পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পবিত্র কোরআন নাজেল হওয়ার মাস মাহে রমজান। রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত ও রেসালাত প্রাপ্তি এবং সমাপ্তির মোট ২৩ বছর (মাক্কী ও মাদানী জীবনে) সময়কারের মধ্যে প্রতি রমজান মাসে সাধারণত কোরআন অবতীর্ণ হয় বলে এই মাসকে ‘নযূলে কোরআনে’র মাস বলা হয়। ‘ইকরা’ বা পড়–ন আল্লাহর নামে- এই বাক্য ছিল প্রথম আল্লাহর ‘অহী’ বা প্রত্যাদেশ, যা মক্কার ‘হেরা গুহায়’ অবতীর্ণ হয়েছিল এবং সর্বশেষ আল্লাহর বাণী নাযেল হয় ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিদায় হজ্জ্বের সময়। এই সর্ব শেষ আয়াতটি ছিল এই, ‘আল-ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বিনাকুম, ওয়া আতমামতু আলাইকুম নেয়ামাতি, ওয়া রাজিতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনান।’ অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার ৮১ দিন পর মহানবী রসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত হয়। ইসলাম ধর্মকে আল্লাহতাআলার পক্ষ হতে একটি পরিপূর্ণ ধর্ম ও জীবনবিধান হিসেবে ঘোষণার পর হুজুর (সা.) তিন মাসের কম সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং তিনি সমগ্র উম্মতের জন্য পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে কোরআন ও তার সুন্নাহকে রেখে যান এবং তিনি ঘোষণা করে যান যে, কোরআন ও সুন্নাহকে যে ধারণ করে চলবে সে কখনও গুমরাহ বা পথভ্রষ্ট হবে না। সুতরাং, আল্লাহর কালাম কোরআন পাঠ-অনুধাবনের গুরুত্ব যে কত অধিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত পবিত্র রমজান কোরআন নাজেল হওয়ার মাস হওয়ায় এই মাসে তার উপর আমল ও চর্চা অনুশীলনের গুরুত্বও অধিক।
মহা পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের প্রতি যথার্থ মর্যাদা প্রদান করার প্রয়োজন সর্বাধিক। কোরআনের জাহেরি বা প্রকাশ্য মর্যাদা প্রদর্শনের বিভিন্ন রীতিনীতি ও আদব রয়েছে। এগুলোর অনুসরণ করা প্রত্যেকের কর্তব্য। জাহেরি আদবের মধ্যে রয়েছে যেমন, পবিত্রতা, একাগ্রতার সাথে কোরআন তেলাওয়াত করা, এমনভাবে পাঠ করা যেন আল্লাহর সামনেই ক্বেরাত করে তাকে শুনানো হচ্ছে। কোরআন তেলাওয়াতের জাহেরি আদবগুলো পালন করার সাথে সাথে কিছু বাতিনী বা গোপন আদবও রযেছে। যেগুলোর অনুসরণ করাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কোরআন তেলাওয়াতে তার ভাব-মর্ম অনুধাবন করার চেষ্টা করাও আদবের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- আল্লাহর কালামের মহিমা-শ্রেষ্ঠত্বের কথা অন্তরে রাখা, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বের কথা অন্তরে রাখা, মনকে সর্বপ্রকার কুমন্ত্রণা ও সংশয় হতে মুক্ত রাখা এবং কোরআনের অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করাসহ আরও বহু বিষয় রয়েছে যেগুলো কোরআন তেলাওয়াতের বাতেনী দিক। কোরআন তেলাওয়াতের সাথে তা গভীর মনোনিবেশের সাথে অনুধাবন করাও একটি আবশ্যক দিক। বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আকরামা (রা.) সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি কোরআন তেলাওয়াতের সময় যখন তা খুলতেন, অজ্ঞান হয়ে পড়তেন এবং তার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, ‘হাজা কালামু রাব্বি, হাজা কালামু রাব্বি’। অর্থাৎ এটি আমার রবের কালাম, এটি আমার রবের কালাম। কোরআনের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের এটিও একটি দৃষ্টান্ত।
