পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে বিশ্বব্যাপী যে স্থবিরতা নেমে এসেছে নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার বড় প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়, বরং উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের বড় বড় উৎপাদন ও কর্মমুখী সেক্টরগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা, উৎপাদন ব্যহত হওয়া এবং অনেক রপ্তানি অর্ডার বাতিল হওয়ায় দেশীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন সেক্টরের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এসব প্রণোদনা কতটুকু কাজে লাগবে তা এখনি বলা যায় না।
এরকম এক সংকটময় পরিস্থিতিতে আগামী ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যান্য বছরের চাইতে বাজেটের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতি পূরণ ও দেশের উন্নয়ন গতিশীল রাখাই হবে সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, ক্ষতিকর দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে সরকার কিছু পণ্যের ওপর কর আরোপ ও কর বৃদ্ধি করে থাকে। ‘তামাক’ এর মধ্যে অন্যতম। তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদ্ধতিগুলোর মধ্যে মূল্য ও কর বৃদ্ধি অন্যতম। বিশ্বের অনেক দেশ উক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে তামাক নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে।
এবারের বাজেটে তামাক পণ্যের মূল্য বা কর হার আশানুরূপ বাড়েনি, বরং আয় বেড়ে যাওয়ায় সিগারেটের প্রকৃত মূল্য কমে গেছে। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কার্যকর ‘সুনির্দিষ্ট কর’ আরোপই করা হয়নি। সিগারেটের ৪টি স্তরই বহাল রাখা হয়েছে। সিগারেটের বাজারে নিম্নস্তরের একক আধিপত্য যা মোট বাজারের ৭২%। তারপরও এই স্তরে সম্পূরক শুল্ক মাত্র ৫৫% এর স্থলে বাড়িয়ে ৫৭% করার প্রস্তাব এসেছে। হিসাব মতে, নিম্নস্তরের ১০ শলাকার সিগারেট ক্রয়ে অতিরিক্ত মাত্র ২ টাকা ব্যয় করতে হবে ভোক্তাদের। প্রতি শলাকায় যা মাত্র ২০ পয়সা। মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম ৩টি স্তরেই সম্পূরক শুল্ক একই (৬৫%) রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। উচ্চস্তর ও প্রিমিয়াম স্তরে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৪ ও ৫ টাকা। কর না বাড়িয়ে প্রিমিয়াম স্তরে মূল্যস্তর বাড়ানোতে বরাবরের মতো তামাক কোম্পানিই বেশি লাভবান হবে। কেননা এ মূল্য বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফিতী ও জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর জন্য তামাক পণ্যে কোন সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা হয়নি। এটি বাস্তবায়ন হলে সিগারেট সেবনের হার বাড়বে (বিশেষত তরুণদের মধ্যে)। গ্যাটস-২০১৭ এর তথ্যে প্রতীয়মান হয়েছে, ২০০৯ এর পরে ২০১৭ সালের গ্যাটস অনুযায়ী প্রায় ১৫ লাখ সিগারেট সেবনকারীর সংখ্যা বেড়েছে। বলা যায়, ধোঁয়াবিহীন তামাকের মূল্য ও কর বৃদ্ধি কিছুটা সন্তোজনক হলেও বিড়ি ও সিগারেটের কর বৃদ্ধির প্রস্তাবনা অত্যন্ত হতাশাজনক। কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর জন্য এ যেন বরাবরের মতই শুভংকরের ফাঁকি। সিগারেটের বিদ্যমান ৪টি স্তর রেখে জটিল ও স্তরভিত্তিক এই কর কাঠামোর মাধ্যমে বাজেটে সিগারেটের যে পরিমাণ মূল্য বা কর বাড়ানো হয় এতে সরকারের চাইতে তামাক কোম্পানিগুলো বেশি লাভবান হয়।
পৃথিবীর অন্যতম সস্তামূল্যের তামাক পণ্যের বাজার ‘বাংলাদেশ’। কম মূল্যের কারণে দেশে তামাকের ভোক্তাও বেশি। ১৫ বছর ও তদূর্ধ্বদের মধ্যে পরিচালিত গ্লােবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো-২০১৭ এর তথ্যানুসারে, দেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫.৩%) মানুষ বিভিন্ন উপায়ে তামাক সেবন করে। দেখা যায়, দরিদ্রদের মধ্যে তামাক সেবনের হার বেশি। বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি তামাক সেবনকারী দেশের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যুহার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চাইতে বাংলাদেশে অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল-এফসিটিসি’র ‘আর্টিকেল-৬’ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘এমপাওয়ার প্যাকেজে’ তামাকের উপর কর বৃদ্ধির প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের সময় তামাক কোম্পানিগুলো তামাকজাত পণ্যের উপর কর বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করতে তৎপর হয়ে ওঠে। তামাক পণ্যের জটিল স্তরভিত্তিক ও অকার্যকর কর ব্যবস্থা বাংলাদেশসহ বিশ্বের মাত্র ৬টি দেশে প্রচলিত রয়েছে। এ পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায়ের ফলে অর্জিত করের একটি অংশ তামাক কোম্পানি পায়। প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। বিশাল বাজার বিবেচনায় বিভিন্ন তামাক কোম্পানিগুলো বৈদেশিক বিনিয়োগের নামে বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ ‘জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল’।
