Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোথায় মিলবে চিকিৎসা?

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০২০, ১২:০৩ এএম

কোথায় গেলে মিলবে ডাক্তার ও চিকিৎসা? দেশের মানুষের কাছে বর্তমানে এটি এখন একটি জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। রোগ যাই হোক, যে রোগী বয়সেরই হোক, দুর্দশা চরমে। কোভিড-১৯ রোগী নন, অথচ তারাও সুচিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন বলে তাদের স্বজনরা গণমাধ্যমের কাছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করছেন। এ ধরনের খবরে দেশবাসী গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও অদক্ষতা ফুটে উঠে। বিশেষ করে বিত্তহীন মানুষ সরকারি হাসপাতালে যতটুকুই চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন, তাদের জন্য খুবই খারাপ সময় যাচ্ছে। চিকিৎসাসেবার এ অবস্থায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে মানুষ। তারা চিকিৎসার জন্য যাবেন কোথায়?
সেবা পেতে রোগীদের ভোগান্তি, হয়রানি, সেবা না পাওয়া, লাগামহীন সেবামূল্য আদায়, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নজরদারির অভাব ইত্যাদি সমস্যা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নিত্যদিনকার চিত্র হলেও কার্যত কোনো ক্ষেত্রেই মন্ত্রণালয় সফল হয়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে করোনার চেয়ে সাধারণ রোগে আক্রান্ত অনেক বেশি মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারে। করোনা আতঙ্কের সাথে যদি সাধারণ চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয় তবে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমরা মনে করি, করোনার চিকিৎসার সাথে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম চলমান রাখাসহ যে কোনো মূল্যে সাধারণ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। একদিকে করোনা আতঙ্ক, অন্যদিকে যদি অন্য জটিল রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন, তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, এই পরিস্থিতি কতটা ভীতিপ্রদ। সঙ্গত কারণেই এই অবস্থা আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বাত, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি, টাইফয়েড, ডায়ারিয়া, ইনফুয়েঞ্জাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছেন না। সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর চিকিৎসকের অভাবে সেবা না পেয়ে অনেক রোগী হাসপাতাল ছাড়ছেন। হাসপাতালে গিয়ে করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অনেক রোগী ঘরেই রোগ পুষছেন। সব মিলিয়ে একটি আতঙ্কজনক অবস্থা বিরাজ করছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে চিকিৎসকদের কেন এতো ভয়? বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেয়ার কারণে। করোনার কারণে অন্য রোগীরা চিকিৎসা পাবেন না, এ পরিস্থিতি মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধরা, যারা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ঠাÐা ও স্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছেন, তাদের নিয়মিতই জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সময়মতো চিকিৎসার অভাবে তারা প্রাণ হারাতে পারেন। কাজেই এ অচলাবস্থার অবসান জরুরি। চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা বলে স্বীকৃত। এমন নজিরও রয়েছে, নিজের জীবন বিপন্ন করে অনেক চিকিৎসক রোগীর সেবা দিয়েছেন।

সরকার করোনা মোকাবিলায় বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন ও বিভিন্ন অংশীজনদের সাথে প্রতিনিয়ত সমন্বয় সভা করলেও রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। অধিকন্তু সেবা না পেয়ে মানুষের অসন্তোষের মাত্রা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এছাড়া করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালেই পদে পদে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অনেকেই হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এ পরিস্থিতিতে হাসপাতালবিমুখ হয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের অনেকে গোপনীয়তা রক্ষা করে হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে বাসাই থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কিডনি জটিলতায় মারা যান অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। রাজধানীর ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রিজেন্ট হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্নসহ আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও সরকারি কর্মকর্তা বাবার চিকিৎসা করাতে পারেননি মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর ১১টি হাসপাতাল ঘুরেও স্বামী আমিনুলের চিকিৎসা পাননি স্ত্রী মিনু বেগম। সর্বশেষ অ্যাম্বুলেন্সে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারা যান আমিনুল। এছাড়া ৩ ঘণ্টা হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের যুবক রিমন সাউদ। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে হার্ট অ্যাটাক করে বাবা ইয়ার হোসেনের। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ছয়টি হাসপাতালে সারাদিন ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা রেবেকা সুলতানা চৌধুরী। করোনাভাইরাস নেই, এমন নথি দেখাতে না পারাসহ নানা অজুহাতে ওই নারীকে কোনো হাসপাতালেই ভর্তি রাখা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ৯ ঘণ্টা ধরে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বিকেল ৫টায় অ্যাম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়। স্বজনরা জানান, অসুস্থ হওয়ার পর রোগী নিয়ে তারা বিআরবি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, বারডেম, ইউনিভার্সাল হাসপাতালে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার জন্য মুগদা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছিলেন। কোনো হাসপাতালেই ভর্তি কিংবা করোনার পরীক্ষা করাতে পারেননি। পান্থপথ ও গ্রিন রোডসহ রাজধানীর বেশকিছু হাসপাতালে ঘুরেও ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত শিশুকে ভর্তি করতে পারেননি কলেজ শিক্ষক পিতা। রাজধানীর যে বাসায় শিশুটি উঠেছিল, প্রতিদিন হাসপাতালে ঘোরার কথা শুনে সে বাসা থেকেও অভিযোগ আসে। ফলে বাধ্য হয়ে ২০-২২ দিন রাজধানীতে থেকে চিকিৎসা না পেয়ে শিশুকে নিয়ে টাঙ্গাইলে ফিরতে বাধ্য হন বাবা-মা। পরে শিশুটি বাসায় মারা যায়।

হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এ বিষয়টি ভাবা যায়? বলা হয়েছিল, কভিড ও নন-কভিড রোগীদের জন্য পৃথক চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে, যাতে কেউ চিকিৎসাবঞ্চিত না হয়। জরুরি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে হাসপাতাল থেকে রোগী ও তার স্বজনদের টেস্ট করানোর জন্য রেফারেন্স দেওয়া যেতে পারে। নইলে এমন রোগী নিয়ে স্বজনরা টেস্টের জন্য কোথায় দৌড়ঝাঁপ করবেন? স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে চিন্তা করা জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগী ভর্তি সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবসম্মত নয় বলে অনেকে মনে করেন। শুধু নির্দেশনা দিলেই হয় না, সেটি কার্যকরের বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িত। একটি নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে কোনো মুমূর্ষু রোগী কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত বলে যদি সন্দেহ হয়, কোনো কারণে ওই হাসপাতালে ভর্তি করানো যদি সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে রোগীকে অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের চারটি নম্বরের যে কোনোটিতে ফোন করে ওই রোগীর চিকিৎসা বা ভর্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ নিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই নির্দেশনার পরও করোনার উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। করোনা সন্দেহভাজন রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে পৃথক আইসোলেশন হাসপাতাল চালু করা যেতে পারে বলে আমরা মনে করি। প্রাথমিকভাবে রোগী সেখানে ভর্তি হবে। এরপর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হলে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে এবং করোনা নেগেটিভ হলে রোগের ধরন অনুযায়ী অন্য হাসপাতালে ভর্তি হবেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের এক গবেষণার বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানায়, জনসংখ্যার অনুপাতে আইসিইউ শয্যার সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। নেপালে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য আইসিইউ আছে ২.৮টি, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ২.৩টি, পাকিস্তানে ১.৫টি, মিয়ানমারে ১.১টি আর বাংলাদেশে আছে দশমিক ৭টি। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য একটি আইসিইউ-ও নেই। দেশের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর এই পরিস্থিতি কারোরই অজানা নয়। স¤প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি ‘একনেক’-এর সভায় প্রধানমন্ত্রী করোনা মহামারী মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দেন। এর মধ্যে একটি প্রকল্পের আওতায় দেশের সব জেলা হাসপাতালে অন্তত একটি করে পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। করোনা মহামারী দেশের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর এসব দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখন এসব দুর্বলতা দূর করতে অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ প্রয়োজন অনুসারে বাড়ানো উচিত বলে আমরা মনে করি।

মূলত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশের মানুষের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সাধারণ শিষ্টাচার মেনে চলাসহ সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। মানুষ যদি তাদের পূর্বের অভ্যাস, আচরণ ও কর্মকাÐে সক্রিয় থেকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে তা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ও সংক্রমণে সহায়ক হবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জনঅংশগ্রহণমূলক স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেবা কর্মকাÐকে নাগরিক পরিবীক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। রোগী ফেরতদানের ঘটনা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেটা সংশ্লিষ্টদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি। করোনা রোধের পাশাপাশি অন্যান্য রোগের চিকিৎসাসেবাও নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক এমনটিই কাম্য।

 



 

Show all comments
  • jack ali ১৯ জুন, ২০২০, ১২:০২ পিএম says : 0
    Our country is ruled by the Disobedient people who do not rule by the Law of Allah as such we are facing all sort of problems. Allah don't want us to go through problems but we are the problem creator.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোগ

১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন