Inqilab Logo

বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

করোনা, উন্নয়ন ও মুক্তবাজার

শিমুল এলাহী | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫১ পিএম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনাভাইরাস। সামাজিক দূরত্বের ধারণা বর্তমানে শুধুমাত্র ব্যক্তি পর্যায়ে নেই, প্রতিটি রাষ্ট্রই যেন হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এর সমাপ্তি ও প্রভাব নিয়ে দিনে দিনে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৃটিশদের অর্থনৈতিক পুর্নগঠন ও দুর্বলতার কারণে তাদের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল বিভিন্ন দেশ। সে সময়ের শীতল যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা মার্কিন ব্লক ও সোভিয়েত ব্লকের টার্গেটে পরিণত হয় সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলো। সোভিয়েত ব্লকের সমাজতন্ত্রের বিপরীতে মার্কিন ব্লকের পুঁজিবাদী ধারণার উন্নয়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির চটকদার আকর্ষণে বিশ্ব পরিবর্তিত হতে থাকে দ্রুত। এরই পটভূমিতে বৈশ্বিক অর্থনেতিক ব্যবস্থার ওপর বড় একটি ধাক্কা হয়ে এলো করোনাভাইরাস। চতুর্দশ শতাব্দীর প্লেগ মহামারীর পরে কৃষকদের বিদ্রোহ সামন্ততন্ত্রকে সরিয়ে দেয়। পেস্টিস নামক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট বুবোনিক প্লেগ মহামারীটি মঙ্গোলিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং কমপক্ষে সমস্ত মানবের এক তৃতীয়াংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যখন এটি শেষ হয়ে যায়, তখন কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয় এবং পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হয়। করোনাভাইরাসও উন্নয়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো ধারণাগুলোতে আনতে পারে আমূল পরিবর্তন।

উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামোর প্রাধান্যের পাশাপাশি মানবিক উন্নয়নের বিষয়টিও সামনে চলে আসতে পারে। ভবিষ্যত মহামন্দার সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংসন্থান হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক প্রণোদনা বাড়ানো এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে সংকট কাটানোর মোক্ষম উপায়। তবে বিপুল ঘাটতির নগদায়ন উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটাবে অন্যদিকে খেলাধুলা, ভ্রমণ, বিনোদন, রিয়েল স্টেটসহ বিলাসী ব্যবসায় দৃশ্যমান কাটতি পড়বে। এক্ষেত্রে বাজার চাহিদা ও ভৌগোলিক গন্ডির আন্তঃনির্ভরশীলতার দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে উঠতে পারে নতুন অর্থনৈতিক রূপরেখা। ভোগ, মূলধন ব্যয়, আমদানি ও বড় ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে সংকোচন আসবে। সূচকভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠির চেয়ে অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হয়ে উঠবে চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র মতে, মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। শ্রম চাহিদার এ বিপুল অংশের মাধ্যমে বিকল্প প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি নতুন দৃশ্যপট আগমন অস্বাভাবিক নয়। করোনা পরবর্তী চাহিদা ও বাজার ব্যবস্থার বিশ্বপটে বিকল্প শ্রমবাজার তৈরি এবং আমদানি নির্ভর তৈরি পণ্য উৎপাদনের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলো। বৈদেশিক শ্রমবাজারের বেকার হয়ে পড়া অনেক শ্রমিকও নিজ নিজ উন্নয়নশীল দেশে মূলধন ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নয়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির তত্ত্বগত স্বাদে পশ্চিম ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার সংস্পর্শে তাদের মতোই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। তবে বর্তমান সংকটকালীন সময়ে বৈশ্বিক প্রভাব বজায় রাখার চেয়ে অভ্যন্তরীণ সংকট মেটানোই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠবে পশ্চিম ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর। অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উপনিবেশ শাসনের অবসানের মতোই তা হতে পারে। তবে বর্তমান শতাব্দীর বাণিজ্য ও অর্থব্যবস্থা জটিল হিসাব-নিকাশে বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাণভোমরা উন্নয়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো ধারণাগুলোকে জীবিত এবং উন্নত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
নির্ভরশীলতার তত্ত্ব অনুসারে, অনুন্নত দেশগুলি বিশ্ববাজারে সস্তা শ্রম এবং কাঁচামাল সরবরাহ করে। উন্নত অর্থনীতির কাছে এরা বিক্রি হয়, কিন্তু পুনরায় উচ্চ মূল্যে তাদের তৈরি পণ্য ক্রয় করে। অনুন্নত দেশগুলোর মূলধন হ্রাস হবার ফলে তাদের নিজস্ব উৎপাদনশীল ক্ষমতা উন্নীত করতে ব্যর্থ হয়। করোনা পরবর্তী ভঙ্গুর বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অুনন্নত দেশগুলোগুলোতে তৈরি পণ্যের চাহিদার নিন্মমুখিতা স্বাভাবিকভাবে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও সীমিতভাব বজায় রাখার চেষ্টা করবে উন্নত দেশগুলো। একইময়ে ক্ষমতাশালী উন্নত দেশগুলো চলামান আর্থিক অনুদানেও বড় ধরনের কাটছাঁট করতে পারে তাদের নিয়ন্ত্রিত মিত্র দেশগুলোর ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে মন্দা অবস্থার মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক সহায়তার সুবিধার ক্ষেত্রে নতুন ধ্যানধারণার উৎপত্তি হতে পারে। উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে অসম সম্পর্কের কাঠামোয় চলমান মুক্ত বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কগুলির বিপরীতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় তথা নিজস্ব আপদ মোকাবেলাই বড় হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে আসন্ন মন্দা থেকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, চীন ও ভারত সরকার ৭ লাখ কোটি ডলারের বেশি খরচের পরিকল্পনা করেছে। মানবিক কারনে হোক বা অর্থনৈতিক কারনে হোক ইরান, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় বড় ধরনের শিথিলতাও আসতে পারে। অভ্যন্তরীণ সংকট ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাহিদার প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক পথেও পরিবর্তন আসবে।
লেখক: ব্যাংকার



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুক্তবাজার
আরও পড়ুন