Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় নৃবৈজ্ঞানিক জ্ঞান

মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০২ এএম

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষজন নিয়মিতভাবেই বিবিধ প্রকারের আকস্মিক ঝুঁকি ও দুর্যোগ মোকাবেলা করে চলেছে। কোথাও প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্প), আবার কোথাও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ (বায়ুদূষণ, সড়ক দুর্ঘটনা ও বননিধন), যা তুলনামূলক বেশি ঘটে। এছাড়াও স্থান-কাল-নির্বিশেষে কিছু দুর্যোগ ঘটতে দেখা যায়, যেগুলি সম্বন্ধে আগে থেকে অনুমান করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ ইবোলা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের কথা বলা যায়। যে ধরনের দুর্যোগই ঘটুক না কেন, এগুলির প্রভাব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক দক্ষতা, আয়-বৈষম্য, ক্ষমতা-কাঠামো ও সম্পদে জনগণের প্রবেশাধিকারের চলমান অবস্থা স্পষ্ট হয়। অন্যভাবে বললে, সমাজের প্রান্তিক কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষগুলিই সবচেয়ে আগে ও বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটি ঘটে এসেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জরুরি সেবা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর মধ্যে পরিবেশ বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, চিকিৎসক, মানবধিকার কর্মী ও প্রকৌশলীগণ অন্যতম। সামাজিক বিজ্ঞানীদের অবদানও উল্লেখযোগ্য; যেমন অর্থনীতিবিদগণ দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অর্থের পরিমাপে হিসাব করে দেখান যে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, যা দিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জরুরি সেবা প্রদান করা যেতে পারে। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে আরও কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেগুলি প্রেক্ষিতনির্ভর, জটিল, মানুষের সাংস্কৃতিক আচরণ, বোধ ও শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায়, এগুলো পৃথক বা স্বতন্ত্র কোনো বিষয় নয়। এই বিষয়গুলির আন্তঃসম্পর্ক সরল কিংবা অপ্রশিক্ষিত দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষণমূলক দক্ষতা ও সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই প্রবন্ধে আমার বক্তব্য নৃবিজ্ঞানের ভূমিকার উপর সীমাবদ্ধ রাখবো এবং বিষয় হলো: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস দুর্যোগ।
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ অধ্যয়নকারী সামাজিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ভূগোলবিদ বেন উইজনার ও পিয়ারস ব্লেইকি এবং নৃবিজ্ঞানী এন্থনি অলিভার স্মিথ ও সুসানা হফম্যান। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এদের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন বহু সামাজিক বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত ও নৃবিজ্ঞানী এম. কিউ. জামান। সুতরাং, দুর্যোগ সম্পর্কে সামাজিক বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা নতুন কোনো বিষয় নয়। খুব সরল ভাষায়, নৃবিজ্ঞান এমন একটি জ্ঞানকান্ড যেটি মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধার্মিক ও বিভিন্ন ধরনের আচরণসমূহকে গুণগতভাবে ও সার্বিকভাবে অধ্যয়ন করে। নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ড তার গবেষণা পদ্ধতি (যেমন, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ) দ্বারা দুর্যোগ সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের ধারণায়ন, শঙ্কা ও অভিজ্ঞতাকে চিত্রায়ন করে। নৃবিজ্ঞানের অন্যতম হাইপোথিসিস হলো, যেকোনো বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিভিন্ন হতে পারে। এটি যে কোনো দুর্যোগ বা ঝুঁকিকে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত হিসেবে বোঝে না। বরং, এর চাইতেও বেশি কিছু। আকস্মিক দুর্যোগ-তাড়িত ঝুঁকিতে তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়, যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সেই ঝুঁকি মোকাবেলায় যথেষ্ট কার্যকর নয়। অর্থাৎ, দুর্যোগ-তাড়িত মানুষের ভোগান্তি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্মিত।
