পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রহমত-বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান। মহান রাব্বুল আলামীন এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন। সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং ইন্দ্রীয় সুখ ভোগ থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম দন্ডায়মান তার একটি রোজা। নামাজের পরই রোজার স্থান। মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নে এ মাসের রোজা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মশুদ্ধির অনন্য চেতনায় ভাস্বর মাহে রমজান। মহানবী সা. এ মাসকে এক সুমহান মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমত, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ দিনগুলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের বড় কারণ এই যে, এ মাসেই বিশ্ব মানবতার মুক্তি সনদ পবিত্র আল কোরআন নাজিল হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘রমজান সেই মাস যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। কোরআন, যা মানুষের হেদায়াত, সত্যের পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশক আর ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে।’ এ মাসেই এমন একটি রাত রয়েছে যাকে বলা হয় লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী। আল্লাহপাক এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা এটি (আল কোরআন) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জান, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষাও অধিক উত্তম।’ রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন রমজান শুরু হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়।’ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র রমজান মাস, রমজান মাসের রোজা ও অন্যান্য ইবাদত কতটা মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
পবিত্র কোরআনের সঙ্গে রমজানের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। পবিত্র কোরআনের আলোকে জীবন গঠনের একটা প্রশিক্ষণ হয় মাহে রমজানে। আত্মিক উন্নয়ন, পবিত্রতা অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের রোজার কোনো তুলনা হয় না। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ তাকওয়া অর্থ সতর্ক, সংযত ও সাবধান থাকা। আল্লাহর ভয়ে, আখেরাতের জবাবদিহির ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অশ্লীলতা, পাপ ও অপরাধ থেকে দূরে থাকা। বলা বাহুল্য, তাকওয়ার গুণ মানুষকে সকল প্রকার পাপাচার, অন্যায়, অপরাধ, অপকর্ম, অশ্লীলতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুষ্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। রোজা রেখে মিথ্যাচার, পরচর্চা, ক্রোধ, হিংসা, নিন্দা, অহঙ্কার, আত্মগর্ব, কৃপণতা, চোগলখোরী ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘রোজা রাখা সত্তে¡ও যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও পাপকর্ম থেকে বিরত রইল না, ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হওয়া ছাড়া রোজা তার কোনো কাজেই এলো না।’ রোজা মানুষকে প্রকৃত আধ্যাত্মিক ও জাগতিক মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করে, কার্যকরভাবে সহায়তা করে। আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মানবদেহের মৃত কোষগুলো খেয়ে সুস্থ কোষগুলো সতেজ ও প্রাণবান হয়ে ওঠে। রোজায় মানুষ দৈহিকভাবে অকল্পনীয় উপকার ও সুস্থতা লাভ করে। রোজা রাখা ব্যক্তিগত ইবাদত হলেও এর মর্ম অনেক গভীর ও ব্যাপক। নিজের চারপাশের পৃথিবীকে স্বস্তি দেয়া, মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন, সকলের অধিকার প্রদান ইত্যাদিই তাকওয়ার ফসল। এবার এমন এক সময় মাহে রমজান এসেছে, যখন বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব ভয়াবহ বিপদ ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মহামারী আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে। মানুষ যারপরনাই উদ্বিগ্ন, বিচলিত ও আতঙ্কিত। কার্যত সব দেশেই চলছে লকডাউন এবং সামাজিক সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম। আমাদের দেশ পুরোটা নাহলেও অধিকাংশই লকডাউনের আওতাধীন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। দেশজুড়ে চলছে ছুটি। সব কিছুই বন্ধ। এমনকি মসজিদে ব্যাপক সংখ্যক মুসল্লিসমাবেশ ও জামাতে নামাজ আদায় রহিত করা হয়েছে। সউদী আরবসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অন্যান্য বারের মতো এবার মাহে রমজানে সঙ্গতকারণেই ইফতার, তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে মসজিদে জড়ো হওয়া যাবে না। ইবাদত-বন্দেগি যা কিছুই করার, ঘরে বসেই করতে হবে। লকডাউন ও সামাজিক সঙ্গনিরোধ করোনা সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র পথ। ইসলাম এর মধ্যে আপত্তিকর কিছু দেখে না। একটি হাদিসে আছে, যারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য ও অন্যদের রক্ষা করার জন্য ঘরে বসে থাকে, তারা আল্লাহর সুরক্ষার অধীনে থাকে। মুসনাদে আহমাদ। কোথাও মহামারী দেখা দিলে সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সেখান থেকে কারো বাইরে না আসার ব্যাপারে রাসুল সা. স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। কাজেই, মাহে রমজানে ঘরে বসেই সব নামাজ, দোয়া-দুরুদ, জিকির-আজকার, পবিত্র কালামের তেলাওয়াত ইত্যাদি করতে হবে। একে মহামহিম আল্লাহর ইচ্ছা হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। আর একই সঙ্গে জাকাত, ফিতরাহ, দান-খয়রাত বেশি বেশি করে করতে হবে। করোনাকারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন ও আর্থিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবাণী এই যে, এই বৈশাখে প্রকৃতি রুক্ষ-রুদ্র না হয়ে সহনশীল, মনোরম হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি, ঝিরঝিরে বাতাস, গাছে গাছে সবুজের বিস্তার, শোভাময় ফুলের সমাহার এক ভিন্ন রকম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। রোজাদারদের জন্য এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর প্রতি অশেষ প্রশংসা। তাঁর রহমত, দয়া ও করুণা আমরা একান্তভাবেই প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে আশ্রয় প্রার্থনা করি, করোনার যাবতীয় ক্ষতি ও ভয়াবহতা থেকে।
রমজানের শিক্ষা ধৈর্য ও সংযম। রমজানের একটি নাম হচ্ছে শাহরুল মুওয়াসাত। এর অর্থ সহমর্মিতার মাস। একে অপরের প্রতি স¤প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমজানের মহান শিক্ষা। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মুসলমানদের ওপর নানা দিক থেকে আক্রমণ আসছে। অসহিষ্ণুতা, সা¤প্রদায়িক হামলা, অপপ্রচার সব মিলিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অথচ শান্তির দূত মুসলমানগণ মহান ইসলামের উদার ও মানবিক বার্তা নিয়ে বিশ্বময় এক ইতিবাচক স¤প্রদায় হিসেবে সুপ্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষা নিতে হবে সংযমের উৎকর্ষ থেকে। যেমন হাদিস শরীফে এসেছে, রোজাদারের সাথে কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এলে সে যেন বলে দেয়, আমি রোজা রেখেছি। অর্থাৎ, আমি তোমার কথার প্রতিউত্তর দেবো না। যেকোনো পরিস্থিতিতে উসকানিতে সাড়া না দিয়ে সংযম ও তাকওয়া রক্ষা করে চলাই রমজানের শিক্ষা। সহমর্মিতার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও ক্রেতা-ভোক্তাসাধারণের হাতের নাগালে রাখা। খাদ্যে ভেজাল না মেশানো এবং ওজনে কমবেশি না করা। মুসলিম বিশ্ব তো বটেই বহু অমুসলিম দেশেও ধর্মীয় উৎসবের সময় ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দেন। অমুসলিম দেশেও এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও রমজান ডিসকাউন্ট বা রমজান অফার ঘোষণা করে। বাংলাদেশে দেখা যায় এর বিপরীত প্রবণতা। অধিক বিক্রি হওয়ায় এ মওসুমে মুসলিম নাগরিকদের সিয়াম সাধনার সুবিধার্থে ব্যবসায়ীরা যদি সওয়াব ও কল্যাণের আশায় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দেন, মুনাফা কম করেন বা সম্ভব হলে সহায়তামূলক স্বল্পমূল্য নির্ধারণ করেন তাহলে রমজান ও সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে পারে। যারা বস্তাপঁচা খাদ্য সামগ্রীতে বার বার নকল তারিখ লাগিয়ে কিংবা রমজানের সুযোগে রোজাদারদের পকেট কাটার ধান্ধা করে তারা রোজার অর্থই বোঝে না। বরং রমজানের কোনো উৎকর্ষ তাদের জীবনকে স্পর্শ তো করবেই না, বরং রমজান তাদের জন্য আসবে কঠিন পরীক্ষা হয়ে। ইসলাম শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এর মূল বাণীই হচ্ছে মানবতার উৎকর্ষ। আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য আর মানুষসহ সকল সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা। পবিত্র রমজানে মুসলমানের জীবন-জীবিকার সর্বত্র সততা, সংযম ও পবিত্রতার ছোঁয়া লাগবে, এটাই কাম্য। রমজানুল মুবারকের সিয়াম সাধনার এখানেই সার্থকতা। মোবারক হো মাহে রমজান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।