Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দায়ভার নিতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর পিক বা শীর্ষ অবস্থান কবে হবে তা এখনো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের একটি বক্তব্য যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞমহলের বক্তব্যের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছিল তা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেশ চটে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন এখনো ট্রায়ালে আছে। কোনো মহল থেকে আশাবাদী বক্তব্য দেয়া হলে এসব ট্রায়ালের ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। আর যদি ট্রায়াল শেষে কোন একটি ভ্যাকসিন প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখেও তাতেও বাংলাদেশের মত দেশে ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, বিশৃঙ্খলা ও ব্যর্থতার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। আপাতত: সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আমরা যদি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কথিত ‘কান্ডজ্ঞানহীন’ বক্তব্যটির সারমর্ম অনুধাবন করতে যাই তাহলে দেখা যাবে, তার এই বক্তব্যটির সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া যাই হোক, এ কথা উড়িয়ে দেয়া সমীচীন নয়। তিনি বলেছেন, দু’তিন মাসে করোনার প্রকোপ থামছে না, একবছর থেকে দু’তিন বছরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন সিডিসি থেকেও ইতিমধ্যে অনুরূপ বক্তব্য এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইচ্ছা ও পরিকল্পনার মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যাওয়ার কারণে মাঝে মধ্যেই এসব বক্তব্য রাজনৈতিক বিতর্কের ঝড় তুলতেও দেখা গেছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশব্যাপী শাটডাউন-লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে অনীহা ও গরিমসি, কোভিড-১৯ ভাইরাস ইনফেকশন চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার থেকে শুরু করে সর্বশেষ ভ্যাকসিন ছাড়াই করোনা ভাইরাস নির্মূলের আশাবাদ পর্যন্ত কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ট্রাম্পের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও বক্তব্যের বাস্তব সত্য ও সায়েন্টিফিক ফ্যাক্টের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান লক্ষ্য করা গেছে। শুধুমাত্র হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করোনা ফাটালিটি থামিয়ে দেয়া ট্রাম্পের আশাবাদ এরই মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন ওষুধ প্রশাসন নাকচ করে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ওষুধের ট্রায়াল বন্ধের নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানেই থাক, মহামারীর সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি ও স্থায়ীত্বের প্রশ্নের সাথে চলমান বিশ্ববাস্তবতা ও সায়েন্টিফিক ফ্যাক্ট জড়িত। কোনো রাজনৈতিক চাপে এ ফ্যাক্টকে সাময়িক ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে পরিত্রাণের সুযোগ নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে করোনা মহামারীর অফিসিয়াল আপডেট প্রচার করছে। সারাবিশ্বে, দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলাদেশে গত ২৪ ঘন্টায় কজনের করোনা টেস্ট হলো, কতজন নতুন আক্রান্ত হলো, কতজন মারা গেল, আর কতজন সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরল, কতজন কোয়ারেন্টাইনে-আইসোলেশনে থাকছেন, মৃতদের মধ্যে কতজনের বয়েস কত, নারী-পুরুষের সংখ্যা ইত্যাদি সব তথ্যই দেয়া হচ্ছে প্রেস ব্রিফিংয়ে। তবে দেশের করোনা রোগীরা কিভাবে মারা গেলেন তারা অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর বা আইসিইউ সুবিধা পেয়েছিলেন কিনা, হাসপাতালগুলোতে কত সংখ্যক বেড, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর সুবিধা কয়টি থেকে থেকে কয়টিতে উন্নীত হল, কোন হাসপাতালে কয়টা খালি আছে ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিনে প্রকাশ করা হয়না। হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে এখনো প্রতিদিনই রোগী মারা যাচ্ছে। অথচ দেড়মাস আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রজ্ঞাপনে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকে রোগী ফেরত না দেয়ার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছিল। কোনো বেসরকারি হাসপাতাল রোগীর চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত দিলে তার লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। বলাবাহুল্য, এখনো প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে অসংখ্য রোগীকে ফেরত দেয়া হচ্ছে, এভাবে অনেক মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও গত একমাসে একটি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজেদের জারি করা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছেনা,হাসপাতালগুলোতে হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরণের মুমূর্ষু রোগীদের ফেরত দেয়ার কারণে রোগী মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন। জনস্বার্থে জারি করা নিজেদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে আদালত ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের প্রতি ৭৮ দফা নির্দেশনাসহ রুল জারি করেছেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে দেয়া রুলে হাসপাতাল থেকে ফেরত দেয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু হলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে বলে জানিয়েছে। সম্ভবত হাসপাতালের বেড, আইসিইউ সুবিধাসহ জরুরী সুযোগ সুবিধার হালনাগাদ তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিদিনের বুলেটিনে প্রকাশের নির্দেশনাও দিয়েছে আদালত। সাধারণ রোগীদের হয়রানি ও বিড়ম্বনা লাঘব করে মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এ ধরনের পদক্ষেপ স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রনালয়কে স্বতঃস্ফর্তভাবে নেয়াই ছিল সঙ্গত। তবে আদালতের নির্দেশনার পরও এ বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা পরিবর্তন দেখা যায়নি।

