পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এখন জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই চলে গেল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বার্ষিকী- অনেকটা অবজ্ঞা, অবহেলা, বিস্মণের মধ্য দিয়ে। অবশ্য দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আশঙ্কার কথাও কেউ কেউ বলতে পারবেন। তবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী আজকাল কতটা অবহেলায় পালিত হয়ে থাকে যেমন তার জন্মভূমি, তেমনি তার স্বপ্নভূমিতে, সেটা সকলেই জানে।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। এটা আমরা সবাই জানি। তবে বাংলাদেশ কী করে তার স্বপ্নভূমি হলো, তার একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেছে ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা উত্থাপিত একিট প্রস্তাব অনুসারে। নজরুল ইসলাম সারা জীবন যেমন হিন্দু-মুসলিম মিলন প্রত্যাশী ছিলেন, তেমনি বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাদপদতায় অত্যন্ত ব্যথিত ছিলেন। তাই তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বাসনা করেছেন আজীবন। একই সঙ্গে মুসলমানদের জাগরণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাঁর অসংখ্য কবিতা ও গানে। এসব কবিতা ও গানের কয়েকটি এখানে তুলে দেয়া হলো। তবে তার আগে আরেকটি মূল্যবান তথ্য পাঠকদের জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। তিনি মূলত: কবিতা ও গানের রচয়িতা হলেও তার বেশ কিছু গদ্য রচনাও রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার প্রদত্ত ভাষণ এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তার গদ্য রচনা।
এসব রচনার মধ্যে রয়েছে: বর্তমান বিশ্ব সাহিত্য কড়ব, পিরীতি বালির বাঁধ, সত্যবাণী, নমস্কার, মুসলিম সাংস্কৃতির চর্চা, বাংলার মুসলিমকে বাঁচাও, জনসাহিত্য, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান প্রভৃতি।
নজরুল যেমন লিখেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান, তেমনি তিনি লিখেছেন যার মধ্যে অন্য ভাষার আস্ত অংশবিশেষ। যেমন কামাল পাশা কবিতায় তিনি অবলীলাক্রমে লিখে গেছেন: কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই এবং লেফট রাইট লেফট। আবার ‘খেয়া পারের তরণী’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন:
কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা
দাঁড়ি মুখে সারি গান-লা শরীক আল্লাহ
নজরুলের কবিতা ও গানের বিষয়বস্ত সব সময়ই ছিল বঞ্চিতদের নিয়ে, যেমন: কৃষক, শ্রমিক, নারীজাতি। শেষোক্ত বিষয় নারী শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখেছেন:
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ, রমণী কোনো ভেদাভেদ নেই, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। নারীর মতো কুলি মজুরও একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠী। নজরুল তার ‘কুলি-মজুর’ শীর্ষক কবিতায় তাদের সম্পর্কে লিখেছেন:
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ এদেশ দখল করে নিয়েছিল, হিন্দু-মুসলিম মিলন ঘটিয়ে তাদের হাত থেকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে নজরুল লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা এ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
হিন্দু-মুসলিম মিলনের গান গেয়েছেন বলে নজরুল পিছিয়ে-পড়া তাঁর স্বজাতি মুসলমানের প্রতি তার কর্তব্য ভুলে যাননি। মুসলমানদের জাগিয়ে তুলতে লিখেছেন:
দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে
দীনই ইসলামী লাল মশাল। ওরে বেখবর, তুই ওঠ জেগে
তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল
তিনি আরও লিখেছেন:
আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়
আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময় আমার কিসের শঙ্কা
কোরআন আমার ডংকা..
ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়
নজরুল ইসলাম ইসলামের আলোকে নয়া জামানার স্বপ্ন দেখে গিয়েছেন:
বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার
ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান
মুখেতে কালেমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর
চল আগে চল বাজে বিষান।
ভয় নাই তর গলায় তাবিজ
বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান
নহি মোরা জীব ভোগ- বিলাসের,
শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের,
ভিখারির সাজে খলীফা যাদের
শাসন করিল আধা জাহান-
তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ
বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান
নজরুল ইসলাম ছিলেন রাজনীতি সচেতন কবি। তাই ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাস হলে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কলকাতার তৎকালীন আজাদ অফিসে। উপমহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের সেই স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ (বাংলাদেশ)-এর আবির্ভাব যাতে সহজে সম্ভব হয় তার জন্য আজাদে ছোটদের জন্য একটি বিশেষ পাতা খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় পাতাটির নাম ও এর পরিচালকের নামও তিনি ঠিক করে দেন যথাক্রমে মুকুলের মাহফিল এবং বাগবান।
এ তথ্য আমরা জানতে পাই মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সাংবাদিকের রোজনামচা বই থেকে।
সেই নিরিখে বলা চলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সম্ভবত সেই নিরিখেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর কলকাতা থেকে নজরুলকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছাক্রমে এবং তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বসবাসের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে ঢাকায় তার মৃত্যু হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক কবির শেষ ইচ্ছাক্রমে মসজিদের পাশে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে) তার কবর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এ লেখার ইতি টানলাম। তার আগে আরেকটু নিবেদন করতে চাই সংক্ষেপে।
যে নজরুল আমাদের জাতীয় কবি তাঁকে শুধু মুখে মুখে জাতীয় কবি বলে প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখানো সম্ভব নয়। নজরুল ইসলাম ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জনক এ বাস্তব সত্য আমাদের কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, নজরুল তার অসংখ্য কবিতা গান এবং ভাষণের মধ্য দিয়ে যে ঐতিহাসিক অবদান রাখেন তার ফলেই সাবেক পূর্ববঙ্গ যা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আমাদের ইতিহাসের চর্চার মাধ্যমে এ সত্য উপলব্ধি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু তাই নয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে নজরুলের রচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তার ওপর ব্যাপক গবেষণার ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠ্যক্রমে তা না করে আমরা যদি বর্তমানকালের মতো শুধু মুখে মুখে নজরুলকে জাতীয় কবি বলে আওড়াই তাহলে কবির প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করা সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, নজরুল চর্চা গুরুত্ব সহকারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং সাহিত্য রসিক ব্যক্তিগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারলে আমাদের স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিকভিত্তি দুর্বল হয়েই থাকবে, যেমন রয়েছে বর্তমানে। এসব কথা বলা হচ্ছে এ কারণে যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রকে সার্থক সফল এবং শক্তিশালী থেকে আরও শক্তিশালী করতে হলে তার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। সেই নিরিখেই স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পুরোধা নজরুল ইসলামকে গুরুত্ব দিতে হবে, মূল্যায়ণ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।