Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানবসেবা মনুষ্যত্বের ভূষণ

মু. আবদুল্লাহ আল মাসুম | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই জীবনের যথার্থ স্বার্থকতা নিহিত। অপরের কল্যাণ কামনাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের স্বার্থকে ত্যাগ করার নামই মানবসেবা। এটা এমন এক ইবাদত যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের অংশ সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, সত্তরের অধিক ঈমানের শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মানুষের কষ্ট হয় এমন বস্তুকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া। (মেশকাত)। মানুষের চলাচলের সুব্যবস্থা করা। পথহারা পথিকদের সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া। অন্ধ, অসুস্থ, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের কাজে সহযোগিতা করা, অভাবী, মুসাফির ও অনাথের সেবায় এগিয়ে আসা, বস্ত্রহীনদের বস্ত্রের ব্যবস্থা করা, অসুস্থদের সেবা-শুশ্রুষার ব্যবস্থা করা, মানুষের দুঃখ-সুখের সঙ্গী হওয়া প্রভৃতি মানবসেবার অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, বস্তুত আমি তাকে (মানুষকে) ভালো-মন্দের দুটি পথ প্রদর্শন করেছি। অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ধর্মের ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান, কিংবা এতিম আত্মীয় অথবা ধূলি-ধূসরিত মিসকিনকে। (সূরা বালাদ: ১০-১৬)।

হিতৈষী মনোভাব ও সহমর্মিতার গুণ ছাড়া মানবিকতা ও মহানুভবতার বিকাশ পূর্ণতা পায় না। দুই বেলা শাহী খাবার, বিচিত্র স্বাদ আস্বাদন ছাড়া আমাদের রসনা তৃপ্ত হয় না। অথচ পাশের বস্তিতে খাবার না পেয়ে অবোধ শিশুরা চিৎকার করে কাঁদে। জঠরজ্বালা সইতে না পেরে কত বনী আদম পথের ধারে উপুড় হয়ে কাতরায়। রসে টইটুম্বর আঙ্গুর ও টসটসে কমলা বিত্তশীলরা প্রায়শই নিক্ষেপ করে ডাস্টবিনে। অথচ অভাবীরা পঁচা ও উচ্ছিষ্ট ফল খাওয়ার জন্য ইতর প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে ডাস্টবিনে। মানুষ বুদ্ধিমান জীব বলে অন্য সব জীবজন্তু একেবারে বুদ্ধিহীন নয়। বরং বুদ্ধির সঙ্গে বিবেক এবং আপন চাহিদার সঙ্গে মানবিকতার সংশ্লেষই অন্য সব জীব-জন্তুর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। ইসলাম মানুষকে সর্বোচ্চ মানবিকতা, পরহিতৈষণা, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার শিক্ষা দিয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা অনাহারীর কষ্টের ভাগিদার হতে এবং জনমদুখী বান্দার দুঃখে সমব্যথী হতে মাহে রমযানের রোযা ফরয করেছেন। দুঃখীর অভাব মোচনে ধনাঢ্যের উপর যাকাত ফরয ও সামর্থ্যবানদের উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। দান-সদকা ও অন্যের জন্য ব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করে বহু আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, এমন কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম কর্জ দেবে? তবে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান। (সূরা হাদীদ: ১১) অন্যত্র বলেন, যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাকারা: ২৬১)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, আর তোমরা নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে। (সূরা মুজাম্মিল: ২০)।
মানবসেবাকে নবীজি নিজ জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কোনো অবস্থায় এ ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। ইসলামী প্রজাতন্ত্র মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাসী জীবনযাপন করেননি। ৯ম হিজরীতে যখন আরব উপদ্বীপ তার অনুগত হয়, তখন তিনি বিশাল রাজ্যের অধিপতি। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার কাছে চারদিক থেকে মদীনায় যেসব উপহার আসত তিনি তা গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। নিজে কিছুই ভোগ করতেন না। তার ওফাতের সময় পরিবারে দুই দিন পেট পুরে খাওয়া যায় এমন সঞ্চয়ও ছিল না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার ভাষ্য মতে, তিনি এমনভাবে ইহলোক ত্যাগ করেছেন যে তাঁর পরিবার লাগাতার দু’দিন পেট ভরে গমের রুটি খেতে পারে নি। (বোখারী)।