জাতীয় নির্বাচন, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীর সময়ে কোনো দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। চলমান করোনা মহামারীতে মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার মানদন্ড থেকে বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান, সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের মানদন্ড নির্ধারিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের একনম্বর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চায়না, কিউবা, ভিয়েতনাম, রাশিয়া এমনকি ইরান থেকেও পেছনে পড়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অংশীদার ভারতের অবস্থান তার প্রতিবেশি পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান বা শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ থেকেও পিছিয়ে। তবে ভুল সিদ্ধান্ত ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের হ-য-ব-র-ল অবস্থার কারণে করোনা মহামারী মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। গত এক দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কৃষিখাতের অগ্রগতির হাত ধরে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কৃতিত্ব প্রচার করেছে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, নাগরিকদের গড় আয়ুবৃদ্ধি ও সামাজিক ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি বিশ্বসংস্থার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতির কয়েকটি সূচক প্রতিবেশী দেশগুলোকে টেক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিল। এখন করোনা মহামারী মোকাবেলা করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন, সুশাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও জননিরাপত্তার ইস্যুগুলো বিশ্বের সামনে উন্মেচিত হয়ে পড়ছে। প্রায় ৪০ শতাংশ ঘাটতি নিয়ে আগামী অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মোটেও অর্থনৈতিকভাবে শক্তি-সামর্থ্যের পরিচয় বহন করছে না। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলায় সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক খাতের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যে প্রকৃতি ধরা পড়ছে তা সবার জন্যই হতাশাজনক।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও গার্মেন্ট রফতানি খাতের মাধ্যমে অর্জিত রেমিটেন্সের টাকাগুলো যদি সঠিক বিনিয়োগের কাজে লাগানো যেত, তাহলে বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণের জন্য হাত পাততে হতো না। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা অনস্বীকার্য। দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার দেড়মাস পর জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এরপর আরো প্রায় ২ মাস অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো যেখানে প্রতিদিন অর্ধলক্ষ থেকে লক্ষাধিক মানুষের করোনা টেস্ট করছে, সেখানে ১৮ কোটি মানুষের দেশে সাড়ে তিনমাস পরেও করোনা টেস্টের সংখ্যা ১৪-১৫ হাজারেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে দ্রুত টেস্ট সংখ্যা বৃদ্ধি, সংক্রমণ ট্রেসিং ও আইসোলেশনের মাধ্যমে কমিয়ে আনার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকার টেস্ট সীমিত রেখে মহামারী নিয়ন্ত্রণের অবাস্তব পন্থা অবলম্বন করছে। করোনা টেস্ট সুলভ, সহজ ও গতিশীল করতে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র নিজস্ব গবেষণাগারে র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের মাধ্যমে একটি মাইলফলক কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হলেও এ সাফল্যকে কাজে লাগাতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা এখনো অস্বচ্ছ ও রহস্যজনক। প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি বা লক্ষাধিক টেস্টের মাধ্যমে সামাজিক সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব ছিল। একটি বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলায় এ ধরণের উদ্যোগে সরকারের অনিচ্ছা বা অনীহার কোনো সংগত কারণ থাকতে পারে না। এর বাইরে আমরা ধরে নিতে পারি আমদানিকৃত টেস্টিং কিটের স্বল্পতার কারণে সরকার পর্যাপ্ত টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারছে না। তাহলে পাল্টা প্রশ্ন আসে, দেশীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত র‌্যাপিড ডট ব্লট টেস্টিং ক্যাপাসিটি কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন? অনেকে মনে করছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই তার প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত কিট নিয়ে টালবাহানা চলছে !

