Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

গলগন্ড বা ঘ্যাগ রোগ

প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গলগন্ড বা ঘ্যাগ হল অস্বাভাবিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থায়রওয়েড গ্রন্থি। থায়রয়েড গন্থিটি গড়লার সামনের দিকের নিচের অংশে থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এটির অবস্থান দৃশ্যমান নয়। থায়রওয়েড গ্রন্থির আকার অনেকটা প্রজাপতির মতো। দু’পক্ষের দু’টি ডানার মত অংশ (লোব) একটি সংক্ষিপ্ত ও দেহ (ইয়ামাথ) দিয়ে সংযুক্ত থাকে। গ্রন্থিটি যখন আকার-আয়তনে বড় হয় (গলগ-) তখন তা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয় এবং খাবার সময় বা কথা বলার সময় এর নাড়াচাড়া বিশেষভাবে বুঝা যায়।
থায়রয়েড গ্রন্থিটি দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহে যে ক’টি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি দেহের সামগ্রিক ক্রিয়া কলাপকে প্রভাবিত করে থায়রয়েড তাদের অন্যতম। এটি অন্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকেও প্রভাবিত করে। থায়রয়েড গ্রন্থিটি পক্ষান্তরে পিটুইটার (সামনেরটি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা আবার হাইপো থায়রয়েড গ্রন্থির নিয়ন্ত্রণে থাকে। থায়রয়েড গ্রন্থি থেকে থায়রয়েড হরমোন (টি ৪ ও টি৩) নিঃসৃত হয়।
থায়রওয়েড গ্রন্থি বিভিন্ন কারণে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হল পিটুইটারি গ্রন্থি হতে অধিক কাজ করার নির্দেশ প্রাপ্ত হওয়া। আবার খাদ্যে আয়োডিনের অভাব থাকলেও থায়রয়েড গ্রন্থিটি ক্রমশ বড় হতে থাকবে। এছাড়া থায়রয়েড গ্রন্থির কিছু কিছু স্থানিক সমস্যার কারণে গ্রন্থিটি ক্রমশ বড় হতে থাকে। এর মধ্যে আছে নড্যুল, ক্যান্সার, হাইপার থায়রয়েজিম ও হাইপো থায়রয়েডজম।
বাংলাদশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সংখ্যক গলগ- রোগ আছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এর প্রকোপ বেশি। আবার মহিলাদের মাঝে গলগ-ের হার পুরুষের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ বাদে অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকা, আলপম পর্বতের পাদদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট লেক এলাকা ও পার্শ্ববর্তী ভারতের হিমালয় পর্বতের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচুর গলগ-ের রোগী দেখা যায়। সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে গলগ- বেশি দেখা দেবার কারণ হল, সমুদ্র থেকে যত দূরত্ব বাড়বে মাটিতে তত কম পরিমাণ আয়োডিন পাওয়া যাবে। আয়োডিনের এ দীর্ঘদিনের ঘাটতিতে থায়রয়েড গ্রন্থি ক্রমশ বৃহদাকার হতে থাকবে।
মাটিতে আয়োডিনের ঘাটতি বাদেও কিছু কিছু খাবার বেশি পরিমাণে এবং অনেক দিন ধরে খেতে থাকলেও আয়োডিনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং গলগ- হতে পারে। এ সব খাবারের মধ্যে আছে পাতা কপি, ব্রকলি, ফুলকপি, সয়া জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি। কিছু কিছু ওষুধও থায়রয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। থায়রয়েড নড্যুল, ক্যান্সার ও হাইপো থায়রয়েডিজম ও হাইপার থায়রয়েডিজমের জন্যও গলগ- হতে দেখা যায়।
গলগ-ের লক্ষণসমূহ হঠাৎ করে শুরু হয় না বরং অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে গলগ- হতে থাকে। এর প্রধানতম লক্ষণ হল গলার সামনের দিকের মাঝখানের নিচের অংশ বা দু’পাশ ফুলে উঠা। রোগী সাধারণত নিজে থেকে প্রথমে এ সমস্যাটি সনাক্ত করতে পারে না। তার বন্ধুবান্ধব বা ঘনিষ্ঠজন প্রথমে একবার গলার এ স্ফীতিকে সনাক্ত করে। এটি এত ধীরে ধীরে হয় যে, অন্য কেউ বলার পরও রোগী সন্দিহান থাকতে পারে এ ব্যাপারে। কিন্তু তারপর দেখা যাবে এ গ্রন্থিটি ক্রমশ বৃহদাকার হয়ে যাচ্ছে। থায়রয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি প্রাপ্তির সাথে সাথে খেতে বা ঢোক গিলতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। গলগ- খুব বড় হলে শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা হতে পারে। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ও গর্ভাবস্থায় গলগ- সাময়িকভাবে আরো বড় হয়।
গলগ- হাইপার থায়রয়েডিজমের হলে থায়রয়েড গ্রন্থির নিরসনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ রোগীর কিছু অটোইম্যুন রোগ থাকে যার মধ্যে গ্রেভ’স রোগ প্রধান। এ সব রোগে টিএসএইচ-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে টি৪ ও টি৩ হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। হাইপার থায়রয়েডিজমের গলগ-ের উপর লক্ষণগুলোর সাথে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, অস্থিরতা, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, গরম অসহ্য লাগা, হাত কাঁপা ও ডায়রিয়া থাকতে পারে।
হাইপো থায়রয়েডিজমের কারণে গলগ- হলে থায়রয়েড গ্রন্থির নিঃসরণ কমে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সামলাবার জন্য থায়রয়েড গ্রন্থির আয়তন বাড়তে থাকে। আয়োডিনের স্টাটাডের প্রধান কারণ। এছাড়া কিছু অটোইম্যুন রোগও এর জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে গলগ-ে সাধারণ লক্ষণগুলোর সাথে শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদ, শীত সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি থাকতে পারে।
কিছু রোগীর ক্ষেত্রে থায়রয়েড গ্রন্থির ক্যান্সারের জন্যও গলগ- দেখা দিতে পারে। এ ক্যান্সার আবার মেয়েদের হবার সম্ভাবনা বেশি। আর যাদের যৌবনের শুরুতে বার বার এক্সরে করতে হয়েছে বা অন্য কোন আণবিক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের থায়রয়েড ক্যান্সার বেশি হয়। থায়রয়েড ক্যান্সারের হার বরং কম এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সম্পূর্ণ রূপে সেরে যায়। যে কোন বয়সে থায়রয়েড ক্যান্সার হতে পারে যদিও চার দশকের কাছাকাছি বয়সে বেশি সংখ্যক রোগীকে সনাক্ত করা হচ্ছে।
গলগ- হয়েছে বা হচ্ছে মনে হলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আমাদের দেশের অনেকেই এ ব্যাপারটাতে বেশ অনীহা প্রকাশ করেন এবং এর জন্য রোগীকে ও তার পরিবারকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। গলগ-ের সম্ভাব্য রোগীকে চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষায়, আলটাসোনোগ্রাম থেকে শুরু করে বায়োপসি ও রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন আপটেক পরীক্ষা পর্যন্ত করতে পারেন।
গলগ-ের কারণ নির্ধারিত হবার পর এর চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হয়। গলগ-ের রোগীর থায়রয়েড গ্রন্থি যদি সামান্য একটু স্ফীত হয়ে থাকে এবং এর শুধুমাত্র পর্যাপ্ত আয়োডিন সরবরাহ করেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি আয়োডিনের ঘাটতিজনিত হাইপোথায়রেডের গলগ- বৃহদাকার হয়। তবে শুধুমাত্র আয়োডিন যোগ করে তেমন কোন উন্নতি আশা করা যাবে না। এক্ষেত্রে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থায়রয়েড গ্রন্থিকে অপারেশন করে বাদ দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এরই সাথে হরমোন খাওয়াতে হয় আজীবন। আর হাইপার থায়রয়েডিজমের কারণে গলগ- হলে থায়রয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা কমাতে পারে এমন ওজন দিয় সংশোধনের চেষ্টা করা হয়। এদের ক্ষেত্রেও অপারেশন করে স্ফীত গ্রন্থিটি বাদ দেয়া জরুরি হয়ে পড়ে অনেক অসময়। নিরীহ থায়রয়েড নড্যুল ওষুধ সংশোধনের চেষ্টা করাই শ্রেয়। আর থায়রয়েড গ্রন্থির ক্যান্সার হলে দ্রুত অপারেশন করে পুরোটা গ্রন্থি ফেলে দেয়া হয়। এর পর রেড়িড অ্যাকটিতে আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতিতে আয়োডিনের অভাবজনিত হাইপেথায়রয়েডিজম এবং এর ফল স্বরূপ গলগ- খুব বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ, যেমন বৃহত্তর রংপুর জেলা, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিশেষ করে শেরপুর ও জামালপুর জেলা) জেলার বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষ আয়োডিনের অভাবজনিত গলগ-ে ভুগছে। এদের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিনের ব্যবস্থা করতে পারলেই ব্যাপক জনগোষ্ঠি গলগ-ের হাত থেকে রেহাই পায়। সরকারিভাবে খাবার লবণে নির্দিষ্ট মাত্রার আয়োডিন মেশানোর নির্দেশ দেয়া থাকলেও আমাদের অভিজ্ঞতা বিরূপ। বেশির কারণেই নির্দেশিত আয়োডিন নেই কিন্তু এর দাম নেয়া হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত লবণ হিসেবে। আর এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন।
ষ ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা
ফোন : ৮১২৪৯৯০, ৮১২৯৬৬৭ এক্স- ১১৯
মোবা : ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭, ০১৯১৯০০০০২২
ঊসধরষ: ংবষরসংযধযলধফধ@মসধরষ.পড়স



