পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবীই এখন আক্রান্ত । ইতিমধ্যেই দু’শর বেশি দেশো ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। এসব দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিহত এবং অসুস্থ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আক্রান্তদের অনেকেই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে এবং এক্ষেত্রে সুস্থতার হার নব্বই শতাংশের বেশি। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে পৃথিবী জুড়ে দেশে দেশে লকডাউন চলছে । এই লকডাউনের কারনে এখন সব কিছু বন্ধ। অফিস আদালত, কলকারখানা , নির্মাণ কাজ, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, খেলাধুলা, যানবাহন, যাতায়াত, শপিং মল, র্পযটন কেন্দ্রসহ প্রায় সবকিছুই বন্ধ। ফলে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনে এক প্রকার স্থবিরতা নেমে এসেছে। অর্থনীতির চাকা বন্ধ থাকার কারণে অর্থনীতিতে বির্পযয় নেমে এসেছে। শ্রমজীবি এবং দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়েছে, ফলে তাদের জীবনে সীমাহীন কষ্ট নেমে এসেছে। আজ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ এক অর্থনৈতিক মন্দার আশংকা তৈরী হয়েছে। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন কোন অবস্থায়ই সমাধান নয়। মূলত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতনতার সাথে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাÐ চালু রাখতে হবে । মানব জাতির সামনে এর কোন বিকল্প নেই। এটাই বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতা আমাদেরকে মানতেই হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলেছেন। সেগুলো হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর সাবান দিয়ে কমপক্ষে বিশ সেকেন্ড হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরা এবং যতটুকু সম্ভব ঘরে অবস্থান করা । অপরিস্কার হাত মুখে দেয়া যাবে না , হ্যান্ডশেক করা যাবে না এবং কোলাকুলি করা যাবে না। হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় হাত বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা ইত্যাদি। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেনটাইম এবং আইসোলেশনে থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে অর্থাৎ দুই জনের মাঝখানে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই জন সমাগাম করা যাবে না। এসব স্বাস্থ্যবিধি সত্তে¡ও করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে। এদিকে বিজ্ঞানীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে এখনো র্পযন্ত কার্যকর কোন ভ্যাকসিন বা ঔষধ আবিস্কার করতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, এই করোনাভাইরাস বছরের পর বছর ধরে বিদ্যমান থাকবে এবং এ সংকট থেকে মানবজাতির সহসা মুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় করোনা পরিস্থিতিকে একটি সমস্যা হিসাবে মানতে হবে এবং এই সমস্যার মাঝেই মানব জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আর লকডাউনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। তা নাহলে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মরবে, তার চেয়ে হাজার গুণের বেশী মানুষ না খেয়ে মরবে এবং বিশ্বব্যাপী একটি মানবিক বির্পযয় নেমে আসবে, যা কন্ট্রোল করা কারো পক্ষে সম্ভব হবে না ।
করোনাভাইরাসের হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দেশে দেশে লকডাউন ঘোষনা করেছে। ফলে পুরোবিশ্ব এখন স্থবির এবং অর্থনীতির চাকা বন্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই লকডাউন কতদিন চলবে এবং অর্থনীতির চাকা কতদিন বন্ধ থাকবে। কারণ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্য খাদ্যের উৎপাদন তো করতে হবে। বস্ত্র এবং চিকিৎসার সামগ্রীর উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র এবং চিকিৎসা সামগ্রী যতই মজুদ থাকুক না কেন তা দিয়ে বড় জোড় তিন/চার মাস চলবে। কিন্তু যথাসময়ে নতুন খাদ্য এবং পণ্য উৎপাদিত না হলে মানুষ খাদ্য এবং চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে। শিক্ষা জাতির মেরুদÐ। শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতেই হবে। লকডাউনের কারণে এখন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং এবছরের এইচএসসি পরীক্ষা এখনো সম্পন্ন হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে এইচএসসি পরীক্ষা সমপ্ন্ন না হলে যারা এসএসসি উত্তীর্ণ হবে তারা কোথায় ভর্তি হবে। আবার বিশ্ববিদ্যায়/ মেডিক্যাল/ প্রকৌশল শিক্ষায় প্রথম বর্ষের ছাত্ররা দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ না হলে এইচএসসি উত্তীর্ণরা ভর্তি হয়ে সেশন জটে পড়বে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বস্থরে সেশনজট লেগে যাবে এবং একটা হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ অবস্থার উত্তরন ঘটাতে হলে অতি দ্রæত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ছাত্র শিক্ষক সবাই যার যার ক্লাসে উপস্থিত থাকবে এবং এটাই সমাধান। একইভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সকল