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক পেন্ডেমিকে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি ও শিল্পোন্নত বিশ্বের দেশগুলো যখন পর্যুদস্তু হয়ে পড়েছে তখন বাংলাদেশ একের পর এক আত্মনির্ভরশীলতার সিঁড়ি গড়ে তোলার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদন ও রফতানি থেকে শুরু করে আইভারমেকটিন, রেমডিসিভির, ডেক্সামেথাসন, গণস্বাস্থ্যের র‌্যাপিড ডটব্লট কিট, ভেন্টিলেটর উৎপাদনে ওয়ালটন ও মিনিস্টার ইলেকট্রিক কোম্পানীর মার্কিন উৎপাদকদের অনুমোদন লাভ, দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে উন্নতমানের পিপিই তৈরীসহ কোভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক প্রকার স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও দেশের কোটি মানুষ এই কোভিড মহামারীর সামনে চরম অসহায়ত্ব ও হতাশায় ভুগছে কেন? এই প্রশ্নের জবাব এই নিবন্ধের শুরুতেই আছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের বিড়ম্বনা, হয়রানি, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু এই সময়টাকে আতঙ্ক ও বিভীষিকাময় করে তুলেছে। এর স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উপরই বর্তায়। এটা কোনো রাজনৈতিক ব্লেইম গেমের বিষয় নয়, সরকার বিরোধ রাজনৈতিক দলের গতানুগতিক বক্তব্য শুধু নয়। একটি বৈশ্বিক মহামারীর সময়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার বাস্তবতা সরকার ও রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতাকে নির্দেশ করছে। সরকারের সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন করোনায় চিকিৎসক মত্যুর দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বলে অভিযোগ তুলে করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসকদের চিকিৎসার জন্য মানসম্পন্ন হাসপাতাল নির্ধারণের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ৭২ ঘন্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। গত শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জািেহদ মালেকের কাছে লেখা চিঠিতে করোনায় শত শত ডাক্তারের সংক্রমিত হওয়ার জন্য মানহীন পিপিই, মাস্ক, জোড়াতালি দিয়ে অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরী করা আইসিই¦উ, অপর্যাপ্ত ট্রেনিং ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ডাক্তারও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ডাক্তার মোস্তফা জালাল মহিউদ্দেনের নেতৃত্বাধীন বিএমএ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসকদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ করার দাবী করেছেন, অন্যথায় ৭২ ঘন্টা পর উদ্ভুত পরিস্থিতির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর দায়ী থাকবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।

করোনায় আক্রান্ত সরকারের মন্ত্রী,এমপি-আমলা ও শিল্পপতিদের জন্য সিএমএইচসহ সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবার দুয়ার খুলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরাও এখন বিশেষ ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছেন। চিকিৎসার মত মৌলিক দাবির অধিকার সব মানুষেরই আছে। তবে যারা গত ১২ বছরে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছেন, যারা হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, ওষুধ ও পর্দা কিনতে গিয়ে শতগুণ বেশি মূল্য দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন এখন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ভগ্নপ্রায়, অবশিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার প্রায় সবটা তাদের জন্যই যেন রির্জাভ রাখা হচ্ছে। যেখানে হাজার হাজার করোনা রোগী হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে বাড়িতে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুকেই নিয়তি মেনে নিয়ে সময়কে অভিসম্পাত করছেন, তখন দেশের সর্বোচ্চ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজার শয্যার বিপরীতে মাত্র ১৩০ জন রোগীকে সেবা দেয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। এমন এক বৈশ্বিক মহামারীর বাস্তবতায় ২ হাজার শয্যার হাসপাতালে দ্বিগুণ রোগীর সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল মানুষের সাধারণ প্রত্যাশা। সেখানে সংক্রমণের ভয়ে শত শত সরকারি ডাক্তারের বিশেষায়িত হাসপাতালকে রোগীশূন্য করে রাখা হয়েছে। এ যেন যুদ্ধের ভয়ে মাঠ থেকে পলায়নের মত ঘটনা। কোভিডের ভয়ে বিনা চিকিৎসায় সব ধরণের সাধারণ রোগী মারা যাচ্ছে। মানহীন পিপিই, মাস্ক ও অনিরাপদ আইসিইউর জন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যাপক সংক্রমণের শিকার হলেও এই কোভিডের সময়েই শুধু নয়, বছরের পর বছর ধরে যাদের দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে দেশের স্বাস্থ্য সেবায় এমন বিপর্যয় সংঘটিত হল তারা যেন সব সময়ই হিসাব নিকাশ, জবাবদিহিতা ও বিচারের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

দু দিন আগে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক খবরে জানা যায় ৬ কোটি ডলারের চিকিৎসা সামগ্রী কেনায় কথিত দুর্নীতির অভিযোগে জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে সে দেশের পুলিশ। অতীতে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের টাকা কোথায় কিভাবে খরচ হয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে সরকার বা দুদকের তেমন আগ্রহ না থাকলেও বাজারে অনেক গুজব চাউর আছে। সাবেক মন্ত্রী-আমলাদের পোষ্য ও পত্নীদের নামে কোথায় কত শত কোটি টাকা ও সম্পদ জমা হয়েছে তার হিসাবও মাঝে মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। সেসব কথা বাদ দিলেও এই কোভিড-মহামারী মোকাবেলার জন্য পিপিই, মাস্কসহ নানাবিধ সামগ্রী কিনতে যে ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল তা কিভাবে খরচ হয়েছে তার ফিরিস্তিও এখন পাওয়া যাচ্ছে। আলোচিত-বিতর্কিত কনস্ট্রাকশন কোম্পানীকে চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের টেন্ডার দেয়ার পরের ইতিহাস বড়ই বেদনাদায়ক। হাজার হাজার ডাক্তার ওস্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হওয়ার পেছনে সেসব মানহীন পিপিই, মাস্ক এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা। ভালভাবে কোভিড মোকাবেলা করতে না পারার কারণে ভিনদেশে মন্ত্রীর পদত্যাগ ও আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটেছে। জিম্বাবুয়েতে এখনো ১০ জন করোনা রোগীও মারা যায়নি, সেখানে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর আমাদের দেশে ৯০০ কোটি টাকায় নিম্নমানের পিপিই. মাস্ক ও সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে শত শত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ সদস্যসহ শত শত সম্মুখ সারির করোনা যোদ্ধা নিহত হওয়ার পরও অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারার নজির দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের জীবন-মৃত্যুর ফ্যাক্টগুলোকে রাজনৈতিক চালবাজি দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার অমানবিক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যুর-দায়ভার
আরও পড়ুন