কোরআন তেলাওয়াতকালে মর্মের প্রতি খেয়াল রাখার গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু কেউ যদি আয়াতের অর্থ না জানে তথাপি কোরআন তেলাওয়াত করা অভ্যাসে পরিণত করলে তাতেও অপরিসীম সওয়াব রয়েছে। এ সম্পর্কে মোল্লা আলী ক্বারী, তিবরানী ও বায়হাকীর রেওয়ায়েত অনুযায়ী, যে ব্যক্তি কোরআন শরীফ পাঠ করে এবং তা মনে থাকে না তার জন্য দু’টি সওয়াব নির্ধারিত। আর যে ব্যক্তি তা ইয়াদ করার আশা পোষণ করে কিন্তু ইয়াদ করার শক্তি রাখে না, তথাপি তার তেলাওয়াত হতে বিরত থাকে না, আল্লাহতাআলা তাকে কেয়ামতের দিন হাফেজগণের সাথে তার হাশর (সমবেত) করবেন। এতে প্রতীয়মান হয়, তেলাওয়াতে কালামে পাক অত্যন্ত সওয়াব বা পূণ্যের কাজ। বিশেষত রমজান মাসে নফল এবাদতসমূহের মধ্যে তেলাওয়াত সর্বোৎকৃষ্ট এবাদত।
যথাযথভাবে কোরআন তেলাওয়াত না করলে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও করা হয় এবং এরূপ তেলাওয়াতকারীকে মোনাফেকদের তালিকায় রাখা হয়। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করা হয় যে, এই উম্মতের বহু মোনাফেক হবে। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এহয়াউল উলুম’ এ কোনো কোনো মাশায়েখের উক্তি নকল করেছেন যে, কোনো বান্দা কালামে পাকের একটি সূরা তেলাওয়াত শুরু করলে ফেরেশতাগণ তার জন্য রহমতের দোয়া করেন, এমনকি সে তেলাওয়াত সমাপ্ত করেলও। আবার কোনো ব্যক্তি একটি সূরা তেলাওয়াত শুরু করলে, তা শেষ হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তার প্রতি অভিসম্পাত করতে থাকে এবং সে জানে না যে, কোরআন তেলাওয়াত করছে। হজরত আমের ইবনে ওয়াছেলা (রা.) বর্ণনা করেন যে, হজরত উমর (রা.) নাফে ইবনে আবদুল হারেস (রা.)-কে মক্কা মোকাররমার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। একবার তাকে খলিফা উমর (রা.) জিজ্ঞাসা করেন যে, ‘জঙ্গল এলাকা শাসন কে করে থাকে।’ তিনি বলেন যে, ‘ইবনে আবজা।’ হজরত উমর (রা.) আবজার পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান যে, আবজা তার গোলাম। হজরত উমর (রা.) আবজাকে আমীর করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে নাফে বলেন যে, ‘আবজা অধিক কোরআন তেলাওয়াতকারী।’ হজরত উমর (রা.) এই হাদিস নকল করেন যে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতাআলা এই কালামের বদৌলতে বহু লোকের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং বহু লোককে অপদস্ত করেন।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যদি জ্ঞান চাও তাহলে পবিত্র কোরআনের অর্থসমূহের প্রতি চিন্তা ভাবনা কর। কেননা তাতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জ্ঞান বিদ্যমান।’ কিন্তু পবিত্র কালামের অর্থ করার জন্য যে সব শর্ত ও আদব রয়েছে সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখা কর্তব্য। হজরত বোরায়দাহ (রা.) হতে হাকেম হুজুর (সা.)-এর এই উক্তি নকল করেছেন যে, ‘যে ব্যক্তি কোরআন শরীফ পড়ে এবং তার উপর আমল করে, তাকে নূরের একটি মুকুট পরিধান করানো হবে এবং তার মাতা-পিতাকে অনুরূপ দুই জোড়া পরিধান করানো হবে, যেগুলোর মোকাবিলায় সারা দুনিয়া করতে পারবে না।’ মাতা-পিতা আরজ করবে, ‘হে আল্লাহ! এসব জোড়া কিসের বিনিময়ে?’ বলা হবে, ‘তোমাদের বাচ্চার কোরআন পড়ার বিনিময়ে।’
(দুই)
ইমাম গাজ্জালী (রহ.)-এর দশটি শর্ত: কোরআন শরীফ অনেকেই তেলাওয়াত করে থাকে, কিন্তু তেলাওয়াতের রীতিনীতি ও নিয়মাবলী হয়তো সকলের জানা নেই। সাধারণভাবে তারা আলেমগণের নিকট শুনে থাকে যে, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের সময় পবিত্র ও অজু অবস্থায় থাকা, যেখানে বসে তেলাওয়াত করা হয় সে স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, কেবলামুখী হয়ে বসা, অত্যন্ত বিনয় সহকারে তেলাওয়াত করা, অজুবিহীন অবস্থায় কোরআন স্পর্শ না করা প্রভৃতি বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রাখা যথেষ্ট এবং এ সকল আদেশ-নিয়ম মেনে চলতেই হবে। বস্তুত কোরআন মজিদ তেলাওয়াতের এগুলোর অনুসরণ যথেষ্ট হলেও তেলাওয়াতকারীর জন্য আরও কতিপয় রীতিনীতি অনুসরণ একান্ত আবশ্যক।
হজরত রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম যখন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন তখন তাদের বিনয়-নম্রতা ও ভয়ভীতির অবস্থা দাঁড়াত এই যে, কাঁদতে কাঁদতে তাদের পবিত্র দাড়ি ভিজে যেত এবং প্রত্যেকটি আয়াতের মর্ম উপলব্ধি করে তা বাস্তবে পরিণত করারও চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ যেখানে ভয়-ভীতির উল্লেখ থাকত সেখানে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত ভাব প্রকাশ করতেন এবং চেহারা হলদে বর্ণ হয়ে যেত এবং গোটা দেহ প্রকম্পিত হয়ে উঠত। আবার যে আয়াতে আল্লাহর অসীম দানের কথা উল্লেখ থাকত সেখানে আনন্দবোধ করতেন এবং সে ভাব চেহারায় পরিস্ফুটিত হয়ে উঠত এবং তারা আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করতেন। কোরআন তেলাওয়াতের সঠিক শর্ত ও নিয়মাবলী মেনে তেলাওয়াত করলে কোরআনের অলৌকিক মহিমা ও আধ্যাত্মিক ভাব মানুষের মধ্যে সৃষ্টি না হয়ে পারে না। কোরআন তেলাওয়াতের সে সকল শর্ত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া তো দূরের কথা, কোরআনের আয়াতগুলোর শানে নুযূল ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে অনেকেই কিছু জানেন না। কিন্তু যে সকল আলেম ও ক্বারী আরবী ভাষা জানেন এবং কোরআন ভালভাবে পড়তে ও বুঝতে পারেন তাদের জন্য কোরআন তেলাওয়াতের শর্তগুলো মেনে চলা বাঞ্চনীয়। স্বয়ং আল্লাহতাআলা পবিত্র কোরআনে তার যাবতীয় রীতিনীতির সাথে তেলাওয়াতের সময়ও নির্ধারিত করে দিয়েছেন। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার বিখ্যাত ‘এহয়াউল উলুম’ গ্রন্থে কোরআন তেলাওয়াতের যে দশটি শর্তের উল্লেখ করেছেন সে শর্তগুলো নিম্নরূপ:
প্রথম শর্ত: কোরআনের মাহাত্ম্য অনুধাবন এটা চিন্তা করা যে, আল্লাহতাআলার অনুগ্রহ মেহেরবাণীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা যে, তিনি আরশ হতে অবতরণ করে তার সৃষ্টিকে আমল করার ও অনুধাবন করার স্তর পর্যন্ত নিকটবর্তী হয়েছেন।
দ্বিতীয় শর্ত: বর্ণনাকারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তেলাওয়াত আরম্ভ করার সময় তেলাওয়াতকারীর অন্তরে বর্ণনাকারীর মহিমার কথা স্মরণ করতে হবে এবং তার জানা উচিত সে যা পাঠ করছে, তা কোনো মানুষের কালাম নয়। আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত এটিকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।’
