পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিক্ষার কোনো বয়স নেই। শিক্ষা কোনো নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধও থাকে না। শিক্ষার প্রচার ও প্রসার বিশ্বব্যাপী। শিক্ষা হলো মানুষের আলোর দিশারী। যে আলো নিজেকে আলোকিত করে পাশাপাশি অন্যকে অলোর পথ দেখায়। যুগে যুগে গড়ে উঠা এই সুসজ্জিত শিক্ষাতরী উল্টিয়ে লন্ডভন্ড করতে উদয় হয় মহামারী দুর্যোগ। হতে পারে সেটা দৃশ্যমান কোনো কিছুর আবার অদৃশ্য শক্তির। তেমনি বিংশশতাব্দীর গোটাকুড়িক বছর পার হতে না হতেই ডাকসাইটে এক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। কোভিড-১৯ এই অদৃশ্য শক্তির নাম হলেও কাজে ষোলোআনা। ছোঁয়াচে প্রকৃতির এই ফ্লুগোত্রীয় ভাইরাসটি হাফ লাগিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। যমের মত কেড়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। ধনী, দরিদ্র, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, যুবক, বৃদ্ধ, সদ্যোজাত শিশু কারো যেন ছাড় নেই। জাত-ধর্মের কোনো ভেদ নেই। সর্বত্রই শক্তভাবে হানা দিচ্ছে। এ যেন এক ভয়ঙ্কর মায়াপুরী, যার প্রতিটি অনুষঙ্গ আজ বিষিয়ে তুলেছে। এখানে উপজীব্য প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং সুশিক্ষা ও জীবন থেকে শেখা। শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি, যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে এবং মানসিকতাকে স¤প্রসারিত করে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে পুরোপুরি কার্যকর কিনা? আদর্শ মা-বাবার আদর্শ সন্তান নম্র-ভদ্র-আদর্শ হওয়াই স্বাভাবিক অর্থাৎ পারিবারিক শিক্ষা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরপর কোনটা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? সুশিক্ষা নাকি বড় বড় ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তি। যদি সুশিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেই তবে এটার সাথে নামীদামী প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট, নামের বামে গোটা তিনেক বিশেষণ, খ্যাতিসম্পন্ন, এগুলো প্রাধান্য পাবে কিনা? সেক্ষেত্রে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন সাঁঈজীর ক’খানা সার্টিফিকেট ছিল, সেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে। অথচ তাঁদের লেখনী আমরা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হয়েও কতটুকুই বা উপলব্ধি করতে পারি। এসব মণীষী তাদের জীবনে ঠেকে শিখেছে। তাদের ছিলো একটা পরিপুষ্ট জীবনদর্শন। নজরুল আর সাঁঈজীর জীবনে দারিদ্র্য তাদের জীবনে নতুন নতুন ভাবনা শিখিয়েছে। এ শিক্ষা জীবন থেকে শেখা এবং তাদের সৃষ্টিশীল কর্ম হলো অভিজ্ঞতার নির্যাস, এ শিক্ষাই সুশিক্ষা। সুশিক্ষা এসব ব্যক্তির জীবনকে আলোকিত করেছে। এ শিক্ষার সাথে সার্টিফিকেটের ভারত্ব খুব বেশি পরিপূরক নয়, বরং প্রতিকল্প। এতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবহ যে সুশিক্ষার অগ্রাধিকার সবার উপরে।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে। ভালো ফলাফল করে ফাস্টক্লাস একটা চাকরিতে নিয়োগলাভ করে অথবা উচ্চশিক্ষার জন্য সুদূর চীনদেশে অথবা পাশ্চাত্যে পাড়ি জমায়। উচ্চশিক্ষা শেষ করে ভালো লাগলে দেশে এলো অথবা গ্রিনকার্ড পেয়ে দেশমাতৃকার সকল বন্ধন ছিন্ন করে ঐ দেশেই সেটেল হয়ে গেলো। ভালো ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের সবাই কি জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের হাতিয়ার সোনার মানুষ হবে? সবাই কি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে?
