পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সমাজে অভাবী, দরিদ্র, অসহায়দের প্রতি দান-সদকা প্রদানের উত্তম সময় মাহে রমজান ও ঈদ-উল ফিতর পার হয়ে গেলেও সারা বছর এ দান খয়রাত উত্তম কাজেরই অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব মানবের জন্য ‘করোনা’ মহামারী বহুমুখী দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে এলেও আল্লাহর করুণা লাভের এক সুবর্ণ সুযোগও সাথে করে এনেছে। আর তা হচ্ছে ধনী-বিত্তশালী সক্ষমদের দানের হাত প্রসারিত করা। ইসলাম এ দিকটার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
পবিত্র কোরআনে জনসেবার প্রতি তাগিদ দিয়ে অধিকাংশ স্থানে ‘এহসান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোরআনে বিশ্বাসীদের নির্দেশ দান করে বলা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টির সেবা করে এবং এই সেবা যেন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হয়। তাতে কোনো প্রকার লৌকিকতা থাকতে পারবে না, ব্যক্তি স্বার্থও তার সাথে জড়িত থাকতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই সেবা পরিচালিত হলে স্বয়ং আল্লাহ তার প্রতিদান দেবেন।
সূরা বাকারার ১৯৬ আয়াতে আল্লাহতাআলা সৃষ্টি নির্বিশেষে প্রত্যেকের সাথে এহসান বা উপকার করার নির্দেশ দান করেছেন। বলেছেন, ‘এবং তোমরা এহসান কর, নিশ্চিত আল্লাহতাআলা এহসানকারীদের ভালবাসেন।’ সূরা আল ইমরানের ১৩৫ আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘ক্রোধ নিবারণকারী, ক্ষমা প্রদর্শনকারী এবং এহসানকারীদের আল্লাহতাআলা ভালবাসেন।’ এহসান সম্পর্কে সূরা কাসাসের ৭৮ আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘এবং এহসান কর, যেরূপ আল্লাহতাআলা তোমার প্রতি এহসান করেছেন।’
আল্লাহতাআলা তাঁর অনুগতদের প্রতি যেমন এহসান প্রদর্শন করে থাকেন, তেমনি অবাধ্যদের প্রতিও। পবিত্র কোরআনের উদ্দেশ্য হলো এই যে, প্রত্যেক মুসলমান সমস্ত সৃষ্টির জন্য নিজের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী অনুরূপ উত্তম আচরণ প্রদর্শন করবে। সূরা বনি ইসরাইলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা পূণ্য কর তা তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য করবে এবং যদি তোমরা কারো সাথে মন্দ আচরণ কর তাহলে তার ক্ষতিও তোমাদেরকেই বহন করতে হবে।’
এহসান ও সৎ আচরণের একটি উচ্চ স্তর হচ্ছে, সাধারণ লোকের সাথে উত্তমরূপে কথাবার্তা বলা। সবরকমের উত্তম শিক্ষা-দীক্ষা ও উত্তম উপদেশ নির্দেশাবলী তার অন্তর্ভুক্ত। সূরা বাকারার ১০০ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং সকল লোকের সাথে উত্তমরূপে কথাবার্তা বলবে।’ অর্থাৎ প্রত্যেকের সাথে ভালো কথা বলবে এবং উত্তমরূপে বলবে। এতদ্ব্যতীত সূরা নহলের ৩১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এই জগতে পূণ্য তাদের জন্য যারা লোকের প্রতি এহসান প্রদর্শন করেছে।’ পবিত্র কোরআনে জনসেবার প্রতি উৎসাহদানকারী আরো বহু আয়াত রয়েছে, এগুলো অবগত হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