জটিল স্তরভিত্তিক ও এডভ্যালুরাম পদ্ধতি বিলুপ্ত করে ২ স্তরের কর ব্যবস্থা এবং সকল তামাকজাত দ্রব্যের উপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা দরকার। বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি’র তথ্যমতে, সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪ হাজার ১০০ কোটি থেকে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বেশি রাজস্ব আয় হতে পারে। যার হার বিড়ি ও সিগারেট থেকে প্রাপ্ত বর্তমান রাজস্বের চেয়ে অন্তত ১৪% বেশি। এ অর্থ করোনা ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতি রোধে ব্যয় করা যেতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর গবেষণা গ্রন্থেও তামাকজাত দ্রব্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সকল জর্দা, গুল ও বিড়ি কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় এনে কর ফাঁকি রোধে সরকারের উচিৎ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিড়ি, জর্দা, গুল, সাদাপাতাসহ অন্যান্য তামাক পণ্যের ষ্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং খুচরা তামাক পণ্য বিক্রয় বন্ধ করতে পারলে তা আরো ফলপ্রসু হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে আসন্ন বাজেটের প্রস্তাবিত তামাক কর ও মূল্যবৃদ্ধি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হলে ৬ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। বিশাল অঙ্কের (সব মিলিয়ে অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা) অতিরিক্ত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি পূন:বিবেচনা করতে পারেন।
এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারীর সাথে তামাক সেবনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে, ধূমপায়ীদের করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি! ইতোমধ্যে চীন, ইতালি, ফ্রান্সে করোনা সংক্রমণে মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই ধূমপায়ী ছিলো বলে গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে। বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে উচ্চমাত্রায় তামাক সেবনের হার বিদ্যমান। এর মধ্যে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৯২ লাখ (১৮%) ধূমপান করে। সুতরাং, চলমান করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে দেশের কয়েক কোটি মানুষকে উচ্চমাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা জরুরী। তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট কর আরোপে এ ধূমপানের হার কমিয়ে আনা সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা হলে প্রায় ২০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হবে।
বিড়ি কর বৃদ্ধির প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। প্রতি শলাকা বিড়িতে (ফিল্টারবিহীন) গড়ে ১৬ পয়সা বাড়িয়ে ২৫ শলাকা বিড়ি ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করা হয়েছে। আরেকটি নিন্দনীয় দিক হলো বিড়ির সম্পূরক শুল্ক বিগত ৪ বছর ধরে ৩০% রয়েছে এবছরও তাই বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে ক্ষতিকর নেশাদ্রব্য থেকে দুরে রাখতে বিড়ির মূল্য ও উচ্চ কর অপরিহার্য ছিলো। বিড়ি ফ্যাক্টরি মালিকরা বিড়ি কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা নিয়েও মিথ্যাচার করে আসছে। বিড়ি কারখানায় ২০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত বলে দাবি করলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর তথ্যমতে, এর প্রকৃত সংখ্যা মূলত ৪৬ হাজারের কিছু বেশি।
তামাক কোম্পানিতে প্রায় ১০% সরকারী শেয়ারের কারণে সরকারের সচিব পর্যায়ের ৬জন কর্মকর্তাকে বিএটিবি’র পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে বিধায় কর বৃদ্ধিসহ তামাক ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন নীতিতে তামাক কোম্পানির অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা দুরহ হয়ে পড়ছে। এ থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তামাক খাতের রাজস্ব নিয়ে একটি প্রচলিত ‘মিথ’ রয়েছে। বলতে শোনা যায়, তামাক খাত হতে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করে। উপরন্তু, তামাকজনিত স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সকল ক্ষয়-ক্ষতিকে ছাপিয়ে তামাক কোম্পানি প্রদত্ত রাজস্বকে বড় করে দেখার প্রবণতা খোদ সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলেই লক্ষ্য করা যায়। আসল বিষয় হলো, তামাক কোম্পানি প্রদত্ত রাজস্বের ৯০ ভাগের বেশি জনগণের দেয়া ভ্যাট। এসব অর্থের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক মুনাফার সামান্য কিছু অংশ প্রদানের নাম করে পুরোটাই নিজেদের প্রদেয় ট্যাক্স বলে চালিয়ে দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি পরিচালিত গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক খাত হতে প্রাপ্ত ২২,৮১০ কোটি টাকার রাজস্বের বিপরীতে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় ৩০,৫৭০ হাজার কোটি টাকা।
তামাকের ভয়াবহতা, তামাকজনিত রোগব্যাধি ও মৃত্যু কমিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এবং একটি শক্তিশালী তামাক কর নীতি প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও তামাকের বহুমাত্রিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা নি:সন্দেহে প্রসংশনীয়। কিন্তু মানুষকে তামাকের নেশা আসক্ত করার মাধ্যমে রোগব্যাধি ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে মুনাফা অর্জনই তামাক কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য। চলতি বাজেটে তামাক পণ্যের কর বৃদ্ধিতে তামাক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা নয় বরং, কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে প্রস্তাবিত বাজেটে সংশোধনী এনে সকল প্রকার তামাকের ওপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপ, প্রয়োজনে অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপ করা হোক। এতে তামাকজনিত ক্ষয়-ক্ষতি কমে আসবে। ক্রমান্বয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। আগামী প্রজন্ম তামাকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।