পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতির জীবনে গভীর সংকটকালে, হঠাৎ করে এমন কোন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে যার নেতৃত্বের যাদুকরী স্পর্শে সবকিছুই যেন সোনা হয়ে উঠে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষণজন্মা সেইসব স্টেটসম্যানদেরই একজন ছিলেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত, তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যাপ্রাপ্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য আশির্বাদ হয়েই তিনি এসেছিলেন। স্টেটসম্যানসূলভ দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি এঁকে ফেলেছিলেন এদেশের উন্নয়নের রূপকল্প। সমগ্র জাতির প্রাণে সৃষ্টি করেছিলেন এক অন্যরকম স্পন্দন। জাতি গঠনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন। রাষ্ট্রের এমন কোন সেক্টর ছিল না যেটাতে তিনি তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি শুরু করেছিলেন জাতিকে স্বাবলম্বী করার বাস্তবসম্মত কার্যক্রম। এদশের রাজনীতির বড় প্রাপ্তি হলো শহীদ জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। একাত্তরে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে আর পঁচাত্তরে সিপাহী-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে তাঁর উপর ন্যস্ত করেছিল দেশ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব। আধুনিক বাংলাদেশের যে দিকে তাকানো যায়, চোখে পড়বে জিয়ার ছবি। ‘আদর্শ গ্রাম’ তৈরির এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নের সুষম সুফল পৌঁছে দিতে তিনি সর্বস্তরের জনতার দ্বারে দ্বারে ছুটে যান। বিপুল জনসংখ্যায় হতাশ বা আশাহত না হয়ে জনসংখ্যাকে জনশক্তিকে পরিণত করার বাস্তবসম্মত উদ্যেগ গ্রহণ করেন। টপ টু বটম সকলকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসেন। নিজের রাজনৈতিক সহকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ বেকার যুবক শ্রেণি পর্যন্ত সকলকেই নিজ নিজ ক্ষেত্র ও পর্যায়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, তারপর পথচলা- এ নীতি কার্যকর হয়। এর ফলে দেশের প্রতিটি সেক্টরে এর ইতিবাচক ফল লাভ তো ঘটেই, উপরন্তু বিদেেেশও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে সুনাম অর্জন করে বিপুল এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভবপর হয়। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির এ অত্যাধুনিক পদ্ধতি শহীদ জিয়া আজ থেকে তিন দশক আগেই কার্যকর করে তাঁর দূরদৃষ্টির যথাযথ প্রমাণ রেখে গেছেন। তাঁর আরেকটি বিস্ময়কর পরিকল্পনা হলো ‘খাল খনন প্রকল্প’। শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রাখা আর বন্যার সময় তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচার কি মোক্ষম ব্যবস্থার কথাই না তিনি চিন্তা করেছিলেন আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে পরিত্যাক্ত এ প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তার কথা আজ আমাদের বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করছেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছিল, তেমনি এক সুদূরপ্রসারী ফলাফলের কথাও ভাবা হয়েছিল। এ প্রকল্পের কারণে আজ বরেন্দ্রভূমি সবুজ শ্যামল জনপদে পরিণত। অপর দিকে অল্প বৃষ্টি বা ঢলেই বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য এ কর্মসূচী আবারও শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনরা।
শহীদ জিয়ার অসামান্য অবদান হলো দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি অবাক করার মতো। ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠি থেকে শুরু করে সকলের জন্য মর্যাদাকর একটি জাতীয় পরিচিতি নিশ্চিত করে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তিনি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ‘তোরা সবাই বাংগালী হয়ে যা’ জাতীয় অমর্যাদাকর, উস্কানিমূলক বক্তব্যের আলোকে গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল তিনি তা মেরামতের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেন। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তিনি করেছিলেন, তা হলো নব্বই ভাগ মানুষের চিন্তা চেতনাকে ধারণ করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি প্রণয়ন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করে ইসলামের মূলশিক্ষা তাওহীদ বা একত্ববাদকে তিনি ‘আল্লাহর প্রতি পূর্ণআস্থা ও বিশ্বাস’ নামে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। ধর্মহীনতার প্রতীক বিভ্রান্তিকর মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে তিনি বাদ দেন। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তাঁর যে দূরদর্শিতা পরিলক্ষিত হয়েছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব ও অসাধারণ। এর মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের আবহমান ঐতিহ্যকে যেমনভাবে তুলে ধরেন, তেমনি সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবোধ সৃষ্টি করতেও সক্ষম হন। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব নতুনভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবনা শুরু করে।
শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশিদের মেধার অভাব নেই, প্রয়োজন শুধু যথাযথ পরিচর্যার। তিনি দেশের বুদ্ধিজীবী- পন্ডিতদের আন্তরিকতার সাথে সম্পৃক্ত করলেন রাষ্ট্র পরিচালনার নানা কর্মকান্ডে। এক্ষেত্রে কে কোন মতের তা তিনি দেখেননি। দেশের প্রতি তাদের যে দায়িত্ববোধ আছে তার আলোকে তাঁরা দেশকে যা দিতে পারেন তার সমন্বয় সাধন এবং সে আলোকে জাতীয় উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন এটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ জন্যই তাঁর পরামর্শকদের মধ্যে যেমন ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত মনীষী মোজাফফর আহমেদ তেমনি ছিলেন বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান। নবীন প্রজন্মের মেধাগুলো যেন ঝরে না পড়ে, তাদের মধ্যে যেন দেশপ্রেমই সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পায়, তাদের মেধা যেন দেশেরই কল্যাণের জন্য নিবেদিত হয় এজন্য শহীদ জিয়ার কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যেগ ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের সেরা মেধাবী সন্তানদের তিনি জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত ও মূল্যায়িত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর গৃহীত নৌবিহারের কথা স্মরণযোগ্য। দেশের নবীন মেধাবী মুখগুলোকে নিয়ে তিনি ‘হিযবুল বাহার’ এ সমুদ্র ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। নবীনদের দীক্ষা দিতে সংগে নিয়েছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের। এর মাধ্যমে তিনি নবীন-প্রবীণের মধ্যে এক অন্যরকম সেতুবন্ধন রচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এই সমুদ্র সফরে সমবেতদের উদ্দেশ্যে মধ্য সমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন ‘আমি তোমাদেরকে অন্য কোথাও না নিয়ে এ সমুদ্রে নিয়ে এসেছি সমুদ্রের ন্যায় তোমরা যেন বিশাল হৃদয়ের আর সবার জন্য উদারচিত্ত হতে পার সে শিক্ষা হাতে কলমে দেয়ার জন্যই ...।’ রাষ্ট্রীয় কাজের চরম ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করা এবং জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের গড়ার জন্য এমন নিখুঁত পরিকল্পনা গ্রহণ একজন স্টেটসম্যানের পক্ষেই শুধু সম্ভব।
জিয়াউর রহমানের বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মকান্ডের পরিধি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর দেশপ্রেম, দেশগঠনে তাঁর পরিকল্পনা, দক্ষতা-যোগ্যতা তাঁকে তৃতীয় বিশ্বের এক ‘লড়াকু সৈনিকের’ ইমেজ এনে দিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রথমবারের মতো অনুভূত হতে শুরু করেছিল তাঁর গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই। একদিকে সফল কূটনৈতিক পলিসির মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক একটা সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারা, অপর দিকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতির আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রে সামান্য অপমান বরদাশত না করার এক সমন্বয়ধর্মী পররাষ্ট্রনীতির প্রণেতা তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট সার্ক এর স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়কালটায় অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামী উম্মাহর সাথে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই সম্ভবপর হয়েছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অবাক করার মতো। মুসলিম বিশ্বের নানামুখী সমস্যা-বিরোধ মেটাতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে তাঁর উদ্যোগ ও ভূমিকার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এভাবে ওআইসিকে শক্তিশালীকরণ, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মুসলিম উম্মাহর যথাযথ অংশগ্রহণ, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন প্রভৃতি ইস্যুতে জিয়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা ইতিহাসে তাঁকে অমর করে রেখেছে। মরক্কো, সেনেগাল, তুরস্কসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে শহীদ জিয়ার নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কী অসাধারণ যোগ্যতা নিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন যার প্রভাব আন্তর্জাতিক মহলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ করে মুসলিম জাহানের মজলুম মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।