Inqilab Logo

রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

করোনাকালে মে দিবস এবং আমাদের করণীয়

মোহাম্মদ সায়েদুল হক | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২০, ১২:০৯ এএম

অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯, অনুসারে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৩৫ লাখ। খাতভিত্তিক শ্রমশক্তি-কৃষিখাতে নিয়োজিত ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ, শিল্পখাতে নিয়োজিত ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং সেবাখাতে নিয়োজিত ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মে নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক খাত মানে যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেমন পরিবহন শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশা চালক; যারা দিন আনে দিন খায়। মাত্র ১৫ শতাংশ শ্রমিক প্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। প্রতিবছর দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে ২৮ লাখ থেকে ২৯ লাখ নতুন শ্রমিক। কর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশ তাঁর পেশায় সন্তুষ্ট নয়। এই শ্রমিক অসন্তুষ্টির প্রভাব শুধু প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা বা সেবার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন নয়, এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত হয় সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন, পারিবারিক জীবন এবং ব্যক্তি জীবনে। আমাদের দেশে একজন কর্মজীবীর কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টির বহুবিধ যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। তবে মোটাদাগের কারণগুলো যদি বলি তাহলো-যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি না পাওয়া, নির্ধারিত সময়ে মজুরি না পাওয়া, প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ করতে না পারা, জবরদস্তি করে অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো, ছুটি না পাওয়া, নিরাপদ কর্মপরিবেশ না পাওয়া, মর্যাদা না পাওয়া, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম এবং বিনোদনের অভাব সর্বোপরি চাকরির কোনো নিশ্চয়তা না থাকা। অসন্তুষ্টি থেকে ব্যক্তি প্রায়শ হীনমন্যতায় ভোগে; কর্ম দক্ষতা সবটুকু প্রয়োগ না করে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে; সুযোগ পেলে অসৎ পন্থা অবলম্বন করে; অধঃস্তনের সাথে অন্যায় আচরণ করে। কিন্তু আমরা একটা হিসাব মেলাতে পারি না, তাহলো স্বাধীনতার পর যেসকল ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, দাতব্য বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে সেসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ফুলেফেপে এতো বড় হয়েছে যে, মাঝে মধ্যে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে বসে; সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে দ্বিধা করে না অথচ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সাথে ছল চাতুরির শেষ নেই। তৈরি পোশাক কারখানা, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রমিক শোষণের একই চিত্র দৃশ্যমান। এদের অবস্থা দেখে স্কুলে পড়া ঐ ভাব সম্প্রসারণের কথা মনে হয়, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।’ এসব কারণে সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। নিজস্ব বা আত্মীয়-স্বজনের প্রতিষ্ঠান না হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা কোনো ছাত্রের প্রথম পছন্দ সরকারি চাকরি। ১ মে ২০১৯, জাতীয় দৈনিকে দেখলাম ‘বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের মজুরি বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন।’ জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের জরিপ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ‘তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি বাংলাদেশে ১০৮, মিয়ানমারে ১৬২, পাকিস্তানে ১৮৭, কম্বোডিয়ায় ২০১ এবং ভারতে ২৬৫ মার্কিন ডলার। আর প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের মাসিক বেতন বাংলাদেশে ২৮৭, মিয়ানমারে ৩৪৯, পাকিস্তানে ৪৯২ এবং ভারতে ৫৯১ মার্কিন ডলার।’ আর্ন্তজাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় বলেছে, তৈরি পোশাক কারখানার ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। শুধু রক্তস্বল্পতাই নয়, অপুষ্টিজনিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতায়ও ভুগছেন তারা। কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতাসহ শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। এরপরও তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা যখন কথা বলেন তখন মনে হয় শ্রমিকদেরকে তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে সব বিলিয়ে দিচ্ছেন। সব সময় সরকারকে চাপে রাখেন আর কত কম সুদে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায়; ভ্যাট ট্যাক্স কত কমানো যায়; কত বেশি প্রণোদনা আদায় করা যায় সেসব নিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই কথা প্রযোজ্য। কর্মক্ষেত্রে আয় উপার্জন সন্তুষ্টির শেষ কথা নয়। ব্যক্তি জীবনে একটু অবসর বা বিনোদন এখন মৌলিক উপকরণের মতোই জরুরি। ওভার টাইমের নাম করে অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়। পরিবহন খাতে যুক্ত ৪০ লাখ শ্রমিকের প্রায় সকলেই দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করে; ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত। প্রায় ৫ লাখ নিরাপত্তা কর্মীর মধ্যে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে দৈনিক শ্রম ঘণ্টার কোনো হিসাব নেই। ১০ লক্ষাধিক হোটেল কর্মচারীর মধ্যে ৯৮ শতাংশকে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়। দোকান কর্মচারী, ঔষধ কোম্পানি এবং কনজ্যুমার প্রোডাক্ট কোম্পানির সেলস পার্সন, ডেলিভারি ম্যান, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে কিস্তি আদায়ের সাথে যুক্ত ব্যক্তি কারোর শ্রম ঘণ্টার কোনো হিসাব নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ছুটি একদিন। ৮০ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক, দুই-তৃতীয়াংশ নিরাপত্তা কর্মী, ৮০ শতাংশ হোটেল কর্মচারী সর্বোপরি কৃষিখাতে নিয়োজিত ২ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক জানেই না সাপ্তাহিক ছুটি কী জিনিস। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের ২২ লাখ রিকশাচালকের মধ্যে ৯৪ শতাংশ রিকশাচালক অসুস্থ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ জন্ডিসে আক্রান্ত। অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকের মধ্যে রিকশাচালকের উপার্জন অপেক্ষাকৃত ভালো। কিন্তু একজন রিকশাচালকের উপার্জন যখন পরিবারের ৪.৫ জন সদস্যদের মাঝে ভাগ হয়ে যায় তখন প্রয়োজনীয় ক্যালরির খাবার গ্রহণ আর সম্ভব হয় না। আবাসন খরচ, ছেলে মেয়ের শিক্ষা খরচ, চিকিৎসা ব্যয় এবং সামাজিক ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সে চলে যায় চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে। এসব কারণেই দিন দিন আমরা একটা রুগ্ন, পুষ্টিহীন, ভালোবাসাবিহীন, নিরানন্দ জাতিতে পরিণত হতে চলেছি। উচ্চবিত্তের হিসাব অবশ্য ভিন্ন। দেশের মাত্র ১০ ভাগ উচ্চবিত্তের হাতে প্রায় ৯০ ভাগ সম্পদ। এই উচ্চবিত্তরা নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য ইউরোপ আমেরিকা দুবাই সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়াতে গড়ে তুলেছে সেকেন্ড হোম। এরাই আসলে জাতির রক্ত শোষণ করে নিচ্ছে নিয়মিত। দেশকে যা দেবার তা দিচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক, তৈরি পোশাক কারখানার রক্তশূন্য শ্রমিক, রাজনীতিমুক্ত নিরীহ কৃষক এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ। তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ, এই উচ্চবিত্তের লাগাম টেনে ধরুন। যে সিআইপি আপৎকালীন সময়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের শ্রমিককে এক/দুই মাসের জন্য নিরাপত্তা দিতে পারে না, তার কাছ থেকে দেশ কী পেতে পারে? যারা বিভিন্ন অজুহাতে বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়েছেন তাদেরকে বলছি, নভেল করোনা দেখে শিক্ষা নিন, সেকেন্ড হোম আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য কতখানি অনিরাপদ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাবো, বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল কর্মক্ষম নাগরিকের জন্য উৎপাদনমুখী, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, শোভন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ ও কর্ম নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক: কৃষিবিদ ও টিভি নাট্যকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৪ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
১০ ডিসেম্বর, ২০২২
১০ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন