Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবু তালেবের মুখে ছিল কলেমা এবং হজরত আলী (রা.) এর শাহাদত

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

‘রমজান দুই সুহৃদের মৃত্যুতে মহানবী (সা.) শোকবর্ষ ঘোষণা করেন’- শীর্ষক নিবন্ধে আমরা মহাত্মা আবু তালেব সর্ম্পকে আলোচনা করেছি। তাতে আবু তালেবের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে বিতর্কের বিষয় এসেছে, মৃত্যুর পূর্বে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আহবানে সাড়া দেননি। তবে এটা খুব সম্ভব রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জন্য দোয়া করেছিলেন এবং তিনি জীবিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে কলেমা পাঠ করেন। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পিতামাতার জন্য দোয়া করেছিলেন। তারা জীবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে উলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন। এসকল ঘটনাকে রসুলুল্লাহ (সা.) এর মোজেযা হিসেবে গণ্য করা হয় ।

আবু তালেবের মৃত্যুর সময়ের ঘটনাটি ভিন্ন রকমেও বর্ণিত হয়ে থাকে। তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অবস্থা খারাপ হয়ে যান, তখন কাফের নেতৃবর্গের মধ্যে উতবা, শাইবা, আবু জেহেল, ওমাইয়া ইবনে খলফ, আবু সুফিয়ান প্রমুখ তাকে দেখতে যান এবং বলেন, ‘হে আবু তালেব! আপনার অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে এবং আমাদের সাথে আপনার ভাতিজার যে বিরোধ রয়েছে সে সম্পর্কে আপনি জ্ঞাত আছেন। ভালো হতো, আপনি তাকে ডেকে আমাদের ও তাঁর কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করতেন যে, আমরা তাঁর শত্রুতা হতে বিরত থাকবো এবং তিনিও আমাদের শত্রুতা হতে বিরত থাকবেন। তিনি আমাদের এবং আমাদের দ্বীনের সমালোচনা করবেন না, আমরাও তার এবং তার দ্বীনের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকবো।’ আবু তালেব রাসূলুল্লাহ (সা.) কে ডেকে পাঠান এবং বলেন, ‘হে আমার প্রিয় ভাতিজা! জাতির এ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তোমার সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে চান, তারা খোদ কিছু অঙ্গীকার করতে চান এবং তোমার কাছ থেকেও কিছু ওয়াদা নিতে চান।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে চাচা! আমি তাদের কাছ থেকে কেবলমাত্র একটি কথা চাই।’ আবু জেহেল বললেন, ‘আমরা দশ কথায় রাজি আছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আপনি একবার বলুন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আপনারা এক আল্লাহ ব্যতীত যে বস্তুর এবাদত, মূর্তিপূজা করেছেন তা থেকে বিরত হোন।’ এ কথা শুনে তারা সবাই দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘মোহাম্মদ (সা.)! আপনি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন। আপনি কি চান, আমরা সমস্ত মাবুদকে ত্যাগ করে শুধু একজনের হয়ে যাব।’ অতঃপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকে যে, ইনি তোমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো কথায় রাজি হবেন না। কোরআনে এ ঘটনার কথা উল্লেখিত হয়েছে। কাফেরদের চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক চেষ্টা করেন আবু তালেব যেন এ অবস্থায় মূর্তিপূজা হতে তওবা করে মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তিনি তা মানলেন না। অবশেষে ঘাঁটি হতে বের হওয়ার ৮ম মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন। (আছাহ-আস-সিয়ার)
