পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ ২১ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। বিশ্বের অনেক দেশে আজ ঘটা করে পালন করা হচ্ছে বাবা দিবস। জুন মাসের তৃতীয় রবিবার এই দিনটি পালন করা হয়। এ দিনটিতে বাবাদের নানাভাবে শুভেচ্ছা জানানো বা স্মরণ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের অনেক ব্যবহারকারী তাদের বাবাকে নিয়ে মন্তব্য করেন, ছবি শেয়ার করেন। আমিও স্মৃতি কাতর হয়ে বাবাকে স্মরণ করে ছবি পোস্ট দিই। কিন্তু কীভাবে বাবা দিবসটির প্রচলন হলো? মা দিবস কয়েকশ’ বছর ধরে পালন করা হচ্ছে, কিন্তু সেই তুলনায় বাবা দিবসটি অনেক নতুন। আমি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি বা গণমাধ্যমে কাজ করেছি। কিন্তু এর আগে বাবা দিবসে বা কখনো বাবাকে নিয়ে কোনো লেখাই লেখা হয়নি। মহামারীর এ সময়ে মনের মধ্যে কতো কিছু দোল দিয়ে যাচ্ছে, যা এ জীবনে কল্পনাতেও আসেনি। গত কিছুদিন আগে লকডাউনের মধ্যে প্রথমবার আমাদের বাবার কিছু ছবি পোস্ট দিয়েছিলাম।
আজ অনেকেই হয়তো তাদের বাবাকে নিয়ে তাদের জীবনের সেরা স্মৃতিগুলো রোমান্থন করবেন। তবে বাবাকে নিয়ে আমার বা আমাদের ভাই-বোনদের স্মৃতি খুব বেশি নেই। আমিও এখন বাবা হয়েছি। বাবা হিসেবে আমিও বুঝতে পারি, সন্তান কতো আবেগের জায়গা। তাইতো বলা হয়, ‘বাবার ছায়া শেষ বিকেলের বট গাছের ছায়ার চাইতেও বড়। সে তার সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন।’ আমাদের প্রত্যেক ভাই-বোনের সন্তান হয়েছে। তারাও সবাই পিতা-মাতা হয়েছে। আমাদের বাবা খুব আবেগী ছিলেন না বটে। তবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিলো না। আমাদের পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আমরা বড় তিন জনের স্মৃতিতে তিনি এখনো ভাস্বর। আমার ছোট ভাই ইলিয়াস বিন কাশেম ও ফারহানার সাথে তার স্মৃতির কথা খুব মনে করতে পারে না তারা। আমার বোনটা তখন খুবই ছোট, যখন আব্বা মারা যান। সে খুব আবেগি হয়ে যায় যখন আব্বাকে নিয়ে আমরা কথা বলি। তবে তাকে নিয়ে আমাদের সব ভাই-বোনের মধ্যে রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা ও গর্বের একটি জায়গা। তিনি ছিলেন এ দেশ মাতৃকার একজন গর্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। খুব ছোট বেলাতেও খুব বেশি কাছে পাইনি তাকে। ১৯৯০ এর পরে অবশ্য পুরো জীবনটাই বাবাকে ছাড়াই পার করে দিলাম। প্রবাদে পড়েছি, ‘বাবার পা কি অন্য সবার চেয়ে অনেক দ্রæত চলে? নইলে এতোটা পথ এত অল্প সময়ে কি করে এত শক্ত করে সব কিছু আগলে রাখেন বাবা।’ আমরা খুব বেশি সময় বাবাকে কাছে পাইনি। তবে আমাদের মা এক হাতেই বাবার সব অভাবই পূরণ করেছেন।
আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা মো. আবুল কাশেম ছিলেন অনেকটা সংসার বিরাগী মানুষ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মকালীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের করাচি থেকে দেশ মাতৃকার ক্রান্তিলগ্নে দেশে এসে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্থানীয়দের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। আমার ফুপাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় কমান্ডার মোহসীন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনি আমার বাবার গল্প। কীভাবে ১৯৭১ সালে পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশে এসেছিলেন, আর একজন সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে কী করেছিলেন। তিনি ২ নম্বর সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মোহসীন ভাইয়ের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনা শুনি। ছোট বেলার পর সোনারগাঁওয়ে আর যাওয়া হয়নি। তবে জীবনের এইবেলায় আবার কেন জানি বাবার জন্মভূমিতে আমাদের ভাই-বোনদের টেনে নিয়ে গেছে। পিতার সন্তান হিসেবে আমরা আমাদের পিতার জন্মভূমিতে বসবাস শুরু করবো। এ কারণেই হয়তো বাবাকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা চলে আসছে। আমাদের বাবাই ওই এলাকার তৎকালীন সময়ে প্রথম স্নাতক ও এমএ পাশ মানুষ। সে সময়ে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাবল এমএ করেন। তবে আমার কাছে বাবার থেকে শোনা একটি ঘটনা বেশি অনুপ্রেরণার। বাবা ছিলেন তখন করাচিতে পোস্টিং। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে দেশের খবর রাখতেন রেডিওতে। ২৬ মার্চের পরে অবশ্য বন্দি ক্যাম্পে রাখা হয়েছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের। বাবার কাছ থেকে শোনা, পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমারা ম্যাসগুলোতে বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের জিনিসপত্র লুটপাট করে নিতে থাকে। আব্বার তখনকার আমলের দুটি বড় ট্রাঙ্ক লুটে সব নিয়ে যায় পশ্চিমারা। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে আব্বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসেন এবং দেশ মাতৃকার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেন। আমার বাবাকে কখনো দেখিনি কারও সাথে বীরত্ব দেখাতে। সংসার বৈরাগ্যের কারণে যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, আমাদের নিয়ে তার ভাবনা ছিল না বললেই চলে। আমার বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের কাজিরগাঁও গ্রামে। ১৯৯০ সালে বাবা আবুল কাশেম মৃত্যুবরণ করলে আমার মা আমাদের সব ভাই-বোনকে নিয়ে যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামে নিয়ে আসেন। কেশবপুর উপজেলা শহরে আমার নানার বাড়ি আছে। ‘বাবার চোখ দেখতে পায় কল্পনার অতীত কোন দুরন্ত। তাই তিনি সব সময় শঙ্কিত থাকেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।’
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমাদের অনেক গর্ব হয়। তার সন্তান হিসেবে আমরা আমাদের জায়গা থেকে দেশ মাতৃকার সেবা করে যাচ্ছি সকলেই যার যার অবস্থান থেকে। আমরা পাঁচ ভাই-বোনই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তবে বাবার পরিচয়ে আমরা রাষ্ট্রের কোনো পর্যায় থেকেই কখনো কোনো সুবিধা নেইনি, এটা হলফ করে বলতে পারি। তারপরও মনে প্রশ্ন জাগে, ‘বাবার কাঁধটা কি অন্য সবার চেয়ে বেশি চওড়া? তা না হলে কী করে সমাজ সংসারের এত দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়ান বাবা?’
লেখক: কবি ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।