তৃতীয় শর্ত: ‘একাগ্রতা’। তফসীরে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ইয়াহিয়া, কেতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর।’ এর অর্থ হলো, উজতেহাদ চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাও। অর্থাৎ কোরআন তেলাওয়াতের সময় সকল চিন্তা-ভাবনা ও মনোযোগ সহকারে তা পাঠ করা। কথিত আছে যে, পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক বুজর্গের নিয়ম ছিল এই যে, কোনো আয়াত পাঠ করার সময় যদি তার অন্তর সে দিকে ধাবিত না হতো তবে পুনরায় আয়াতটি পাঠ করতেন।
চতুর্থ শর্ত: চিন্তা। অনুধাবন করা ক্বেরাতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে চিন্তা-অনুধাবন করা এবং তারতিলের (ধীরে ধীরে) পাঠ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তার ভাব সম্পর্কে চিন্তা-অনুধাবন করা।
হজরত আলী (রা.) বলেন, যে ক্বেরাতে চিন্তা অনুধাবন করা হয় না, তাতে কোনো কল্যাণ নেই। যদি পুনরাবৃত্তি করা ব্যতীত অনুধাবন করা না যায়, তাহলে পুনরাবৃত্তি করা উচিত। হ্যাঁ, ইমামের পিছনে ক্বেরাত শ্রবণ করলে সে অবস্থায় চিন্তা-অনুধাবনের প্রয়োজন নেই।
একটি রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে, একদা হুজুর (সা.) ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ পাঠ করলেন এবং বিশবার তার পুনরাবৃত্তি করলেন। এই পুনরাবৃত্তির উদ্দেশ্য ছিল তা অনুধাবন করা ও তার মাহাত্ম্য সম্পর্কে চিন্তা করা। হজরত আবুজর (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সা.) একদিন আমাদের সাথে নামাজ পড়ছিলেন এবং একটি আয়াত তিনি বারবার পাঠ করলেন। একজন বুজর্গ বলেছেন, যে আয়াতের অর্থ আমি বুঝি না এবং যা পাঠ করার সময় সেদিকে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয় না, আমি সেই আয়াতকে তেলাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত করি না।
পঞ্চম শর্ত: সঠিক অর্থ বুঝা। অর্থাৎ কোরআনে যে আয়াতটি যে উদ্দেশ্যে নাজেল করা হয়েছে, তাকে সেই অর্থ বুঝা।
ষষ্ঠ শর্ত: বোধগম্যের অন্তরায়গুলো হতে বিরত থাকা, অধিকাংশ লোক কোরআনের অর্থ অনুধাবন করতে অক্ষম। তাই শয়তান নানা প্রকার অন্তরায় তাদের অন্তরে সৃষ্টি করার প্রয়াস পায় এ সকল অন্তরায় হচ্ছে চারটি: (১) সকল মনোযোগ মাখরাজে হরুফ (অক্ষরসমূহের উৎস স্থান) ও তাকে উত্তমরূপে প্রকাশ করা। (২) অনুকরণ প্রবণতা হিসেবে প্রচলিত বিশ্বাসসমূহের প্রতি আস্থা রাখা, যাতে বাপ দাদার বিশ্বাস অতিক্রম করে অদৃশ্য ভাবের প্রতি অন্তর ধাবিত হতে না পারে। (৩) বার বার পাপ কার্যে লিপ্ত হওয়া, অহংকার করা এবং দুনিয়ার মোহে লিপ্ত থাকা, এ সকল অবস্থার সৃষ্টি হলে অন্তর কালিমামুক্ত আচ্ছন্ন হয়ে যায়। (৪) কেউ জাহেরি অর্থ পড়ে বুঝল যে কোরআনী শব্দ ভান্ডারের হজরত আব্বাস ও মোজাহেদ কর্তৃক বর্ণিত অর্থ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না এবং অন্য যে কোনো অর্থ মনগড়া আর যে মনগড়া অর্থ করে তার স্থান দোজখে।
সপ্তম শর্ত: খাছ তেলাওয়াত। কোরআন তেলাওয়াতকারীর মনে করা যে, কোরআনের প্রত্যেক খেতাব বা সম্বোধন তাকেই করা হয়েছে। যদি ‘আদেশ’ বা ‘নিষেধে’র আয়াত পড়ে তাহলে মনে করবে যে, এই আদেশ নিষেধ তাকেই করা হয়েছে। যদি পূর্ববর্তীগণের কাহিনী সম্পর্কীয় আয়াতে পাঠ করে, তাহলে মনে করবে যে, কাহিনী বর্ণনা করাই কেবল উদ্দেশ্য নয় বরং শিক্ষা ও আদর্শ গড়াই এর উদ্দেশ্য।
