Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস

প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাও: এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব
॥ এক ॥
কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ সূত্রপাত হয়েছিল লাইলাতুল কদর, ২১ রমযান, ১০ আগস্ট ৬১০ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার।
ঐ সময়ে রাসূল (স.)-এর বয়স ছিল চন্দ্র বছর হিসেবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন। আর সৌর বছর হিসেবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।
অহী অবতীর্ণের প্রারম্ভে রাসূল (স.) এ ভয়ে থাকতেন যে, না জানি তিনি অহীর কথাগুলো ভুলে যান। জিবরাইল (আ.) এর সাথে সাথে অহীর কথাগুলো বার বার পড়তেন, ফলে আল্লাহ এ নির্দেশ দিলেন যে- “তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্য আপনি দ্রুত অহী আবৃত্তি করবেন না। (সূরা কিয়ামা -আয়াত:১৬) সাথে সাথে এ নিশ্চয়তাও দিলেন যে, এ অহী স্মরণ রাখা এবং পড়ানো আমার দায়িত্ব। আল্লাহর বাণী। “এর সংরক্ষণ ও পাঠ করা বার আমারই দায়িত্ব। অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি তখন আপনি ঐ পাঠের অনুসরণ করুন। (সূরা কিয়ামা-আয়াত : ১৭.১৮)
আল্লাহর এ বাণী থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, কুরআন মাজীদের এক একটি আয়াত, এক একটি শব্দ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স.) এর অন্তরে সংরক্ষিত করে দিয়েছিলেন। আরো সতর্কতার জন্য রাসূল (স.) প্রতি বছর রমযান মাসে কুরআন মাজীদের ততটুকু শুনাতেন যতটুকু অবতীর্ণ হয়েছিল। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ঐ বছর জিবরাইল (আ.)-কে দু’বার কুরআন শুনিয়েছেন। যেন রাসূল (স.) এর অন্তরে কুরআন মাজীদ এমনভাবে সংরক্ষিত ছিল যে, সামান্য ভুলত্রুটি বা সামান্য হেরফেরের কোনো প্রকার সম্ভাবনা ছিল না।
সাহাবায়ে কিরামের মাঝে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বপ্রকার লোকই ছিল, শিক্ষিত লোকদের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। তাই রাসূল (স.) কুরআন সংরক্ষণের জন্য কুরআ’ন মুখস্থ করা এবং লিখিতভাবে রাখা উভয় পদ্ধতিই তিনি অবলম্বন করেছেন। উভয় পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিচে উল্লেখ করা হলো-
ক. কুরআন মুখস্থ করা
কুরআন মাজীদের অবতীর্ণ যেহেতু শাব্দিকভাবে হয়েছিল তাই জিবরাইল (আ.) শব্দ এবং আয়াতের ধারাবাহিকতার সাথে সাথে রাসূল (স.) কে তার বিশুদ্ধ উচ্চারণও শিখাতেন। আর ঐ শাব্দিকভাবেই উম্মত পর্যন্ত পৌঁছানো জরুরি ছিল। তাই রাসূল (স.) তাঁর সার্বিক প্রচেষ্টা কুরআন মুখস্থ করার ক্ষেত্রে ব্যয় করেছেন।
মাদিনায় হিযরত করার পর তিনি সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেছেন, এরপর মসজিদের একপাশে সামান্য উঁচু করে “সুফফা” তৈরি করে তাকে মাদরাসায় রূপ দিয়েছেন। যেখানে উস্তাদগণ তাদের ছাত্রদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। ওবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন- যখন কোনো ব্যক্তি হিযরত করে মদিনায় আসত তখন রাসূল (স.) তাকে আমাদের আনসারদের মধ্য থেকে কারো নিকট পাঠিয়ে দিতেন, যেন তাকে কুরআন শিখানো হয়। মসজিদে নববীতে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা এবং শিক্ষা দেয়ার আওয়াজ এত বেশি হতো যে, রাসূল (স.) বললেন, হে লোকের! তোমরা তোমাদের আওয়াজ সংযত রাখ। কুরআন মুখস্থ করার প্রতি তাড়াহুড়া এবং বেশি গুরুত্ব দেয়ার দ্বিতীয় কারণ এই যে, আরবদের ছিল যথেষ্ট মুখস্থ শক্তি, যারা তাদের বংশধারাতো বটেই এমনকি তারা তাদের ঘোড়ার বংশধারাও পরিষ্কার করে জানত।
কুরআন মুখস্থের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার তৃতীয় কারণ ছিল এই যে, প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য নামাযে কিছু না কিছু তেলাওয়াত করা অপরিহার্য, ফরয নামায ব্যতীত নফল নামায, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাযের ফযিলত সাহাবায়ে কিরামের মাঝে কুরআন মুখস্থের আগ্রহকে আরো বৃদ্ধি করেছে। রমযান মোবারকের পূর্ণ মাস কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত, শ্রবণ, মুখস্থ, শিখা, শিখানোর বিশেষ সময়। এতদ্বত্যতীত কুরআন মাজীদের অসংখ্য ফযিলত এবং কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি রেখে কুরআন মুখস্থ করার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী থাকার জন্য চেষ্টা করত।