 

Show all comments
  • Pobirul Islam ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ৯:৪১ পিএম says : 0
    সার্বিক পরীক্ষা নিরিক্ষার পর ডাক্তার আমার গলগন্ড রোগ নিশ্চিত করেছেন, যদিও আমার গলার সামান্য ফুলা অংশটি এখনো সাভাবিক পর্যায় পরিলক্ষীত, অপারেশন এর বিকল্প কিছু উপায় থাকলে জানাবেন- প্লিজ
    Total Reply(0) Reply
  • md saiful islam ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৭:৪৯ পিএম says : 0
    ami madicine cai
    Total Reply(0) Reply
  • md saiful islam ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৭:৪৯ পিএম says : 0
    ami madicine cai
    Total Reply(0) Reply
  • md saiful islam ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৭:৪৯ পিএম says : 0
    ami madicine cai
    Total Reply(0) Reply
  • আলাউদ্দিন ১১ জুন, ২০২০, ৩:৪৮ এএম says : 0
    আমি গলগন্ড রোগের লক্ষণ পড়ে শিওর হলাম যে, আমিও গলগন্ড রোগে আক্রান্ত ,আমার গলার বাম পাশে একটু ফুলা দেখা যায় সেখানে যদিও কোন ব্যথা নেই ।দয়া করে বলবেন আমি এখন কিধরনের ডাক্তার দেখাতে অথবা ঔষধ খেতে পারি?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গলগন্ড বা ঘ্যাগ রোগ

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
২৭ জুলাই, ২০১৬
আরও পড়ুন