Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বজ্রপাতে সচেতনতার বিকল্প নেই

আবু সালেহ মোহাম্মদ সায়েম | প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০২০, ১২:০১ এএম

দেশে বজ্রপাত শুরুর সময় ধরা হয় এপ্রিল মাস। জুন পর্যন্ত আকাশে ঘন কালো মেঘ থাকে। সেপ্টেম্বর পর্যস্ত বজ্রপাত থাকলেও শুরুর তিন মাসকে ‘পিকটাইম’ গণ্য করেন বিশেষজ্ঞরা। এবার বজ্রপাতের ভয়ংকর রূপ দেখা গেছে এপ্রিলেই, প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৮৩ জন, যা গত বছরের এপ্রিল মাসের তুলনায় প্রায় চার গুণ। করোনা ভাইরাসের কারণে চলমান পরিস্থিতিতে এ বছর বজ্রপাতে কম মৃত্যুর আশঙ্কা করেছিলেন সংশ্নিষ্টরা। পেটের তাগিদে খেটে খাওয়া, ক্ষুধার তাড়নায়, ঘর থেকে বাইওে যাওয়া মানুষগুলোই বজ্রপাতের শিকার হচ্ছে। নিহতদের অধিকাংশই পুরুষ। এ বছর নিহতদের মধ্যে ২৫ জনই কৃষক। বজ্রপাতে নিহতদের বেশিরভাগই কর্মঠ ব্যক্তি, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চলতি বছরে গত ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল তিন দিনে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩৬ জন। ২২ এপ্রিল ৬ জেলায় ১৪ জন, ২৩ এপ্রিল ৭ জেলায় সাতজন এবং ২৪ এপ্রিল ১২ জেলায় ১৫ জন মারা যায়। ৪ এপ্রিল শুরু হয় মৌসুমের প্রথম বজ্রপাত। প্রথম দিনেই মারা যায় তিনজন। এ পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯ জন চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপর ঢাকা বিভাগে ১৮ জন, বরিশালে ১২, ময়মনসিংহে ১১, খুলনায় ৮, সিলেটে ৬, রংপুরে ৫ এবং রাজশাহীতে ৪ জন। এদের হারিয়ে একেকটি পরিবার দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে।

ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের মতে- বিশ্বে মোট বজ্রপাতের এক-চতুর্থাংশ বাংলাদেশে ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত এক দশকে (২০১০ থেকে ২০১৯ সাল) দেশে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজার ৮১ জন। ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি, ৩৫৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৬ সালে চার দিনে ৮১ জনের প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসে সরকার। বজ্রপাতের এমন ভয়াবহতার কারণে ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে ”জাতীয় দুর্যোগ” বলে ঘোষণা দেয় সরকার।

পানিচক্রের নিয়মে জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ আকারে আকাশে আশ্রয় নেয়। এই মেঘ-ই হল বজ্রপাতের ব্যাটারি। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মেঘ, বৈদ্যুতিক চার্জের আধারের মত আচরণ করে। যার উপরের অংশ পজিটিভ এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জে চার্জিত থাকে। মেঘ কিভাবে চার্জিত হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ মতভেদ থাকলেও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হচ্ছে, পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প কণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। এই মুক্ত ইলেকট্রন গুলো মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপরপৃষ্ঠে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে মেঘগুলো শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটর এর বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরে চার্জ তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। -এভাবে বাষ্পকণা ও মেঘে সংঘর্ষ চলতে চলতে মেঘের উপরে এবং নিচে যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এতটাই শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরী করে যে তার বিকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থানরত ইলেকট্রন গুলো ভূপৃষ্ঠের আরো গভীরে চলে যায়। ফলে ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ শক্তিশালী পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখন বজ্রপাতের জন্য শুধু প্রয়োজন বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সামান্য একটু বাহক বা কন্ডাক্টর। মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুতক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের অপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়। যাকে বলে Dielectric Breakdown। মেঘে অবস্থিত বিদ্যুতক্ষেত্র যখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয়(প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০,০০০ ভোল্ট), তখন তার আশেপাশের বাতাস পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জে বিভক্ত হয়ে যায়। এই আয়নিত বাতাস প্লাজমা নামেও পরিচিত। বাতাস আয়নিত হয়ে মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের পথ বা শর্ট সার্কিট তৈরী করে দেয় এবং বজ্রপাত ঘটায়। আয়নিত বাতাস বা প্লাজমা পরিবাহী হওয়ার কারণে এতে ধাতব বৈশিষ্ট্য প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই বাতাসের অক্সিজেনের সাথে প্লাজমার বিক্রিয়ায় বজ্রপাতের স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়।

