পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনার কঠিন সময়েও বাড়তি ঘটনায় উত্তাল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কারফিউ পর্যন্ত ভঙ্গ হয়েছে দেশটিতে। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। করোনার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট নয়, পুলিশ তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় তোলপাড় উঠেছে দেশটির সীমানা ছাড়িয়ে। মার্কিনীদের ফুঁসে ওঠার আরেক কারণ ওয়াশিংটনে একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া ও অ্যাকশনের নির্দেশ। শুধু তাই নয়, তার সেনাবাহিনী নামানোর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল সোসাইটি, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ।
আমেরিকার রাস্তায় আমেরিকারই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে- এটা তাদের ভাবনাতীত। ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’, এই শ্লোগান তুলেছে তারা। করোনা প্যানডেমিককে ছাপিয়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে গণতান্ত্রিক বিশ্বে। হতভাগ্য ফ্লয়েডের বিরুদ্ধে অভিযোগ জাল টাকা ছিল তার কাছে এবং সে ষ্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে মাদকদ্রব্য সরবরাহ করতো। আমেরিকার কালোদের বিরুদ্ধে এমন ধরনের অভিযোগ অহরহ। স্বভাবজাত কারণে এদের অধিকাংশই আইনকানুনও কম মানতে চায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কারাগারে আটক ষাট থেকে সত্তর ভাগই কালো। তারপরও হাঁটু দিয়ে গলা চিপে ধরে কোনো নাগরিককে হত্যা করা হবে, একটা গণতান্ত্রিক সমাজে এটা কেউ সমর্থন করতে পারে না। আমেরিকার অন্তত পঁচাত্তরটি শহরে চলছে লাগাতার বিক্ষোভ।
করোনা আক্রান্ত আরো দুই দেশ চীন ও ভারতের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে পাল্টে দিতে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত-চীনের প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও পরিস্থিতি সবার কাছাকাছিই। করোনা মহামারীতে আক্রান্ত এদেশগুলোর প্রতিটিই। সর্বগ্রাসী মহামারী করোনা মানবজাতিকে একটু আধটু হলেও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একটা মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার তাগিদ দেবে বলে আশা করা হলেও এসব দেশের বিভিন্ন ঘটনা এখন উল্টো ইঙ্গিত দিচ্ছে। মার্কিনিরা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে এসব দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। কোথাও কোথাও ঘটনার হোতাও আবার তারাই। তফাৎ হচ্ছে এখন সেই আদলের ঘটনা তাদের দেশেই ঘটছে। যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে ঘটনা-দুর্ঘটনা নতুন নয়। মার্টিন লুথার কিং হত্যার ঘটনা ও বহুল আলোচিত। তারপর ১৯৯২ সালে রডনি কিং নামে আরেক কৃষ্ণাঙ্গকে প্রকাশ্যে পুলিশি নিপীড়নের শিকার হতে হয়। ওই ঘটনায় গোটা আমেরিকায় প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। এখন করোনায় সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ হওয়ার পরও নতুন বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রাণঘাতী রোগে দেশটিতে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। সামাজিক দূরত্ব কেউ মানছে না। ঘরে থাকার নির্দেশও টিকছে না। ফলে সব দিকেই যুক্তরাষ্ট্রে বেপরোয়া দশা। বিভিন্ন দেশের উগ্রপন্থীদের একসময় নানাভাবে মদদ জোগাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নিজের দেশই যখন উগ্রপন্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হলো, তখন থেকেই একটু পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই গির্জায় না ঢুকে বাইবেল দেখালেন। এতেও ধর্মীয় নেতারা যথেষ্ট ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তিনি গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছেন বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে হটাতে। নিজের সমর্থন বাড়াতে আগুনে পুড়ে যাওয়া গির্জার সামনে বাইবেল হাতে ছবিও তুলেছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। সহিংসতা কমলেও বিক্ষোভ কমছে না। উল্টো সমালোচিত হচ্ছেন ট্রাম্প। নিজ দল আর পুরোনো সমর্থকদের মধ্যেই দেখা দিচ্ছে অসন্তোষ।
ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের করা সমালোচনা। সবচেয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন তাঁর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জেমস ম্যাটিস। তিনি কোনো রাখঢাক ছাড়াই ট্রাম্পকে অযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন এবং দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে বিভক্ত করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। অথচ এর আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে ‘মাই জেনারেল’ নামে পরিচয় করিয়ে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের সাবেক চেয়ারম্যান জেনারেল মাইকেল মালেনও ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। ‘আর নীরব থাকা সম্ভব নয়’ শিরোনামে এক নিবন্ধে তিনি চলতি বিক্ষোভকে এক বাঁক ফেরানো ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের সমালোচক হিসেবে পরিচিত সিনেটর মিট রমনি বলেছেন, জেনারেল ম্যাটিস একজন অত্যন্ত সম্মানিত মানুষ। অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন।
