পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে চরম সংকটে বিশ্বঅর্থনীতি। দেশে দেশে শিক্ষা, শিল্প, যোগাযোগ, পর্যটন ব্যবসায়-বাণিজ্য স্থবির। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি তা থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অন্যদেশের চেয়ে আরো ভয়ানক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালুর কথা বলা হলেও বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটা। আমরা শপিংমল খুলে দিলাম কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা করলাম না। লকডাউন না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে উৎসবের আমেজ তৈরি করলাম। গণপরিবহন বন্ধ রেখে গার্মেন্ট খুলে দিলাম। পরে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে গণপরিবহন চালু হলো কিন্তু বিধি মানার কোনো বালাই নেই। সদরঘাটে যা হচ্ছে তা তো আরো উদ্বেগজনক। মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের কথা চিন্তা না করে গণপরিবহনের ভাড়া একলাফে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো। করোনা সংকট কেটে গেলে ভাড়া আগের পর্যায়ে আসবে কিনা তার কোনো সুস্পষ্ট সরকারি ঘোষণা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করলাম কিন্তু মান বজায় রাখতে কোনো তদারকি নেই। সবখানেই সমন্বয়হীনতা প্রকট। দেশে প্রায় ৭০টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসতাপাল থাকলেও জাতির এমন দুর্যোগে তাদের অধিকাংশের ভূমিকা অস্পষ্ট। দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে স্বাস্থ্যসেবা। সাধারণ রোগে অসুস্থ মানুষের স্বাস্থ্যসেবাও নাগালের বাইরে।
বিশ্ব মহামারীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এর আগেও ভাইরাস বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে মানবসভ্যতায় চরম আঘাত করেছে। এসেছে রাশিয়ান ফ্লু, স্পানিস ফ্লু, কলেরা, এইডস ও প্লেগের মতো মহামারী। প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। সময়ের ব্যবধানে তা আবার পৃথিবী থেকে হারিয়েও গেছে। আজকে কথা উঠেছে কেন মহামারীগুলো একের পর এক পৃথিবীতে আভির্ভূত হচ্ছে। প্রকৃতি আমাদের জন্যে ধরনীতে অনেক নিয়ামত পাঠিয়েছে। আমরা প্রকৃতির নিয়ামতগুলো ভোগ করছি সত্যি কিন্তু এই আমরাই আবার অকৃতজ্ঞের মতো নির্বিচারে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে ধ্বংস করছি। প্রকৃতি আমাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অকৃত্রিমভাবে আলো-বাতাস, নদী-নালা, খাল-বিল পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল দান করেছে। প্রকৃতি আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দু’হাত উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা হিংস্র হায়েনার মতো নিজেদের ভোগ-বিলাসের জন্য তা ধ্বংস করে দিচ্ছি। আমরা একবারও ভেবে দেখছি না যে, প্রকৃতির ক্ষতি করলে প্রকৃতি চুপচাপ বসে নাও থাকতে পারে। প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে দিতে পারে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলার চেষ্টা করছেন যে, কোভিড-১৯ প্রকৃতির প্রতিশোধ।
সৃষ্টির উষালগ্নে গোটা বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও মনোমুগ্ধকর। আর এই মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পৃথিবীতে নেমে আসে বিপর্যয়। আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কথা। আমরা পাহাড়-পর্বত কেটে ইট ভাটা তৈরি করেছি। নদী ও খাল-বিল দখল বা ভরাট করে নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য অট্টালিকা তৈরি করেছি। কারখানার দূষিত বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালুসহ দেশের অসংখ্য নদীর পানিকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলেছি। ভাওয়ালের বনসহ দেশের অজস্র বন উজাড় করে কারখানা তৈরি করেছি। গণদাবিকে উপেক্ষা করে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে প্রকৃতির প্রাচীর সুন্দরনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছি। অথচ, এই সুন্দরবনই বারবার সকল সামুদ্রিক ঝড়-সাইক্লোনে বুক চিতিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে। আজ মানুষ্য অত্যাচারে বিপন্ন সেই সুন্দরবন। অপরিকল্পিত নগরায়ন করতে গিয়ে উজাড় করে ফেলেছি ফসলের জমি। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় দূষিত বায়ু। শহুরে জীবনে শব্দ দূষণের মাত্রা পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। শিল্প-কারখানার কালো ধূয়া বিষাক্ত করে তুলছে জীবন বাঁচানোর জন্য গ্রহণ করা বায়ুকে। অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, জীববৈচিত্র্য ও জীবজন্তু নিধন করার কারণে বিশ্ব পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। যে জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি আমাদের জন্য সেই প্রকৃতিকেই আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করছি। প্রকৃতি অত্যাচারিত হতে হতে আজ মনে হয় নিজেই প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নিতে শুরু করে দিয়েছে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আমরা সবুজ-শ্যামল গ্রামকে বানিয়েছি এক একটি বিবর্ণ বস্তি, যেখানে নেই সবুজের সমারোহ। অনুপস্থিত পাখিদের কলতান। বড় বড় শহরকে বানিয়েছি ইট-পাথরের একেকটি জঙ্গল। যে জঙ্গলে জন্ম নেয় ডেঙ্গুর লার্ভা। এদিকে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত গলে যাচ্ছে বরফ। বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগরে তলিয়ে যাবার ঝুঁকিতে রয়েছে সাগরতীরবর্তী অঞ্চলসমূহ। শিল্পায়নের কারণে বাতাসে কার্বনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অক্সিজেন খ্যাত অ্যামাজন বন আজ রুগ্ন।
সুতরাং, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিশ্বজলবায়ুর বিপর্যয় রোধ করা এবং পরিবেশ টিকিয়ে রাখা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্পপথ খোলা নেই। দিনের পর দিন মানুষ্যসৃষ্ট অত্যাচার-অবিচারের কারণে নদীগুলো হয় মরে গেছে, নয় তো দখলে তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। একরে পর এক বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশের জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ ধ্বংস করলেও তা বাঁচানোর দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারিনি। আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি বসবাসের অযোগ্য এক ধরিত্রী। আসুন, পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাই, এক টুকরো সবুজের ছোঁয়া দেই আমাদের সন্তানদের। গ্রামকে ফিরিয়ে নিয়ে যাই গ্রামের আদলে। ইট-পাথরে গড়া বিবর্ণ শহরগুলোকে গড়ে তুলি বসবাসযোগ্য একেকটি সবুজ নগরে, যেখানে থাকবে অগনিত গাছ, কার্বনমুক্ত নির্মল বায়ু।
কেউ কেউ আবার করোনাকে প্রকৃতির আশীর্বাদ হিসেবে দেখছে। করোনায় রং বদলিছে প্রকৃতি। বহুদিন পর কক্সবাজার সমুদ্রের লোনাজলে ডলফিন জলকেলি করছে। সৈকতের তপ্ত বালুতে লাল কাঁকড়া দলবেঁধে দৌড়াচ্ছে। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পাখিদের কলতান বৃদ্ধি পেয়েছে। শব্দদূষণ কমে গেছে। বায়ুদূষণ নাই বললেই চলে। ঢাকার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে বুক আর ভারি হয়ে উঠে না। রাস্তা ঘাটে কোলাহল কমেছে। প্রকৃতি ছেয়ে গেছে সবুজে। আসুন, আমরা পরিবেশ বাঁচাই, বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এটা কোনো শ্লোগান নয়, সময়ের দাবি।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।