আবু তালেবের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে মোহাদ্দেসীন এবং সীরাত লেখকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এখানে আমরা সেই দীর্ঘ বিতর্কে অবতীর্ণ না হয়ে হজরত আব্বাস (রা.) এর একটি বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে আবু তালেব প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই। আব্বাসও ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা। আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি। ভ্রাতা আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর সময় আবু তালেবের ঠোঁট নড়ছিল।’ হজরত আব্বাস (রা.) যিনি তখনও কাফের ছিলেন, তিনি কান পেতে শুনলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বললেন, ‘আপনি যে কলেমার কথা বলেছিলেন আবু তালেব তাই বলছিলেন।’ আল্লামা সুলায়মান নাদভী হাশিয়ায় বলেন, ‘উল্লেখিত বাক্যটি মুসলিম শরীফে আছে, বোখারী শরীফে নেই।’ (সীরাতুন্নবী, পৃষ্টা- ২৪৮)
আবু তালেবের ইসলাম গ্রহণ বিতর্কিত হলেও তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শুরু থেকে আবু তালেবের শেষ জীবন পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিরাপত্তা এবং কাফেরদের শত্রুতা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছেন, বিশ্ব ইতিহাসে তাঁর দৃষ্টান্ত বিরল। তাই তার মৃত্যু ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য নিদারুণ মর্মান্তিক ও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সুতরাং, তিনি আবু তালেবের মৃত্যু পরবর্তী গোটা বছরটাকেই ‘আমুল হোজন’ বা শোকাবহ বছর হিসেবে ঘোষণা করেন সে কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আমিরুল মোমেনীন হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা। তাঁর প্রতিভা, যোগ্যতা এবং জ্ঞান-পান্ডিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব সর্ম্পকে রসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি উক্তিই যথেষ্ট। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আনা মাদিনাতুল ইলমি ওয়া আলিয়্যূন বাবুহা’ অর্থাৎ আমি ‘ইলমের’ তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের শহর এবং আলী (রা.) সেই শহরের প্রবেশদ্বার।
তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম ছিল আবুল হাসান ও আবু তোরাব। যুবকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল বারো বছর (মতান্তরে ৮/১০/১৫/১৬ বছর)। তাবুক যুদ্ধ ব্যতীত তিনি সকল যুদ্ধে রসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন। তাবুক যুদ্ধের সময় হুজুর (সা.) পরিবার-পরিজনের দেখভাল করার জন্য তাঁকে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন। এ ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি আলী (রা.)কে বলেছিলেন, ‘তুমি কি পছন্দ কর যে, আমার পক্ষ হতে তুমি সে মর্যাদার অধিকারী হবে, যা হযরত হারুন (আ.) এর অর্জিত হয়েছিল হযরত মূসা (আ.) এর পক্ষ হতে।’ হযরত উসমান (রা.)কে শহীদ করার পর হিজরী ৩৫ সালের ১৮ জিলহজ্জ জুম্মার দিন তাঁকে খলিফা মনোনীত করা হয়। তাঁর খেলাফতকাল ছিল ৪ বছর ৯ মাস কয়েকদিন। শাহাদত এর সময় (২১ রমজান ৪০ হিজরী) তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর (মতান্তরে ৫৮/৭০ বছর) ।
আব্দুর রহমান ইবনে মুলজেন মুরাদী কর্তৃক আমিরুল মোমেনীন আলী (রা.) আক্রান্ত হন। আততায়ী হামলা পরিচালনা করে হিজরী ৪০ সালের ১৮ রমজান শুক্রবার ফজরের সময়। তিন রাত পর ২১ রমজান তিনি শাহাদত বরণ করেন। তাঁর দুই পুত্র হজরত ইমাম হাসান (রা.), হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) তাঁর গোসল দেন এবং ইমাম হাসান (রা.) তাঁর নামাজে জানাজা পড়ান এবং ভোরে (মতান্তরে রাতে) তাঁকে দাফন করা হয়। এ সম্পর্কে বলা হয় যে, সতর্কতার জন্য তাঁর কবরের স্থান গোপন রাখা হয়। কেননা শত্রু রা তাঁর লাশের অবমাননা বা লাশ সরিয়ে ফেলার আশংকা ছিল। তাই অনেক দিন পর্যন্ত কেউ জানতো না হজরত আলী (রা.) কবর কোথায়? ইতিহাস হতে জানা যায়, আব্বাসীয় খলিফা হারুন উর রশীদের আমলে তিনি হজরত আলীর কবর আবিষ্কার করেন নজপ আসরাফে, যা আজও মুসলমানদের পবিত্র জিয়ারতগাহ হিসেবে পরিচিত। মুসলমানগণ সেখানে তাঁর কবর জিয়ারত করতে গমন করে থাকেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মহানবী (সা.


আরও
আরও পড়ুন