একটি সন্তান জন্মের পরে অন্তত ৫ বছর বাবা-মার সাথেই সময় কাটায়। ঐসময় শিশুটি থাকে কাদামাটির মতো। যেভাবে যা কিছু বাবা-মা শেখায় সেটাই শিশুটি রপ্ত করতে থাকে। পিতা-মাতার দিনলিপি শিশুর মধ্যে বর্তাতে থাকে। কাদামাটি হিসেবে প্রাপ্ত এই শিক্ষাই শিশুটির বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করে। এই সময়কালে অনেক পরিবারেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ-বিবাদ থাকে। অনেক পিতাই নেশা করে ঘরে ফেরে। অনেক পিতাই শিশুটির মাকে অথবা শিশুটির মা শিশুর বাবাকে হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়েই পিটায়। হিংস্র ও অশোভনীয় আচরণ শিশুটি তার পিতা-মাতার কাছ থেকে রপ্ত করে যখন পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে যায়, তখনি তার বুনিয়াদি শিক্ষণ চর্চা করার চেষ্টা করে। এভাবে শিশুটি সমাজে যাদের মধ্যে বিচরণ করে সেসকল মানুষের সাথে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণের চেষ্টা করে। একসময় সে বেয়ারা হয়ে যায়। প্রায়শই বহু শিশুরই এমন আচরণ সংশোধন হয়ে যায় এবং সেটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশের পর অর্থাৎ ৬ বছরে যখন স্কুলে গিয়ে দেখে তার অন্য বন্ধুরা ভালো আচরণ করে আর সে খারাপ আচরণ করায় শিক্ষকের নিকট বেত্রাঘাত, বকা খেতে হয়। সহপাঠীদের আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার অতীত অভ্যাস পরিবর্তন করে ফেলে। আবার শিশুটির নিকটতম বন্ধুটি যদি একই বৈশিষ্ট্যের হয় এবং তাকে যদি বাসায় ফিরেও একই ধরনের কুরুচিপূর্ণ আচরণ পিতা-মাতার মধ্যে দেখতে হয় এটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক পরিবর্তন করে ফেলে। এতে শিশুটি আর ভালো হওয়ার সুযোগ না খুঁজে তার সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বন্ধুর সাথে একটি মেলবন্ধন ঘটিয়ে ফেলে। এভাবেই তারা ক্রমাগত ভালো পথ ছেড়ে খারাপ পথে ধাবিত হয়। পরক্ষণেই ছেলে দুটি তাদের পারিবারিক অশান্তি ভুলে থাকার জন্য মিলেমিশে কিছুদিন সিগারেট ফুঁকে। একটু বেশি প্রশান্তির জন্য বোতল, পরে চলতে থাকে। টাকার অভাব হলে চুরি-ডাকাতি শুরু করে। মামলায় ফেঁসে গেলে সেখান থেকে বাঁচার জন্য প্রভাবশালী কারো হাতের ক্রীড়ানক হিসেবে জীবনকে সঁপে দেয়। এহেন অবস্থায় তাদের কাছে নিজের জীবনের কোনো গুরুত্ব থাকে না। জীবনে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। পড়ালেখা চুঁকিয়ে নিজেকে অপরাধের জগতে মেলে ধরে।
কোন পিছুটান তো নেই। বিচ্ছিন্ন জীবন। মেলে ধরেনি কোন সুন্দরী রমণীর হাত। ইভটিজিং করায় পটু। পায়নি কোনো পারিবারিক শিক্ষা। দুচোখে শুধু প্রতিকূল পরিবেশ দেখতে হয়েছে। পৃথিবীটা যেন এমনই। পরিবারের কাউকে শিষ্টাচার মেনে চলতে দেখেনি। কুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীতে অসদুপায়ে ক্ষমতা পেয়ে অনেক ডিগ্রি অর্জন করেছে যেটা কিনা বস্তাভর্তি সার্টিফিকেট বা কাগজ ছাড়া কিছুই নয়। এসবের মূল্যায়ন কোথায়। এই শিক্ষা কোন কাজেই লাগার নয়। আর এ ধরনের কুলাঙ্গার বা বেয়ারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকেই কীভাবে চিনবে। ধ্বংসযজ্ঞই হলো তার প্রিয় কাজ। না খোঁজে কোনো আদর্শ, বুঝেনা কোনো আইন, নেই কোনো নীতি। জানে শুধু একটা অপরাধকে আরেকটি অপরাধ করে ছাপিয়ে যেতে। কোনো একদিন কঠিন বিচারের মুখে পড়তে হয়। সেদিন আর পাশে কেউ থাকে না। কর্মদোষে ধ্বংস অনিবার্য। একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি।
হতভাগা মানুষের এমন পরিণতি কাম্য নয়। কবে জাগ্রত হবে এদের বিবেক? কে করবে এদের সুশিক্ষিত? সবার সুমতির উদয় হোক। দেশের প্রতি প্রেম জাগ্রত হোক। শিক্ষিত মানুষ হিসেবে নয় সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে শিখি। সার্টিফিকেট অর্জন নয়, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে আলোকিত মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই হোক আমাদের শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য।
লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মানিকগঞ্জ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।