‘খেদমতে খালক’ বা জনসেবা ইসলামের একটি প্রশিক্ষণ হিসেবে সুপরিচিত। ইসলাম ধর্মে মানবতাবোধের এটি অন্যতম নিদর্শন। জনসেবা হচ্ছে মানবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনসেবার মাধ্যমে মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে থাকে। মানবসমাজের জন্য যা কিছু হিতকর, যা কিছু মানব সমাজের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন করে থাকে অথবা কল্যাণ সাধনে সহায়ক হয়, তার সবই সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত। সমাজসেবা তথা মানবতার কল্যাণসাধন ব্যতীত মানুষ যেমন মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে না, তেমনি মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে হলেও সমাজকল্যাণ বা জনসেবা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামের ইতিহাসে সমাজসেবার যে মহান আদর্শ দেখতে পাওয়া যায়, তা অনুসরণ করা হলে আজকের সমাজও আদর্শ সমাজ হিসেবে পরিচিত হতে পারে, জাতীয় জীবনে দেখা দিতে পারে নানা কল্যাণ, সাফল্য। বর্তমান যুগের সমাজসেবীদের জন্য নিম্নের কতিপয় ঘটনা বিশেষ অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে। এসব ঘটনা হতে সমাজসেবীরা নিজেরাও উপকৃত হতে পারেন, সমাজকেও বহু কিছু দান করতে পারেন।
ইসলামের দ্বিতীয় মহান খলিফা হজরত উমর (রা.) সম্পর্কে ইতিহাস হতে জানা যায় যে, তাঁর নিয়ম ছিল এই যে, যেসব স্ত্রীর স্বামীরা সফরে থাকত, তিনি তাদের গৃহে চলে যেতেন এবং দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম করতেন। অতঃপর তাদের জিজ্ঞাসা করতেন, তারা কি অবস্থায় আছে, তাদের কোনো জিনিসের প্রয়োজন আছে কি না, তাদের প্রতি কেউ নির্যাতন চালচ্ছে কি না ইত্যাদি। তিনি তাদের বাজার করে দিতেন। যে সব পরিবারে কোনো গোলাম বা কৃতদাস থাকত তাদের হজরত উমর (রা.) সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে যেতেন এবং সওদা খরিদ করে ঐ সব মহিলার নিকট পাঠিয়ে দিতেন। পুরুষদের চিঠিপত্র এলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলো পাঠ করে বুঝিয়ে দিতেন এবং সাধারণত তিনি নিজেই ঐ সব পত্রের উত্তর লিখে দিতেন। বহিরাগত কাফেলার অবস্থা জিজ্ঞাসা করতেন। যদি তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ বা খোঁড়া-অচল থাকত তার জন্য সোয়ারীর ব্যবস্থা করে দিতেন। কাফেলা যাত্রা করলে কিছু দূর তাদের সঙ্গে গমন করতেন। যদি কাফেলার কোনো জিনিসপত্র ভুলে থেকে যেত দ্রুত এসে তিনি তা নিয়ে যেতেন এবং কাফেলার কাছে পৌঁছিয়ে দিতেন। এভাবে হজরত উমর (রা.) তাঁর প্রজাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি লক্ষ রাখতেন। সমাজসেবায় এরূপ মহান আদর্শ তাঁর জীবনে অসংখ্য দেখতে পাওয়া যায়।
হজরত আলী (রা.) সম্বন্ধে অনুরূপ ঘটনার কথা জানা যায়। তাঁর নিয়ম ছিল এই যে, তিনি জঙ্গলে গমন করে পথহারা মুসাফিরদেরকে পথ প্রদর্শন করতেন, বাজারে গিয়ে কুলিদের বোঝা উঠিয়ে দিতেন এবং কারো জুতা বা অন্য কিছু পাওয়া গেলে তা তাকে পৌঁছে দিতেন।
‘কাদেসীয়া’র যুদ্ধে যখন হজরত উমর (রা.)-কে মুসলমানদের বিজয় সংবাদ জানানো হলো তখন তিনি জনসমাবেশে এক ভাষণ দান করেন। ভাষণের এক স্থানে তিনি বলেছিলেন, ‘ভ্রাতাগণ! আমি বাদশাহ নই যে, তোমাদেরকে গোলাম বানিয়ে ছাড়ব। বরং আমি আল্লাহতাআলার একজন নগণ্য গোলাম। যেহেতু খেলাফতের মহান দায়িত্ব আমার ন্যায় দুর্বল লোকের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছে, তাই আমার মুক্তি এতেই নিহিত যে, আমি তোমাদের সেবা করব আর তোমরা শন্তিতে ঘুমাবে। খোদা না করুক, যদি আমার মধ্যে আরাম ভোগ করার ইচ্ছা জন্মে এবং তোমরা আমার ঘরের সামনে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পালন কর, তা হলে মনে করতে হবে যে, আমার পতন ও ধ্বংসের দিন ঘনিয়ে আসছে। আমি তোমাদের হেদায়েতের পথে আহবান করছি কাজ ও কর্মের মাধ্যমে, কেবল মুখের কথার দ্বারা নয়।’