৪র্থ হিজরীতে বীরে মাউনার বেদনাদায়ক ঘটনায় ৭০ জন সাহাবীর ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, তারা সবাই ভালো কুরআন তেলাওয়াতকারী ছিল। তারা দিনের বেলায় কাঠ কেটে আহলে সুফফার লোকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করত এবং কুরআন শিখত ও শিখাত আর রাতে আল্লাহর নিকট দোয়া ও নামায আদায়ে ব্যস্ত থাকত।
সাহাবায়ে কিরামের এ আগ্রহের ফলাফল এই ছিল যে, রাসূল (স.) এর জীবদ্দশায়ই হাফেজগণের একটি বড় দল গড়ে উঠেছিল, ঐ দলের মধ্যে
১। আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ২। ওমর ফারুক (রা.) ৩। ওসমান গনী (রা.) ৪। আলী (রা.) ৫। তালহা (রা.) ৬। সা’দ (রা.) ৭। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ৮। হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.) ৯। সালেম (রা.) ১০। আবু হুরায়রা (রা.) ১১। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার (রা.) ১২। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) ১৩। মুয়াবিয়া (রা.)     ১৪। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) ১৫। আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) ১৬। আয়েশা (রা.) ১৭। হাফসা (রা.) ১৮। উম্মু সালামা (রা.)
এ নামগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রাসূল (স.)-এর মৃত্যুর সাথে সাথেই ১১ হিজরীতে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০০ হাফেযে কুরআনের শাহাদাতবরণ এ কথা স্পষ্ট যে, ঐ সময় পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ হাফেয গড়ে উঠেছিল। মুখস্থ করার মাধ্যমে কুরাআন মাজীদ সংরক্ষণের এ ধারা নবী (স.)-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা চালু থাকবে ইনশাআল্লাহ।
খ. কুরআন লিখন
কুরআন মুখস্থ করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া সত্ত্বেও কুরআন লিখে রাখার গুরুত্বের কথা রাসূল (স.) মোটেও ভুলে যাননি। এ উদ্দেশ্যে রাসূল (স.) শিক্ষিত সাহাবাগণকে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, অহি নাযিল হওয়া মাত্রই তারা তা লিখে রাখবে। যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) তাঁর নির্দিষ্ট অহির লিখক ছিল। এছাড়াও তিনি সরকারি অন্যান্য বিষয়াবলি লিখে রাখার দায়িত্বও প্রাপ্ত ছিল! স্বয়ং রাসূল (স.) তাকে বিদেশী ভাষা শিখার এবং লিখার জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অহি লিখগণের নাম নি¤œরূপ।
১. আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ২. ওমর ফারুক (রা.) ৩. ওসমান (রা.) ৪. আলী (রা.) ৫. ওবাই ইবনে কা’ব (রা.) ৬. যুবাইর ইবনে আওয়াম (রা.) ৭. মোয়াবিয়া বিন সুফিয়ান (রা.) ৮. মুগীরা ইবনে শো’বা (রা.) ৯. খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) ১০. আবান ইবনে সাঈদ (রা.) ১১. আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ ইবনে আস (রা.) যায়েরদ ইবনে সাবেত (রা) জাহেলিয়াতের যুগেও লিখক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। রাসূল (স.) তাকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, সে যেন সাহাবা কেরামগণকে লিখা শিখায়, বলা হয়ে থাকে যে, নবী (স.) এর যুগে অহি লিখকগণের সংখ্যা ৪০ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
রাসূল (স.)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, যখনই কুরআন কারীমের কোনো আয়াত অবতীর্ণ হতো তখন তিনি অহি লিখকদেরকে পরিপূর্ণভাবে নির্দেশ দিতেন যে, এ আয়াতটি ওমুক ওমুক সূরায় ওমুক ওমুক আয়াতের পরে লিখ, তখন ওহী লেখকগণ পাথর, চামড়া, খেজুরের ডাল, গাছের পাতা, হাড্ডি বা কোনো কিছুর ওপর লিখে রাখত। এভাবে নবী (স.)-এর যুগে কুরআন কারীমের এমন একটি কপি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল যা রাসূল (স.) নিজের তত্ত্বাবধানে লিখেয়েছেন। এছাড়াও অনেক সাহাবী এমন ছিলেন যে, তারা নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহে কোনো কোনো সূরা বা আয়াত নিজের নিকট লিখে রাখত। যেমন ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতি একটি পুস্তিকায় সূরা ত্ব- হা এর কিছু আয়াত লিখে রেখেছিল। তাই বলা হয়ে থাকে যে, রাসূল (স.) এর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত অগোছালোভাবে ১৭টির অধিক মাসহাফের (কুরআনের কপি) সন্ধান পাওয়া যায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