এদিকে করোনা মহামারী পরিস্থিতিতেই যুদ্ধের আবহে এগুচ্ছে ভারত-চীন। সীমান্তে তারা মুখোমুখী। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পূর্ব লাদাখের কাছে একাধিক জায়গায় মুখোমুখী ভারত-চীন বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। বিশ্বপরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় খেলারামের ভূমিকায় করোনায় প্রথম আক্রান্ত চীন ও হালে চরম শিকার ভারত। তাদের এ উত্তেজনার কারণ ভারতের একটি রাস্তা নির্মাণ। চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) লাদাখের ভেতরে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার ঢুকে পড়েছে। ভারতের প্রখ্যাত প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার অজয় শুক্লা বলেছেন, সীমান্তে প্রায় ৫০০০ চীনা সৈন্য আছে এবং তারা সেখানে অবস্থান করার জন্য প্রতিরক্ষা স্থাপনা নির্মাণ করছে। ভারতীয় সরকার লাদাখে প্রবেশ করতে চেষ্টা করতেই আরেকটি সংঘাত সৃষ্টি হয়। কৌশলগত অবস্থান থেকে চীন চায় না ভারত আকসাই চীনে প্রবেশ করুক। তা করতে পারলে তারা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এই রাস্তাটি দক্ষিণে দুবরুকের সাথে উত্তরের দৌলত বেগ ওলদিকে যুক্ত করবে। কৌশলগত এ পয়েন্টে যুক্ত হলে ভারত দ্রুত আকসাই চীনে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে। পুরো সীমান্ত সঙ্কটে ভারতের হাতে বিকল্প ফুরিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সামরিক কৌশলকে মাথায় রেখে অনেক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা বলছেন, সামরিক দক্ষতা ও সরঞ্জামের দিক থেকে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে চীন। চীনারা একটি বুলেট নিক্ষেপ না করেও ভারতকে হারিয়ে দেয়ার মতো শক্তি রাখে।
অবশ্য, চীন-ভারতের এ মনোমালিন্যের সূচনা বা প্রেক্ষিত এখানেই নয়। এর পেছনে আরো ঘটনা রয়েছে। ভারতের প্রতি পাশ্চাত্যের ক্রমবর্ধমান সমর্থন ও সেইসাথে এই অঞ্চলে মোদির ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে দেশটির প্রতিবেশীরা উদ্বিগ্ন। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপও চীনকেও ক্ষুব্ধ করেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ভারত একতরফাভাবে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে থাকা জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। তারপর থেকে কাশ্মিরের মানুষ স্থায়ীভাবে দমন-নিপীড়নের মধ্যে আছে, ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতার মুখে পড়েছে। তাছাড়া চীন-শাসিত আকসাই চীনকে ভারত তার নিজের ভূখন্ড বলে দাবি করে এবং লাদাখকে ইউনিয়ন ভূখন্ড হিসেবে অভিহিত করেছে। তা চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এ ছাড়া, চলমান করোনার দুর্যোগে ভারত অন্যায়ভাবে চীনের সমালোচনা করেছে। এ মহামারীর বিশ্বব্যাপী বিস্তারের জন্য চীনকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগকে সমর্থনও করেছে ভারত। এদিকে, ইন্দো-চায়না সীমান্ত সংঘাতের মধ্যে নেপাল সরকার নতুন একটি রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করেছে। এতে বিরোধপূর্ণ কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পয়াধুরাকে নিজের বলে দাবি করেছে। ভারত ২০১৯ সালে একতরফাভাবে কালাপানিকে নিজের ভূখন্ড হিসেবে দাবি করার প্রেক্ষাপটে নেপাল এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। নেপাল সরকার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করতে বললেও ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। নেপালের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং নেপাল ও ভুটান উভয়স্থানে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ ভারতের কৌশলগত অবস্থানের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হচ্ছে। দোকলামের বিরোধ নিরসনের জন্য ভুটানের সাথে আলোচনা করছে চীন। তারা যদি এতে সফল হয়, তবে চীন সুযোগ পাবে সিলিগুড়ি গিরিপথে প্রবেশ করার। উল্লেখ্য, এই গিরিপথটি ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের সংযোগ সাধন করছে। উত্তর সিকিমের এই অঞ্চলে এর আগেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। চীন-ভারত সীমান্তের এই অংশ ঘিরে উত্তেজনা নতুন নয়।
এর পেছনে তিব্বতের চীন থেকে আলাদা হতে চাওয়া এবং তাতে ভারতের সমর্থন দেওয়ার জেরও রয়েছে। এ নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকটটি তৈরি হয় ১৯৫৯ সালে যখন ভারত তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামাকে আশ্রয় দেয়, যাকে চীন মনে করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা। মূল সংকটের একদিকে আকসাই চীন, অন্যদিকে অরুণাচল। ভারতের অরুণাচলকে চীন নিজের দাবি করে। আর চীননিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনকে দাবি করে ভারত। আকসাই চীনকে কোনোভাবেই ছাড়তে রাজি নয় চীন। এটি চীনের ভীষণভাবে দরকার, তিব্বতের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য। পূর্ব অংশেও ঠিক একই রকম সংকট রয়েছে। আর তা হলো খোদ অরুণাচল নিয়ে। এর সীমান্তঘেঁষা একটি অংশ কোনো সময় এর পুরোটাই নিজের বলে দাবি করে আসছে চীন। ফলে এটি ভারতের জন্য বিরাট মাথাব্যাথার কারণ। বাষট্টির যুদ্ধের মধ্য দিয়েও দু’দেশ নিজেদের মধ্য দিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারেনি। এ নিয়ে উত্তেজক পরিস্থিতি সেই সময় থেকে বিরাজমান। দুই দেশ তাদের পার্শ্ববর্তী অন্য সব দেশের সঙ্গে মোটা দাগে সীমান্তবিরোধ অনেকাংশে মিটিয়ে আনলেও নিজেদের মধ্যে তারা বিরোধ জিঁইয়ে রাখছে। সংকট জিঁইয়ে রাখার মূলে রয়েছে আলোচনার টেবিলকে নিজের পক্ষে টানার শক্তি অর্জনের দূরবর্তী সমীকরণ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।