চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাও: এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ দুই ॥
লিখনীর মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষণের ধারা আজও মুখস্থের মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পরিমাণে শুধু জারি নেই; বরং তা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোটামুটি শতাধিক ভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু মদিনায় প্রতিষ্ঠিত “বাদশাহ ফাহাদ আল কুরআন একাডেমী” থেকে প্রতি বছর ২ কোটি ৮০ লক্ষ কুরআন মাজীদের কপি ছেপে বিশ্বব্যাপী বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। (তাঁকে আল্লাহ ইসলাম এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম প্রতিদান দিন)।
উল্লেখ্য, প্রেস আবিষ্কারের পরে সর্বপ্রথম ১১১৩ হিজরী জার্মানীর হামবুর্গ প্রেসে কুরআন মাজীদ ছাপানো হয়, যার একটি কপি আজও দারুল কুতুব মিশরিয়াতে বিদ্যমান আছে।
আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর যুগে কুরআন মাজীদ একত্রিতকরণ ইয়ামামার যুদ্ধে যখন হাফেযের একটি বড় দল শহিদ হয়ে গেল তখন সর্বপ্রথম ওমর ফারুক (রা.) কুরআন মাজীদ লিখিতভাবে একত্রিত করার অনুভূতি প্রকাশ করেন। তাই তিনি আমীরুল মুমেনীন আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর নিকট এসে বললেন, ইয়ামামার যুদ্ধে হাফেযদের একটি বড় দল শহিদ হয়ে গেছে, যদি যুদ্ধে এভাবে হাফেযগণ শহিদ হতে থাকে তাহলে আশঙ্কা রয়েছে যে, কুরআন মাজীদের একটি বড় অংশ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাই আপনি কুরআন মাজীদ একত্রিত করার প্রতি গুরুত্ব দিন।
আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বললেন, যে কাজ রাসূল (স.) তাঁর জীবদ্দশায় করেনি সে কাজ আমি কী করে করতে পারি? ওমর (রা.) উত্তরে বললেন, আল্লাহর কসম এটা খুবই ভালো কাজ! এরপর আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য আবু বকর (রা.)-এর অন্তর খুলে দিলেন। তখন তিনি যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) কে ডেকে বললেন, তুমি যুবক এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তোমার ব্যাপারে কারো কোনো খারাপ ধারণা নেই। তুমি রাসূল (স.)-এর অহির লিখক ছিলে, তাই তুমি কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহ খুঁজে তা একত্রিত কর। যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বলল, যদি তারা (আবু বকর এবং ওমর (রা.) আমাদের কোনো পাহাড় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে বলত তাহলে তা আমার জন্য এতটা দুষ্কর হতে না যতটা দুষ্কর কুরআন মাজীদ একত্রিত করণ। আবু বকর সিদ্দীক (রা.) যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) কে এ কাজের জন্য বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি এক সময়ে আল্লাহ যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-এর অন্তরকে এ কাজের জন্য খুলে দিলেন, ফলে তিনি এ কাজ করতে শুরু করলেন।
যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) কত কষ্ট স্বীকার করে এ কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন তা এ কথা থেকে অনুমান করা যাবে যে, যখন কোনো ব্যক্তি কোনো আয়াত নিয়ে যায়েদ (রা.)-এর নিকট আসত তখন তিনি নি¤œলিখিত চারটি পদ্ধতিতে তা যাচাইবাছাই করতেন।
১. যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) নিজে হাফেয ছিলেন, তাই প্রথমে নিজের মুখস্থের আলোকে তা যাচাই করতেন।
২. ওমর ফারুক (রা.) ও যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-এর সাথে কুরআন একত্রিত করার কাজে জড়িত ছিলেন। তিনিও কুরআনের হাফেয ছিলেন তাই তিনিও নিজের মুখস্থের আলোকে তা যাচাই করতেন।
৩. যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) ততক্ষণ একটি আয়াতকে গ্রহণ করতে না যতক্ষণ না দু’জন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এ সাক্ষ্য না দিত যে, হ্যাঁ এ আয়াতটি সত্যিই রাসূল (স.)-এর সামনে লিখা হয়েছে।
৪. পরিশেষে পেশকৃত আয়াতটিকে অন্যান্য সাহাবাগণের লিখিত আয়াতের সাথে মেলানো হতো। যে আয়াতটি এ চারটি শর্ত অনুযায়ী সঠিক হতো তা গ্রহণ করা হতো। এত গুরুত্বের সাথে যায়েদ (রা.) কুরআন একত্রিকরণের এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন।
যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) কর্তৃক একত্রকৃত এ কপিটিকে “উম্ম” বলা হতো। এ “উম্ম”-এর ৩টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল-
ক. সমস্ত সূরাসমূহের আয়াতগুলোকে রাসূল (স.)-এর নির্দেশিত বিন্যাস অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে।
খ. ঐ কপিতে ক্বিরাতের (তেলাওয়াত পদ্ধতির) ৭টি পদ্ধতিই বিদ্যমান ছিল। যাতে করে যে ব্যক্তি যে পদ্ধতিতে সুবিধামত কুরআন তেলওয়াত করতে পারবে সে ঐভাবে তা করবে।
গ. সূরাসমূহ ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়নি; বরং প্রত্যেকটি সূরা পৃথক পৃথকভাবে সহিফার (পুস্তিকার) আকৃতিতে বিন্যস্ত করা হয়েছিল।
আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর শাসনামলে ঐ কপিটি আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল, আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর মৃত্যুর পর ওমর ফারুক (রা.)-এর শাহাদাত বরণের পর এ কপিটি উম্মুল মুমেনীন হাফসা বিনতে ওমর (রা.) নিকট সংরক্ষিত ছিল।
কুরআন মাজীদের ৭টি ভিন্ন ভিন্ন ক্বিরাত (তেলাওয়াত পদ্ধতি)
মূলত কুরআন মাজীদ কুরাইশদের তেলাওয়াত পদ্ধতি (তাদের ভাষায়) অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন রকমের স্থানীয় ভাষা এবং উচ্চারণ পদ্ধতির কারণে উম্মতে মুহাম্মদীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ৭টি স্থানীয় ভাষায় কুরআন তেলাওয়াতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। জিবরাইল (আ.) রাসূল (স.) কে এ নির্দেশ পৌঁছলেন যে, আপনি আপনার উম্মতকে একটি স্থানীয় ভাষায় কুরআন শিক্ষা দিন। তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মত এ ক্ষমতা রাখে না। জিবরাইল (আ.) দ্বিতীয় বার আসলেন এবং বললেন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে এ নিদের্শ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতদেরকে স্থানীয় দুটি ভাষায় কুরআন শিক্ষা দেন। তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মত এ ক্ষমতা রাখে না। জিবরাইল (আ.) তৃতীয় বার আসলেন এবং বললেন- আল্লাহ তাআলা আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতদেরকে স্থানীয় ৩টি ভাষায় কুরআন শিক্ষা দিন। তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আমার উম্মত এ ক্ষমতা রাখে না। জিবরাইল (আ.) ৪র্থ বার আসলেন এবং বললেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার উম্মতদেরকে স্থানীয় ৭টি ভাষায় কুরআন শিক্ষা দিন। এ সাতটি স্থানীয় ভাষার মধ্যে মানুষ যে ভাষায় কুরআন তেলাওয়াত করবে তা সঠিক হবে।
উল্লেখ্য, ৭টি ভাষার উদ্দেশ্যে হলো কোথাও উচ্চারণের পার্থক্য, যে এক ক্বিরাতে (পদ্ধতিতে) পড়া হয় মূসা অন্য কেরাতে মূসায়ু, আবার কোথাও যের, যবর ও পেশের পার্থক্য। যেমন- এক ক্বিরাতে যুল আরশিল মাজীদু (দালের ওপর পেশ দিয়ে) আবার অন্য কেরাতে যুল আরশিল মাজীদি (দালের নিচে যের দিয়ে) আবার কোথাও এ পার্থক্য হয় এক বচন, দ্বিবচন এবং বহুবচনে, বা পুং লিঙ্গ এবং স্ত্রী লিঙ্গের পার্থক্য। যেমন এক ক্বিরাতে তাম্মাতু কালিমাতু রাব্বিক আবার অন্য ক্বিরাতে তাম্মাত কালিমাত রাব্বুক। আবার কোথাও এ পার্থক্য হয়ে থাকে ক্রিয়ার মধ্যে, যেমন এক ক্বিরাতে ওমান তাত্তাওয়া খাইরান, আবার অন্যক্বিরাতে মান ইয়ত্বাওয়া পার্থক্য হয় না। এটা এ ধরনের পার্থক্য যেমন মিশরের অধিবাসীরা আরবী ‘জ্বিম’ অক্ষরটিকে বাংলা ‘গ’-এর ন্যায় উচ্চারন করে। যেমন ‘জানাযা’ শব্দটিকে তারা ‘গানাযা’ উচ্চারণ করে থাকে। ইরানের অধিবাসীরা আরবী ‘কাফ’ অক্ষরটিকে বাংলা ‘চ’-এর ন্যায় উচ্চারণ করে থাকে, যেমন “আল্লাহু আকবর” কে তারা “আল্লাহু আচ্চার” উচ্চারণ করে। ভারতের হায়দারাবাদ এলাকায় লোকেরা আরবী ‘ক্বাফ’ অক্ষরটিকে বাংলা ‘খ’-এর ন্যায় উচ্চারণ করে, যেমন “সন্দুক” কে তারা “সন্দুখ” উচ্চারণ করে থাকে। কিন্তু এ ভিন্নতার কারণে কোথাও অর্থের মধ্যে কোনো পরিবর্তন করে না। ঠিক এমনিভাবে কোরআন মাজীদের ভিন্ন ভিন্ন সাত ক্বিরাতের বিষয়টিও অনুরূপই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।