প্রকার অফিস আদালত চালু করতে হবে। কল কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে হবে। যানবাহান চলাচল শুরু করতে হবে। খেলাধুলা শুরু করতে হবে। শপিং মল খুলে দিতে হবে এবং র্পযটন খাত খুলে দিতে হবে। এক কথায় সকল ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ চালু করতে হবে। কারণ এর দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। এ লকডাউনের সময়েও কিছু মানুষ কন্টিনিউ কাজ করেছে। ডাক্তার, নার্সসহ চিকিৎসার সাথে জড়িতরা সবাই কাজ করেছে এবং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করেছে। সেনাবাহিনী এবং পুলিশবাহিনীর সদস্যরা কাজ করেছে এবং তারাও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করেছে। ব্যাংকাররাও কাজ করছে। অনেক মানুষ ব্যাংকে গিয়েছে এবং লেনদেন করেছে। একইভাবে রাষ্ট্রের জরুরী বিভাগের লোকজনও কাজ করেছে। ঔষধ কারখানার লোকজন কাজ করেছে এবং ঔষধ উৎপাদন করেছে। ঔষধের দোকান এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খোলা ছিল। আবার কাঁচা বাজারও খোলা ছিল। রাস্তাঘাটে রিক্সা চলাচল অবাধ ছিল। জরুরী প্রয়োজনে বিমান ও চলাচল করেছে এবং যাত্রীও পরিবহন করেছে। কৃষকরা দলবেধে ধান কেটেছে এবং শত শত মানুষ এক সাথে হাওরের ধান কেটেছে। সাংবাদিকরা কাজ করেছে। মিডিয়ার কর্মীরা কাজ করেছে। টিভি চ্যানেলগুলো আগের মতই সার্বক্ষণিক খোলা ছিল এবং চব্বিশ ঘন্টাই অনুষ্ঠান প্রচার করছে। দৈনিক পত্রিকা নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে। এসব কাজে যারা নিয়োজিত তারা স¦াস্থ্যবিধি মেনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাÐও ধীরে ধীরে শুরু করা যেতে পারে।
এই পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি রয়েছে, যা আগেও ছিল এখনো আছে। এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়তই বহু মানুষ মারা যাচ্ছে এবং এ সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু তাই বলে জীবন থেমে নাই। সড়ক দুর্ঘটনায় ও প্রতিদিন বহু লোক মারা যাচ্ছে। তাই বলে যানবাহনের চলাচল বন্ধ নাই। এই পৃথিবীতে বিদ্যমান শত ধরনের রোগব্যাধির মতই করোনাও একটি রোগ। অন্যান্য রোগ ব্যাধির সাথে যুদ্ধ করে মানুষ যেমন বেচেঁ আছে, ঠিক তেমনি করোনার সাথে যুদ্ধ করেও মানব জাতিকে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু কোন অবস্থায় জীবনকে স্থবির করা যাবে না এবং অর্থনীতির চাকা বন্ধ রাখা যাবে না। কারণ ক্ষুধা লকডাউন মানে না এবং নিয়মিত খেতে হয়। অনেকে হয়ত বলবেন, করোনা একটি মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগ। সংক্রমণের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় এবং মানুষ আক্রান্ত হয়। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ছোঁয়াছে না হওয়া সত্তে¡ও অনেক মানুষ প্রতিদিনই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা, করোনার এই বাস্তবতাকেও মেনে নিয়ে জীবন চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবকিছু বন্ধ করে বসে থাকলে হবে না। এটা কোন সমাধানও নয়। তাই লকডাউন ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাÐ শুরু করা প্রয়োজন।
যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম লকডাউনের প্রয়োজন আছে। তবে তা কতদিন? করোনাভাইরাসের প্রকোপ যদি চলতেই থাকে, তাহলে কি লকডাউনও চলতে থাকবে? অর্থনীতির চাকা কি বন্ধই থাকবে? যানবাহন চলাচল কি বন্ধই থাকবে? স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কি বন্ধই থাকবে ? এসব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না । বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকার এ দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং এ সমস্যা সমাধানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বেইল আউট প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অবশ্যই এটি একটি ভাল উদ্যোগ এবং এটি সময়ের দাবি। কিন্তু বেইল আউট প্যাকেজ হচ্ছে একটি সাময়িক সমাধান মাত্র। দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন এবং অর্থনীতির চাকা বন্ধ রাখলে কোন বেইল আউট প্যাকেজেই কাজ হবে না। অর্থনীতির চাকা বন্ধ থাকলে সরকার কর্তৃক বেইল আউট প্যাকেজে বরাদ্দকৃত অর্থ কোথা হতে আসবে? উৎপাদন না হলে খাবে কি আর পরবে কি? লকডাউন এবং অর্থনীতির কর্মকাÐ বন্ধ থাকলে শত কোটি মানুষ যে বেকার হবে তার সমাধান কি? বেকার হওয়া মানুষগুলো যে তাদের কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলবে তার সমাধান কি? সামাজিক অস্থিরতা এবং অপরাধ যে বেড়ে যাবে তার সমাধান কি? অর্থনীতি ব্রেকডাউন করলে তার সমাধান কি? সমাধান একটাই, তা হচ্ছে লকডাউন শিথিল করা এবং সকল অর্থনৈতিক কর্মকাÐ পুনরায় শুরু করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। এই বাস্তবতা আজ আমাদেরকে মানতেই হবে। আমরা স্বাস্থ্য সচেতন হব, স্বাস্থ্যবিধি মানব, সামাজিক দূরত্ব মানব এবং অর্থনৈতিক কর্মকাÐে সক্রিয় থাকব। কোন অবন্থাতেই করোনার ভয়ে আতংকিত হব না, ভীত হব না, সাহস হারাব না এবং করোনাকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাব-এটাই হোক আমাদের প্রত্যয় ।
লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।