পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৩০ মে সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাশমনো হাসপাতাল থেকে নিঃশব্দে অনেকটা রাগ, অনেকটা অভিমান করেই চলে গেলেন নজরুল গবেষক শেখ দরবার আলম। এ দেশে নজরুল গবেষণা যেন একটি মহাভার। সে ভার বইতে বইতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্লান্ত এবং শ্রান্ত। আর্থিক অনটন অক্টোপাশের মতো বেঁধে রেখেছিল তাঁকে।
তাঁর কন্যা সমতুল্য ফারহানা রহমান জানায়, বুধবার ২৭ মে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, মতিঝিলে। সেখানে আইসিইউ সাপোর্ট না থাকায় নিয়ে আসা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে। প্রথমে আইসিইউতে পরে সাধারণ বেডে বদলী করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অথচ, রোগীর অবস্থা তখন ছিল খুবই সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় শনিবার তাকে নিয়ে আসা হয় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষা ছাড়া কোনো চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ফারহানা রহমান বলেন, ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরেও মন গলাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে নিয়ে আসেন রাশমনো হাসপাতালে। রাশমনো হাসপাতালে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার শেখ দরবার আলমের মৃত্যু ঘোষণা করেন।
করোনাকালে এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল এভাবে ছুটাছুটি করতে করতে এবং কোনো চিকিৎসা ছাড়াই একজন মৌলিক নজরুল গবেষককে বিদায় নিতে হলো। ‘কাট এন্ড পেস্ট’ বুদ্ধিজীবীদের দেশে শেখ দরবার আলমের মতো মৌলিক গবেষকরা তো অবহেলিত হবেনই! নজরুল পাহারাদারদের কাছে শেখ দরবার আলম চিরকালই অবহেলিত ছিলেন। অভাব-অনটন ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তীব্র আত্মসম্মানবোধের কারণে দৈনিক ইনকিলাব থেকেও তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম একটা কথা প্রায়শই বলতেন, ‘টাকার সাথে আমার কি যে শত্রুতা, এ টাকা সহজে আমার কাছে আসতে চায় না, আসলেও থাকতে চায় না।’ নজরুলকে হৃদয়ে ধারণ করা একজন গবেষকের পরিণতিও যেন তাই হয়েছে।
যে কথা না বললেই নয়, তথাকথিত নজরুল গবেষকদের কী অবদান আছে, বাংলা সাহিত্যে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নজরুল চেয়ার’ থাকলেও, নেই কোনো গবেষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের জন্য আছে মাত্র ১৫ মার্ক। নজরুল সাহিত্য না পড়েও একজন অনার্স-মাস্টার্সে উত্তীর্ণ হতে পারে। ফলে, নজরুল সাহিত্য অনুধাবন করার সুযোগ এদেশে খুব কম। আসল কথা হলো, চামচাদের দলনে পিষ্ট প্রকৃত গুণীজনরা। বাঁচতে হলে চামচামি করো। আর যদি করতে না পারো, তাহলে অনাহারে, অর্ধহারে, আর্থিক অনটনে পিষ্ট হয়ে জীবন দাও! শেখ দরবার আলম নিজের জীবন দিয়ে তাই জানিয়ে দিলেন। তিনি আরো জানিয়ে দিলেন, মৌলিক সৃষ্টিশীল, চিন্তাশীলদের জন্য এ জমিন উর্বর নয়।
শেখ দরবার আলম ’৪৭-এর পর বাংলাদেশে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ১৯৭০ সালে বাংলা সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মেথড সাবজেক্ট হিসেবে ইংরেজি ও বাংলা এবং স্পেশাল স্টাডি সাবজেক্ট হিসেবে এডুকেশনাল আ্যান্ড ভোকেশনাল গাইডেন্স নিয়ে বি.এড. পাশ করেন। ১৯৭২ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। এ সময় শিক্ষানীতির ওপর উপ-সম্পাদকীয় এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, শাসনতন্ত্র, বাণিজ্যনীতি ইত্যিাদি বিষয়ের ওপর সম্পাদকীয় লেখেন। ১৯৭৭ সাল থেকে কিছু দিন কলকাতার দৈনিক পয়গামের সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ’৮৬-র আগে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক রোববার, দৈনিক কাগজ, নিউ নেশন, সাপ্তাহিক পূর্বাণী, নজরুল একাডেমী পত্রিকা, নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নজরুল বিষয়ে গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন। ১৯৮৬ সালে দৈনিক ইনকিলাবের ‘শিল্প-সংস্কৃতি’ এবং ‘স্বদেশ-বিদেশ’ এ দুটো ফিচার পাতায় বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি দৈনিক ইনকিলাবে সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি ১৯৮৭ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার নজরুল একাডেমীর এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নজরুল একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও নজরুল ইন্সটিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ‘নজরুল জন্মশত বার্ষিকী’ উদযাপন কমিটির আলোচক ও সদস্যও ছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও বাংলাদেশ এর নজরুল বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানের নিয়মিত আলোচক ছিলেন।
শেখ দরবার আলম উপমহাদেশের বহু গুণী ব্যক্তির সাথে আলোচনা অনুষ্ঠান ও সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। যেমন, নজরুল গবেষক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. রমেন্দ্রকুমার পোদ্দার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান ড. সুকুমার সেন, ড. ক্ষুদিরাম দাস, ভিজিটিং প্রফেসর ড. মাজহারুল ইসলামসহ নানা গুণীজনদের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।
মিষ্টভাষী শেখ দরবার আলমকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলেই, মিষ্টি হাসি দিয়ে বলতেন ‘আল্লাহ যেমন রাখেন’। তিনি ছিলেন নিরঅহংকার ও প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। তিনি সাধারণতই একটা কথা বলতেন, আমি নজরুল ব্যবসায়ী নই, আমি নজরুল গবেষক। জেনে বুঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে এবং বাঙালি মুসলিম হিসেবে দায়বোধ থেকেই আমি নজরুল গবেষণা করি। এমন একজন মৌলিক নজরুল গবেষককে বিনা চিকিৎসায় ও আর্থিক অনটনের সাথে সংগ্রাম করতে করতে বিদায় নিতে হবে, ভাবতেও পারিনি।
শেখ দরবার আলম নিঃসন্তান ছিলেন। ফারহানা নামের একটি মেয়েকে তিনি কন্যার মতোই লালন-পালন করেছেন, উচ্চ শিক্ষিত করেছেন, মেয়েটিকে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্রাজুয়েশন করিয়েছেন। কবরে দাফন করা পর্যন্ত মেয়েটিও সন্তানের মতোই দায়িত্ব পালন করেছে। ফারহানা আমাকে জানিয়েছে, করোনার ভয়ে ডাক্তাররা যেমন বাবার কাছে ঘেঁষেনি, তেমনি কবরে দাফনের জন্যও কেউ এগিয়ে আসেনি। মেয়ে হয়ে বাবাকে নিজ হাতে কবরস্থ করতে হয়েছে। সত্যিই, দুঃখজনক। আল্লাহ সুবহানাহুতাআলা মরহুম শেখ দরবার ভাইকে অভিজাত জান্নাতি হিসেবে কবুল করুন।
লেখক: গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।