Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

সম্মুখ সারির করোনাযোদ্ধাদের নাজুক হাল

অ্যাডভোকেট মাওলানা রশীদ আহমদ | প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০৪ এএম

করোনা মহামারীর এমন আজাবের মধ্যেও বলা হচ্ছে, সব ঠিক আছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের পরিস্থিতি ভালো। সেইসঙ্গে ‘করতে হবে’ ‘করবো’ ‘করছি’ ধরনের বচনও চলছে। তারওপর প্রায় প্রতিদিনই নিয়মিত দেয়া বার্তা বিশ্বাস করলে মানুষ কেন ঘরে থাকবে। প্রতিদিন ‘সব কিছু নিয়ন্ত্রণে’ থাকার বার্তা দিয়ে মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান বড় বেমানান। এ রকম লাগাতার তথ্য গোপন ও চাতুরির মধ্য দিয়ে ডাক্তারদের জনগণের প্রতিপক্ষ করা হচ্ছে। আর আপনাআপনি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থাটাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রোগীর সঙ্গে ডাক্তারেরও করোনায় মৃত্যু এবং ডাক্তারসহ বহু সংখ্যক চিকিৎকর্মীর আক্রান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বার্তা পাচ্ছে বিশ্ব? বাংলাদেশে ৩ হাজারের বেশি মানুষের জন্য ডাক্তার একজনেরও কম। ১৮ কোটি মানুষকে সেবা দিতে সরকারি হাসপাতাল ছয়শ’রও কম। করোনা সংক্রমণের পর থেকে দু’চারজন করে এখন বহুসংখ্যক ডাক্তার-নার্স সংক্রমিত। অনেকে কোয়ারিন্টাইনে। আইসোলেশনে থাকার সংখ্যাও কম নয়। এর মাঝেই সংক্রমণ বাড়ছে, ডাক্তার কমছে। একের পর এক ডাক্তারসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের আক্রান্ত হওয়ার খবর এখন আর দুয়েকটি নয়। ভুরি ভুরি। সেদিন ভিডিও কনফারেন্সে গাজীপুরে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স মিলিয়ে ৩০ জনের দেহেই করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার তথ্যটি দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্যকর্মীরা কেন এতো বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবা দরকার। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদেরও এ নিয়ে ভাবা দরকার। করোনার এই কঠিন সময়ে যেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে প্রস্তুত রাখা দরকার, সেই সময় জনে জনে ডাক্তার আক্রান্ত হওয়া, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা দেশের জন্য খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে। যে হারে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে, তা চলতে থাকলে সামনে কী অবস্থা হবে? চিকিৎসা দেয়ার জন্য ডাক্তার পাওয়াই কঠিন হবে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ যে আগে থেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত তা অতীতের নানা ঘটনায় প্রমাণিত। করোনার এই দুর্বিপাকে মাস্ক, পিপিই নিয়ে যা হচ্ছে, সেটা দুর্নীতির আরেকটা পর্ব মাত্র। কিন্তু এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর কোনো বার্তা নেই। বরং তা যেন বিভাগটির জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে। দুর্নীতির নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নকল মাস্ক সরবরাহের ব্যবসার সাথে কারা জড়িত সে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাণঘাতী ভাইরাসটি গোটা দুনিয়ার আকাশকে অদ্ভূত আঁধারে ঢেকে ফেলেছে। কোনো জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ না দেখা জীবাণুটি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ সব দেশ-মহাদেশকেই ঘাড় মটকে খাচ্ছে। গোলাবারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ বা অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে থমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। দুনিয়ার সব মেরু ও গোলার্ধকেই শামিল করেছে মৃত্যুর মিছিলে। যে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে তা বাংলাদেশকেও বাদ রাখেনি। মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, হোটেলরেস্তোরাঁ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, সড়কপথ, রেলপথ, খেয়াঘাট সব সবকিছুই। স্তিমিত হয়ে গেছে মানবকুলের গতিপ্রকৃতি।
বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে সবাই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে নিজের সীমানায়। ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বন্ধ। মসজিদেও অনিয়মিত-অস্বাভাবিক অবস্থা। এই ভয়াবহতায় মা-সন্তান, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও যেন গৌন হয়ে যাচ্ছে। করোনা, ক্ষুধা, বেকারত্ব, বেতন না পাওয়ার এই দুঃসময়ে এতো বড় একটা ভয়ংকর ঘটনার দায় এবং অভিশাপ কার ওপর বর্তাবে? কে ভুগবে এর আজাব? করোনার চেয়েও শক্তিমত্তায় চুরি-চামারি অব্যাহত রেখেছে সে চাটার দল। দিনকে দিন অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় আর স্বচ্ছতা আনা যাবে কি-না, বলা যাচ্ছে না। সারাদেশে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান সদস্য চাল চুরি করে ধরা পড়েছে। এসবের প্রতিবাদে বিক্ষোভ-মিছিল হচ্ছে। এদিকে, ত্রাণের দাবিতে আবার ত্রাণ চুরির সঙ্গে পথে ত্রাণের মালে গরিব মানুষের হানা দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। গাজীপুরসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ-অবরোধ করছে। সরকারি চাল নিয়ে চুরি-দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ৬৪ জেলায় ত্রাণ সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। ত্রাণ চুরি থামানো বা কমানোর হয়তো আরো ব্যবস্থা থাকতে পারে। কিন্তু, করোনা মোকাবেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে দিয়েই করাতে হবে। বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো বিভাগকে দিয়ে সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগের এতোদিনের হ-য-ব-র-ল অবস্থাটা নতুন করে সামনে এসেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন কিছু ঘটনা। সেটা সামলাতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ‘বাইপাস’ খুঁজছে। দায়টা নিজেদের থেকে অন্য কোনোদিকে ঠেলে দেয়ার নানা চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে বিশেষভাবে বেছে নিয়েছে ডাক্তারদের। কারণ এদেশে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বাজারে ছড়িয়ে দিলেই মানুষ লুফে নেয়। এবার করোনাভাইরাস ইস্যুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সেই সুযোগটা কাজে এসেও আসেনি। জনমনে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে দেওয়া গেছে যে, ডাক্তাররা দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা আবার বুমেরাংও হয়েছে। ডাক্তারদের জন্যে পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তথ্য ছড়ানো হয়েছে। হোটেলের তালিকাও প্রকাশ করেছে। পরে ফাঁস হয়ে গেছে নোংরামিটা। ছোট করে হলেও গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পুরোটাই স্ট্যান্টবাজি। আসলে এ নিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তেমন আলোচনাই করা হয়নি। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের নার্সরা অভিযোগ করেছিলেন, তারা খাবার পাচ্ছেন না। রাত সাড়ে ১১টায় খাবার পেয়েছিলেন, তাও পচা খাবার, অভিযোগ এমনই ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল বাজেট সংকটে নাকি নার্সরা খাবার পাচ্ছেন না। খাবারের অভাবে ১২ এপ্রিল দুজন নার্সের কান্নার শব্দ শুনিয়েছিল একাত্তর টেলিভিশন। ১৫ এপ্রিল একটি ‘অফিস আদেশ’ জারি করেছে নার্সিং ও মিডওয়াইফরি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। আদেশে বলা হয়েছে, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। এর মাঝেই একদিকে ৬ জন ডাক্তারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যে সময়ে এক কোটি সচিবের চেয়ে একজন ডাক্তার বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে পিপিই’র নামে রেইনকোট বা পলিথিনের গাউন ও এন-৯৫’র নামে অত্যন্ত নিম্নমানের মাস্ক সরবারাহের অভিযোগ, সেই মন্ত্রণালয়ের সচিবের সমালোচনা করায় ডাক্তারের শাস্তি। করোনাযুদ্ধের ফ্রন্টলাইনের বীর সেনানীদের যাবতীয় নিরাপত্তা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। ডা. মঈনের মৃত্যু দেখিয়ে দিয়ে গেছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল। সবকিছুতে সরকারের লুকোচুরি, ব্যাপক প্রস্তুতির বাহাদুরি, সবকিছুতে ঠিক আছে, ঠিক আছে জাহিরের ফাঁকা কলস মানুষের বুঝতে এমনিতেও বাকি ছিল না। করোনা আক্রান্ত ডা. মঈনের চিকিৎসা হয়নি। রাষ্ট্র তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। ডা. মঈন কীভাবে সংক্রমিত হলেন, বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের গত সপ্তাহের তথ্য অনুযায়ী ডাক্তার-নার্স মিলিয়ে দেড় শতাধিক চিকিৎসাকর্মী করোনায় সংক্রমিত। এ সংখ্যা এখন দুশতের ওপর। কী ভয়ানক অবস্থা, ভাবা যায়? তা আমাদের চিকিৎসা ফ্রন্টের শক্তির অবস্থা জানিয়ে দিচ্ছে। অবস্থাটাকে স্বাভাবিক বলার চেষ্টা রয়েছে। তেমন অনাকাক্সিক্ষত নয় বলতে চান কেউ কেউ। যুক্তি খাটিয়ে সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে, করোনা মহামারীর চিকিৎসায় খোদ যুক্তরাষ্ট্রও কাহিল। ইতালি-ফ্রান্সের মতো চিকিৎসায় উন্নত দেশও হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের পিপিইর যে সংকটের তথ্য গণমাধ্যমে আসছে, তার সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার সংকট এক নয়। পিপিই‘র স্টান্ডার্ড সারা পৃথিবীর জন্যে একই। ইউরোপের জন্যে একরকম আর বাংলাদেশের জন্যে আরেক রকম নয়। একদিকে করোনা চিকিৎসায় দায়িত্বরত নার্সরা খাবার না পেয়ে যখন কান্না করছে, কতৃপক্ষ তখন বলছে বাজেট নাই আর জনগণের একাংশ তখনো ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের দোষারোপ করেই যাচ্ছে ।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, সাবেক সহকারী অধ্যাপক



 

Show all comments
  • jack ali ২৭ এপ্রিল, ২০২০, ৪:৩৭ পিএম says : 0
    O'Allah these criminals they love only money and how to secure their power. O'Allah we are fed up. O'Allah wipe them out these criminal from our country by coronavirus and save us from coronavirus. Ameen
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন