ না করা বা উড়িয়ে দেয়া বা বিক্ষুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সরকার রাষ্ট্রের স্বার্থে ও কল্যাণের জন্য করেছে। এ আইন ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তির সুবিধা নেয়ার জন্য করা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, এ আইনের কোনো কোনো ধারার কারণে পান থেকে চুন খসলেই অনেকে মামলা ঠুকে দিচ্ছে, যা সুবিবেচনা প্রসূত নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্র এবং এর সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কথায় কথায় এ আইনে মামলা দেয়া হচ্ছে। অথচ সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের কোনো প্রতিবেদন সরকার থেকে শুরু করে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বিমত থাকলে মামলা-মোকদ্দমা না করেও তার প্রতিবিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রকাশিত সংবাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বা প্রতিবাদ করে তার বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে পারে। এ ধরনের বিধি-বিধান সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে স্বীকৃত। তাছাড়া সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি প্রেস কাউন্সিলেও অভিযোগ দায়েল এবং বিচার পেতে পারে। মূলত এ জন্যই প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তা না করে, অসহিষ্ণু হয়ে আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মামলা-মোকদ্দমার পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, সংবাদপত্রের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথকে রুদ্ধ এবং দমন করা, যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিপন্থী। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংবাদপত্র সরকারের ভাল কাজের যেমন প্রশংসা করে, তেমনি তার ভুল-ত্রু টি ধরিয়ে দেয়াসহ কোথায় কি ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে, তা তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ভূমিকা পালন করে। সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। গণতন্ত্র ও সুশাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে এসব মাধ্যম নিরলস কাজ করে চলেছে।
দৈনিক ইনকিলাবে যে মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা সরকারকে সহায়তা করার জন্যই করা হয়েছে। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা কোনো ধরনের স্বার্থের কারণে করা হয়নি। দেশ, জাতি এবং সরকারের কল্যাণই এ প্রতিবেদনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। প্রথম আলো পত্রিকাসহ অন্যান্য যেসব পত্রিকা ও অনলাইনে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই মূলত মন্তব্য প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় সংসদেও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতি বিষয়ক সংবাদের নিন্দামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং দেশ ও জাতির যে কোনো স্বার্থে মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকারের গোচরে এনে তার প্রতিকারের পরামর্শ দেয়া সংবাদপত্রের দায়িত্ব এবং তা তার রীতি-নীতি ও এখতিয়ারের মধ্যে রয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে দেশ ও জাতির যেকোনো স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এবং কিসে সরকারের কল্যাণ ও অকল্যাণ নিহিত, তা আন্তরিকতা ও সততার সাথে তুলে ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যখন প্রথাসিদ্ধ পথের বাইরে ডিজিটাল আইনের নিপীড়নমূলক ধারায় মামলা করা হয়, তখন তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের ওপর আঘাত হিসেবেই পরিগণিত হয়। এ পরিস্থিতি শুধু গঠনমূলক সংবাদ প্রকশের পথকেই রুদ্ধ করবে না, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।