একদা হজরত উমর (রা.) লোকের সাথে বসে খাচ্ছিলেন। এমন সময় দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তি মজলিসে বাম হাতে খানা খাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ডান হাতে অসুবিধা কি? সে ব্যক্তি বলল, ‘মুতা’ যুদ্ধে (হিজরী ৮ সালে) তার হাত কেটে গিয়েছে। এ কথা শ্রবণ করার পর তাঁর মধ্যে দারুণ আবেগের সৃষ্টি হয় এবং তিনি অশ্রু সজল নয়নে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে তোমার অজু করায়, কে মাথায় পানি ঢালে, আর কে তোমাকে পোশাক পরিধান করায়।’ অতঃপর তিনি সরকারি খরচে একজন চাকর তাকে প্রদান করলেন এবং তার আবশ্যকীয় সকল জিনিসপত্রও সঙ্গে দিলেন। হজরত উমর (রা.) সাধারণত রাতে অলি-গলি পাহারা দিতেন। এক রাতে তিনি পরিভ্রমণ করতে করতে একটি তাবুর নিকট পৌঁছেন। তাবু হতে কোনো বিপদগ্রস্ত লোকের ব্যথার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি অসুবিধা কি জিজ্ঞাসা করলে জনৈক ব্যক্তি বাইরে বের হয়ে জানায় যে, তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা আরম্ভ হয়েছে এবং কোনো সাহায্যকারী নেই। হজরত উমর (রা.) তা শুনে নিজ গৃহে ফিরে আসেন এবং তাঁর স্ত্রী হজরত উম্মে কুলসুম (রা.)-কে সঙ্গে করে আবার উক্ত তাবুর নিকট আসেন এবং তাঁর স্ত্রীকে তাবুর ভিতরে প্রেরণ করেন।
তিনি স্বয়ং তাঁবুর বাইরে মাটিতে বসে তাবুর লোকটির সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন। সন্তান প্রসব হওয়ার পর হজরত উম্মে কুলসুম (রা.) বাইরে এসে সুসংবাদ জানালেন, ‘আমীরুল মোমেনীন! আপনার বন্ধুকে সুসংবাদ দান করুন।’ ‘আমীরুল মোমেনীন’ শব্দ শুনে লোকটি বিচলিত হয়ে উঠে এবং বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থী হয়। হজরত উমর (রা.) বললেন, ‘সেবক হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব ছিল। আগামীকাল তুমি আমার কাছে আসবে, এই শিশুর ভাতা ধার্য করে দেব।’
হজরত উমর (রা.) তার খেলাফতের আমলে একবার জমি বন্দোবস্তের ইচ্ছা করেন এবং এই প্রসঙ্গে উসমান বিন হানিফ ও হোজাইফা বিন আল ইয়ামানকে আদেশ করেন, তারা যেন ইরাকের সমস্ত ভ‚মি জরিপ করে কর ধার্য করেন। আদেশমত তারা নিম্ন বর্ণিত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন:
ইরাক, দৈর্ঘ্য ৩৭৫ এবং প্রস্থ ২৪০ মাইল। আর কৃষিযোগ্য জমি তিন কোটি ষাট লক্ষ ‘জরীব’। লাওয়ারিশ ও পলাতক লোকদের জমি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং অবশিষ্ট জমির নিম্ন লিখিতভাবে কর ধার্য করা হয়:
১। গম, প্রতি ‘জরীব’ অর্থাৎ- পৌনে এক বিঘা জমির কর ধার্য করা হয়, বার্ষিক দুই দেরহাম।
২। যব, বার্ষিক এক দেরহাম।
৩। ইক্ষু, বার্ষিক ছয় দেরহাম।
৪। তুলা, বার্ষিক পাঁচ দেরহাম।
৫। আঙ্গুর, বার্ষিক দশ দেরহাম।
৬। খেজুরের বাগান, বার্ষিক দশ দেরহাম।
৭। তিল, বার্ষিক আট দেরহাম।
৮। তরকারি, বার্ষিক তিন দেরহাম।
এই রিপোর্ট পাঠ করে হজরত উমর (রা.) খুবই আনন্দিত হন এবং বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি যদি আরও কিছুদিন জীবিত থাকি, তাহলে আমার পরও ইরাকের বিধবা, অসহায়, অভাবী, দরিদ্রদের কারো মুখাপেক্ষী হতে দেব না।’
হজরত উমর (রা.)-এর এই বাক্য হতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও আদর্শ কী হওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় জীবনে সমাজসেবার যে আদর্শ আমরা ইসলামের মহান খলিফাদের আমলে দেখতে পাই তাতে সমাজকল্যাণের নিখুঁত ছবি ফুটে ওঠে। মানব কল্যাণের জন্য ইসলাম নিবেদিত, খলিফারা তাদের জীবনে তা প্রমাণ করে গেছেন। আজকের রাষ্ট্রীয় জীবনেও রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ যদি ইসলামের মহান খলিফাদের সমাজকল্যাণমূলক আদর্শের অনুসরণ করে চলেন, তাতে কওম ও মিল্লাতের অসীম কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।