পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা মোকাবিলায় সম্মুখ সারির যোদ্ধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সম্মুখযোদ্ধারাই আমাদের দেশে দুঃখজনকভাবে বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারাও যাচ্ছেন। গত চার-পাঁচ দিনে অন্তত পাঁচজন চিকিৎসক মারা গেছেন। বিএমএ’র হিসাবে, এ পর্যন্ত সারাদেশে করোনায় ১ হাজার ১১ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৩১ জন। বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সারাদেশে ১ হাজার ১৬০ জন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। সবমিলে করোনাযোদ্ধাদের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছেন ৩ হাজার ৫০২ জন। সংক্রমণের এ সংখ্যা বা হার বৈশ্বিক হারের চেয়ে বেশি। দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮৭ হাজার ৫২০ জন, তার ৪ শতাংশই চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। বৈশ্বিকভাবে এই হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ। শুধু আক্রান্ত নয়, মৃত্যুর দিক দিয়েও পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। বিএমএ’র মতে, গত রোববার পর্যন্ত ৩৫ জন চিকিৎসক মারা গেছেন, যার মধ্যে ২২ জনই মারা গেছেন গত দু’সপ্তাহে। দু’ সপ্তাহের মধ্যে মারা যাওয়াদের ৩ জন রাজধানীর ৩টি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ প্রধান। খবর পাওয়া গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধানও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসক ছাড়াও এ পর্যন্ত ৪ জন নার্স ও ১ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মারা গেছেন। সম্মুখ সারির করোনাযোদ্ধারাই যদি এভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেন তবে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ও হতাশা কতদূর পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। যে কোনো রোগ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায়। করোনা রোগে আক্রান্ত হলেও এর ব্যতিক্রম হওয়ায় কথা নয়। চিকিৎসকরা হলেন রোগীদের বল-ভরসা। তারাই এভাবে আক্রান্ত হলে, মারা গেলে মানুষ কোথায় যাবে?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এরকম অধিক সংখ্যায় আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে কেন? বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশের কোনো পর্যায়েই আলোচনা-পর্যালোচনা এবং গবেষণা-সমীক্ষা হয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে অভিমত এবং স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি থেকে অনুমান করা যায়, করোনার মতো বেয়াড়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধে নেমেছেন, তাদের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলেই তারা সংক্রমিত, এমন কি মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম পিপিই নিয়ে শুরুতেই কথা উঠেছিল, পরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পিপিই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে তার মান নিয়ে। ওদিকে চিকিৎসকদের জন্য পিপিই’র ব্যবস্থা হলেও নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই’র ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি। সরবরাহকৃত পিপিই’র কার্যকারিতা নিয়ে এখনো যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের অনেকের অজ্ঞতাও থাকতে পারে। এ ব্যাপারে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। অনেকে মনে করেন, পিপিই’র অকার্যকারিতা কিংবা এর ব্যবহারবিধি না জানার কারণে সংক্রমণ ঘটছে। কোভিট হাসপাতালগুলোতে দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসকদের জন্য সরকার কয়েকটি হোটেল ভাড়া নিয়েছে, যাতে তারা থাকছেন। কিন্তু নার্স বা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা হয়নি। তারা নিজেদের মতো করে হাসপাতালে আসছেন, দায়িত্ব পালন করছেন এবং বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তাদের সুরক্ষার অভাব তাদের জন্য এবং অন্যদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। ওদিকে চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় তাদের অতিরিক্ত ডিউটি পালন করতে হচ্ছে, যাতে তাদের বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ব্যাহত হচ্ছে। এটাও তাদের মধ্যে সংক্রমণ বিস্তারের অন্যতম কারণ হতে পারে।
করোনাযুদ্ধে সফলতা লাভ করতে হলে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনক হলেও আমরা লক্ষ করছি, করোনা রোগী তো বটেই, সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে। করোনাবহির্ভূত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না, চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটছে যে, এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে করতে পথেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। করোনাক্রান্ত রোগীদের অসহায় ও বেহাল অবস্থার কথা তো কারোরই অজানা নেই। করোনাক্রান্ত চিকিৎসক-নার্সরাও ঠিকমত চিকিৎসা পাচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারায় কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার কারণে তাদের কারো কারো মৃত্যু হয়েছে। পত্রপত্রিকায় এ ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে, করোনাক্রান্ত চিকিৎসক তার কর্মস্থল যে হাসপাতাল তাতেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। তাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। গতকালের পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ঢাকার একটি হাসপাতালের নার্স তার হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে অবশেষে সেখানেই মারা গেছেন। চিকিৎসক বা নার্সের পেশাগত দায়িত্ব হলো মানুষের চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা দেয়া। অন্যান্য পেশা থেকে এ দুটি পেশার পার্থক্য সহজেই নির্ণয় করা যায়। চিকিৎসক ও নার্স সম্পর্কে আমাদের দেশে যত নেতিবাচক কথাই থাক না, এটাও তো সত্য, অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের কাছেই আমাদের ছুটে যেতে হয়। এই করোনাকালেও তাদের দিকেই আমাদের চেয়ে থাকতে হয়। অতএব, চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবা পেতে হলে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করতে হবে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ, যৌক্তিক কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, যোগাযোগ ও তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি, মনস্তাত্তিক সহায়তা প্রদান, আক্রান্ত হলে চিকিৎসার সুবন্দোবস্তসহ সব ধরনের সুযোগ ও সহায়তা তাদের জন্য নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।