একবার হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদে নববীতে ইতেকাফরত ছিলেন। এমন সময় এক লোক তাঁর কাছে এসে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে পড়ল। হজরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, কী ব্যাপার, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই চিন্তিত! জবাবে লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুলের চাচাতো ভাই! নিশ্চয়ই আমি খুব চিন্তিত। কেননা অমুক ব্যক্তির কাছে আমি ঋণী আছি। তারপর সে রাসুলের রওজা শরিফের দিকে ইশারা করে বলল, এই কবরওয়ালার ইজ্জতের শপথ! এই ঋণ আদায় করার সামর্থ্য আমার নেই। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আমি কি তাঁর কাছে তোমার জন্য সুপারিশ করব? লোকটি বলল, আপনি যা ভালো মনে করেন। এ কথা শুনে হজরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তৎক্ষণাৎ জুতা পরে মসজিদের বাইরে এলেন। লোকটি বলল, হজরত! আপনি কি ইতেকাফের কথা ভুলে গেছেন? তিনি বললেন, না ভুলি নাই। তবে খুব বেশি দিনের কথা নয়, আমি এই কবরওয়ালার কাছ থেকে শুনেছি (এই কথা বলার সময় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরছিল), যে ব্যক্তি নিজে অন্য কোনো মুসলমান ভাইয়ের কোনো প্রয়োজনে চলাফেরা করবে এবং তার জন্য চেষ্টা করবে, তা তার জন্য ১০ বছর ইতেকাফ করার চেয়েও উত্তম হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতেকাফ করে আল্লাহ তার মধ্যে ও জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যার দূরত্ব আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্ব হতেও অধিক। (এক দিনের ইতেকাফের ফজিলতই যখন এরূপ, তখন ১০ বছর ইতেকাফের ফজিলত কী পরিমাণ হবে? (তারবানি)।
মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা তাদের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্তে¡ও সে খাবার অসহায়, এতিম এবং বন্দিদের খাওয়ায়। (সূরা দাহার: ৮)। আর কাফেরদের ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে, কাফিরগণ মুমিনদের বলে আল্লাহ যাদের ইচ্ছা করলে খাবার দিতে পারেন, আমরা কি তাদের খাবার খাওয়াব? (সূরা ইয়াসিন: ৪৭)। অর্থাৎ অসহায়ের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোঁজখবর না রাখা, মানবসেবায় এগিয়ে না আসা কাফিরদের স্বভাব। পক্ষান্তরে মুমিনরা মানবসেবায় থাকে সদা তৎপর। (সূরা মাউন: ৩)।
মানব সেবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তায়ালা বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়। (মুসলিম)। অন্যত্র ইরশাদ করেন, আল্লাহর শপথ! ঐ ব্যক্তি ঈমানদার নয়। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে? তিনি বললেন, সেই ব্যক্তি যার হঠকারিতা থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, হঠকারিতা কী? তিনি বললেন, তার অনিষ্ট বা জুলুম। (মুসলিম)। বলাবাহুল্য আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের অপচয় করা অথচ নিকটস্থ অসহায়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করাও এক ধরনের জুলুম। তাই একে অপরকে সাহায্য করা, একে অন্যকে যৎসামান্য হলেও কিছু দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ হুরায়রা রাদি¦য়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে মুসলিম নারীগণ, এক প্রতিবেশী যেন তার অপর প্রতিবেশীর পাঠানো দানকে তুচ্ছজ্ঞান না করে, যদিও তা ছাগলের পায়ের একটি ক্ষুর হয়। (বোখারী)। তিনি আরো বর্ণনা করেন, প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য। (বর্ণনাকারী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেন, এবং সে ওই সালাত আদায়কারীর ন্যায় যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায় যার সিয়ামে বিরতি নেই। (বোখারী)।
মানবসেবার মহান ব্রতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসলে সমাজের রূপই পাল্টে যায়, যা উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে ব্যাপক কার্যকর ভূমিকা রাখে। অন্যের কল্যাণ কামনায় নিয়োজিত করতে পারার মধ্যেই মানুষের জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ, কপটতা-ভন্ডামি এসব কুপ্রবৃত্তিকে শক্ত হাতে দমন করে সমাজসেবার মহান আদর্শে নিজেকে পরিচালিত করা। পারস্য কবি আল্লামা শেখ সাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কতই না চমৎকার বলেছেন:
সেজদা ও তসবিহ দেখে, খোদ এলাহি ভুলবে না
মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গদ্বার খুলবে না।
লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মানবসেবা
আরও পড়ুন