প্রাণহানি কমাতে অন্তর্র্বতীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় মোবাইল ফোনের টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগানো যেতে পারে। তবে কম কাভারেজ ও ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় সরকার এ পদ্ধতির দিকে যাচ্ছে না। সরকারিভাবেই বিদ্যুতের খুঁটিতে এরস্টোর লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল অনেক আগেই, তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। বজ্রপাতের ভয়ে গত বছর সুনামগঞ্জের হাওরে ধানকাটা শ্রমিক যেতে চায়নি, ফলে ধানকাটা বন্ধ ছিল। এ বছরেও বজ্রপাতের ঘটনায়, ভয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেকেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘর থেকেই বের হচ্ছেনা। বজ্রপাতের সময়সীমা ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট। খোলা স্থানে বজ্রপাত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। এ জন্য হাওরাঞ্চলে বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসানো যেতে পারে।

তাছাড়া আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। বাইরে থাকলে এই পরিস্থিতিতে নিকটস্থ সুবিধামতো স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রঝড় যখন শুরু হয়, তখনই বাজ,বিদ্যুৎ চমকানি বা বজ্রপাত শুরু হয় না। প্রথমে মেঘটা তৈরি হতে থাকে এবং সেই সময় আকাশের অবস্থা খুব ঘন কালো হয় না। সামান্য বৃষ্টি ও হালকা বিদ্যুৎ চমকায় আর তখনই আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। যেহেতু বাজ পড়লে আর নিস্তার নেই তাই সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। সচেতনতার জন্য গৃহিত পদক্ষেপ সমূহ: আকাশে ঘনকালো মেঘ দেখা দিলে বজ্রপাতের আশংকা তৈরি হয়। ৩০-৪৫ মিনিট বজ্রপাত স্থায়ী হয়, এ সময়ে ঘরে অবস্থান করাই শ্রেয়। খুব প্রয়োজন হলে রাবারের জুতা পায়ে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ বা উঁচু স্থানে অবস্থান করা যাবে না। এ সময়ে ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি হাঁটু গেড়ে, কানে আঙুল দিয়ে, মাথা নিচু করে বসে পড়তে হবে। খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যেতে হবে। খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না। সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকা যাবে না। বাড়ির জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভিতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।বজ্রপাতের সময়ে ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। প্রয়োজেেন প্লাস্টিকের অথবা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে হবে। খোলা মাঠে খেলাধুলা করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরা যাবেনা। যদিও বৃষ্টির সময় মাছ বেশি ধরা পড়ে। তবে এ সময় নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে অকস্থান করতে হবে। ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। উপায় না পেয়ে যদি বৈদ্যুতিক খুটির আশেপাশে থাকেন তবে খেয়াল কওে দেখুন বৈদ্যুতিক খুটির আরতিনের লাইনের তার খুটিটিকে পেচিয়ে মাটিতে পুতানো আছে কিনা? না থাকলে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করুন। বজ্রপাতে আহতদের বৈদ্যুতিক শকের মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে।

বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির হার কমানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে কোন এলাকায় বৈদ্যুতিক খুটি নির্মানের সময় খেয়াল রাখতে নিউট্রাল/আরথিনের তার মাটির কতটুকু নিচ অবধি পুতা হয়েছে। তারটি নিশ্চিত করাটা এলাকাবাসীর কর্তব্য। বাড়ি তৈরির প্লানিং পাশ করার সময় রাজউক কর্তৃক ডিজাইন যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বজ্রনিরোধক তার/দন্ড রয়েছে কিনা? তা খতিয়ে দেখতে হবে।

ইতিমধ্যে,বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির হার কমানোর জন্য দশ লক্ষাধিক তাল গাছ রোপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকার। নি:সন্দেহে ভালো উদ্দোগ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে তাল গাছ রোপণ ঠিক আছে কিন্তু বজ্র নিরোধনে এই সিদ্ধান্ত কতটা বিজ্ঞানসম্মত? প্রশ্নের অবকাশ রয়েই যায়। তবে একটি তাল গাছ বীজ থেকে চারা উৎপাদন কওে তা রোপন করার পর পরিপুষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর। এই সময়টুকুতে মোবাইল ফোনের টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর, বিদ্যুতের খুঁটিতে এরস্টোর লাগিয়ে, মিডিয়াতে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বার বার প্রচার করে মানুষকে আরো বেশি সচেতন করতে হবে।

প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পিকটাইম
আরও পড়ুন