অষ্টম শর্ত: ‘তাছির’। অর্থাৎ বিভিন্ন আয়াত হতে তেলাওয়াতকারীর অন্তরে যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং দুঃখ, ভয়, আশা ইত্যাদি অবস্থার সৃষ্টি, মাগফেরাতের প্রতিশ্রুতি, সুসংবাদ, ভীতি প্রদর্শন ও শর্তের সাথে মাগফেরাত হতে ভয়, আল্লাহর মহিমার সামনে বিনয় প্রদর্শন, জান্নাতের প্রশংসা বর্ণিত হলে সে ক্ষেত্রে অন্তরে যদি উপরোক্ত প্রতিক্রিয়া বা আস্থার সৃষ্টি না হয় এবং তার মধ্যে এ সকল গুণ না থাকে তাহলে তার মুখ নড়াচড়া করা ব্যতীত তেলাওয়াত হলো না।
নবম শর্ত: ‘তরাক্কী’। অর্থাৎ তেলাওয়াতকারী কালামে পাক স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে শ্রবণ করবে, নিজের পক্ষ থেকে নয়। ক্বেরাতের তিনটি স্তর আছে। নিম্নস্তর হলো, বান্দা এটা মনে করবে যে, সে আল্লাহর সামনে কোরআন পাঠ করছে এবং আল্লাহ তার সামনে উপস্থিত এবং তাকে দেখছেন এবং বান্দার ক্বেরাত শ্রবণ করছেন। তখন তেলাওয়াতকারী বিনয়ভাবে নিজের মধ্যে সওয়ালকারীর মতো অবস্থার সৃষ্টি করবে। এর চেয়ে উন্নত স্তর হলো, অন্তরের সাথে মনে করবে যে, আল্লাহতাআলা যেন তাকে দেখছেন এবং তার অনুগ্রহ বিতরণের সাথে তাকে সম্বোধন করছেন এবং তার পুরস্কারের সুসংবাদ শুনাচ্ছেন এবং শেষ স্তর হচ্ছে এই যে, তেলাওয়াতকারী বর্ণনাকারী ও বাক্যসমূহে ছেফাত গুণাবলী দেখবে, নিজের সত্ত্বা ও ক্বেরাতকে দেখবে না এবং পুরস্কার দানকারীর পুরস্কারকে দেখবে না। বরং তার সকল মনোযোগ বর্ণনাকারীর দিকে নিবদ্ধ রাখবে এবং সে সম্পর্কে চিন্তা করবে। যেন বুঝা যায় যে, সে বর্ণনাকারীর দিকে মগ্ন রয়েছে এবং যে ব্যক্তি এই তিনটি স্তর হতে খারিজ, সে গাফেলদের স্তরের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
দশম শর্ত: নিজের শক্তি ও নাফছের প্রতি সন্তুষ্ট ও নিজেকে সৎ ও পবিত্র মনে করা হতে বিরত থাকা। তেলাওয়াতকারী যখন প্রতিশ্রুতির ও নেক লোকদের প্রশংসা সম্পর্কীয় আয়াতগুলো পাঠ করে, তখন নিজেকে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা এবং আগ্রহান্বিত হওয়া যে, সে যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যখন নাফরমান ও পাপীদের নিন্দা সম্পর্কীয় আয়াত পাঠ করবে, তখন মনে করবে যে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। কোরআন তেলাওয়াতের উপরোক্ত শর্তগুলো অনুযায়ী, যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করবে তার ভাগ্যই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে এবং আল্লাহতাআলা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আল্লাহর ঘনিষ্ট বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন এবং এটা তাঁর রহমত ও অনুগ্রহের কাছে মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
ভয়ংকর করোনা মহামারী হতে রক্ষা পাওয়ার এবং তা প্রতিহত করার একমাত্র অবলম্বন বিশেষভাবে মুসলমানদের উচিত আল-কোরআনের দিকে রুজু করা এবং এই সৌভাগ্যবান মাসে অধিক কোরআন তেলাওয়াত করা, এর মর্ম হৃদয়ঙ্গম করা ও গভীর গবেষণা-চর্চায় আত্মনিয়োগ করা। এভাবেই এ সৌভাগ্যমন্ডিত মাস ও মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কিছুটা হলেও সম্ভব। আল্লাহতাআলা তাঁর এ মর্যাদাপূর্ণ মাস ও গ্রন্থের উসিলায় বিশ্তঙ্ক এ করোনা মহামারী হতে সমগ্র বিশ্ববাসীকে রক্ষা করুন, এটিই হোক তাঁর মহান দরবারে আজকের একান্ত প্রার্থনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।