করোনাভাইরাসের আক্রমণ সকল স্থানে, সমাজে ও মানুষের উপর সমানভাবে প্রভাব রাখবে না। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় রাষ্ট্রের জরুরি উদ্যেগের প্রভাবও শ্রেণিভেদে অসমান প্রভাব রাখবে। আমার শ্রেণি অবস্থানকে একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক। আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে আমার অর্থনৈতিক আয় বা বেতনের উপর বিন্দুমাত্র নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। কিন্তু, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমার ভিতরে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে, রিকশা চালিয়ে ও ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রাখার সরকারি ঘোষণাটি ভুল হয়েছে। বরং, এই বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে বলতে চাই যে, দুর্যোগের প্রভাব অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণিভেদে এক নয়। দুর্যোগ নৃবিজ্ঞানী সুসানা হফম্যান বলেন, ‘দুর্যোগ হচ্ছে প্রকাশকারী। এটি প্রকাশ করে যে সমাজে নীরবে কী চলছে এবং তা কাকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন করছে।’ অন্যভাবে বলেলে, দুর্যোগ আসার আগেই সমাজে বৈষম্য ছিল ও বিরাজমান আছে যা নির্ধারণ করে দেয় যে নিম্ন আয়ের মানুষ দুর্যোগকালীন সময়ে বেশি মাত্রায় ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।
করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি যেন না ঘটে সেজন্য বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও মানুষের ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলোকে সীমিত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, দিনমজুররা ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না; কাজ করতে পারছে না ও মজুরি পাচ্ছে না। এতে করে, তাদের মতো মানুষদের দুই ধরনের সংগ্রাম করতে হচ্ছে: ১. করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ও ২. দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। আর, আমার মতো ও আমার চাইতেও উচ্চ শ্রেণির ব্যক্তিরা শুধুমাত্র অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্য-ঝুঁকিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে (যেমন, ভাইরাসমুক্ত বা জীবাণুমক্ত থাকার জন্য মুখোশ পরিধান করা ও ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধৌত করা)। উচ্চ শ্রেণি তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য খুব সহজে মাথাপিছু ডজনখানেক সাবান ক্রয় করার ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে, বস্তিবাসী বা দিন আনে দিন খায় এমন পরিবারগুলির জন্য অতিরিক্ত সাবান কেনা একধরনের অর্থনৈতিক চাপ হিসেবে দেখা দেয়। তাছাড়া, প্রাকৃতিক সম্পদ তথা বিশুদ্ধ পানিতে নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রবেশাধিকার কাঠামোগতভাবেই সীমিত।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু বাস্তবিক পদক্ষেপ নিতে হয়, যা আপাতদৃষ্টিতে অনাকাক্সিক্ষত হলেও ব্যবহারিক দিকে থেকে সেগুলো ফলপ্রসূ। যেমন, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মুখোশ পরিধান না করে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার জন্য সরকারি আদেশ রয়েছে। যে কোনো সরকারি আদেশের ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ড জোরারোপ করে যে কীরূপ যোগাযোগ মাধ্যমে ও শব্দমালায় তা পরিবেশিত হচ্ছে। যেমন, নির্দেশ পরিবেশনকারী মাধ্যম রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র সাধারণত শুদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহার করে। প্রশ্ন হচ্ছে, শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ব্যতীত কতজন মানুষ এই সকল মাধ্যমগুলোর সাথে দৈনন্দিন জীবনে অভ্যস্থ? প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে দেখা যায় যে, পাবলিক স্থান, যেমন, বাজার, বাসস্ট্যান্ড ও ঘাটে স্থানীয় মানুষজন (বিশেষ করে, পুরুষরা) চায়ের দোকানগুলিতে বসে টিভিতে খবর দেখে। তাদের জন্য, সেই স্থানগুলোই হচ্ছে জরুরি তথ্য ও সরকারি আদেশ পাওয়ার জনপ্রিয় ও সহজ উপায়। বিবেচনায় আনতে হবে যে, দরিদ্র মানুষগুলোর ঘরে সংবাদমাধ্যগুলো নেই, তা ক্রয়ের সামর্থ্য তাদের নেই। এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার চেয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সংস্কৃতি প্রবল। তাই, বেশি মানুষের কাছে জরুরি আদেশ ও তথ্য পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় মাধ্যম (যেমন, মাইক) আঞ্চলিক শব্দ (যেমন, লোকসঙ্গীত) ও সহজবোধ্য চিত্রের ব্যবহারকে বিবেচনায় আনা জরুরি। এতে, প্রত্যাশিত ইতিবাচক ফল আসার সম্ভাবনা বাড়ে।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো ও আমলাতন্ত্র কতখানি মানবিকতা, দক্ষতা, ধৈর্য্য, সৃজনশীলতা ও পেশাদারিত্বের সাথে দুর্যোগে সাড়া দেয়, তা জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। প্রশাসনিক কাঠামোগুলি নিঃসন্দেহে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও কর্র্র্তৃত্ব অনুশীলন করে। কিন্তু, দুর্যোগের সময় বিপদাপন্ন মানুষ আশা করে যে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনমূহ নমনীয়তা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দেবে। প্রশাসনসমূহের উচিত হবে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বিবেচনায় আনা। নৃবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখান যে, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে মানুষের মনে, সংস্কৃতিতে, সমাজে, ব্যক্তি জীবনে কী কী পরিবর্তন আসে। দুর্যোগকালীন হতাশা ও উদ্বিগ্নতা মানুষের স্বাভাবিক আচরণে ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়াও, দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠি রাষ্ট্র থেকে তৎক্ষণাৎ সেবা পেতে চায়, কারণ তাদের ইন্স্যুরেন্স কিংবা সঞ্চয় করার সামর্থ্য নেই। দুর্যোগের পরিস্থিতিতে তারা সাধারণত সামাজিক পুঁজি (আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কাল্পনিক আত্মীয়)’র উপর ভরসা করে। এরূপ জটিল পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উচিৎ হবে বিপদাপন্ন মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা। সদাচার প্রদর্শন করা। অসদাচারণ বিপদাপন্ন মানুষকে আরও অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়। প্রশাসনের উচিৎ হবে করোনাভাইরাস দুর্যোগ পরিস্থিতিকে উন্নয়নের জন্য মানুষের স্থানীয় স্বাস্থ্য-চর্চা ও স্বাস্থ্য-জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তাদেরকে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করা সত্যিই কষ্টসাধ্য হবে।
দুর্যোগের ফলাফলগুলিকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা যায়। ১. কিছু প্রভাব সৃষ্ট হয় দ্রুত গতিতে। যেমন, বন্যার কারণে ঘর-বাড়ি ও জমির ক্ষয়ক্ষতি, নদী ভাঙনের কারণে জমি নদীর তলদেশে চলে যাওয়া, এবং সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের কারণে সর্দি-কাশি কিংবা মৃত্যু। ২. কিছু প্রভাব সৃষ্ট হয় ধীর গতিতে এবং সেগুলির ফলাফল প্রকৃতভাবেই জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী। যেমন, একটি স্বচ্ছল পরিবার দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে করতে অস্বচ্ছল হয়ে যেতে পারে; জোরপূর্বক কিংবা স্বেচ্ছায় সমাজচ্যুত হতে পারে কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে। এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা সাধারণত দেখতে পাই যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ বিতরণ করে। এটি আপাতদৃষ্টিতে সরল উপায় হলেও বাস্তবে তা নয়। যেমন, নৃবিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কে ত্রাণ দিচ্ছে? ত্রাণের উৎসসমূহ কী কী? ত্রাণ বিতরণে শুধুই কি পরার্থপরতা জড়িত নাকি এটির সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে? যারা ত্রাণ দিচ্ছেন তারা কি তাদের খ্যাতি বৃদ্ধির জন্য দিচ্ছেন? ত্রাণ কাজে ব্যবহৃত সম্পদ (অর্থ, খাদ্য, ঔষুধ) কি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? ত্রাণ বা সেবা বিতরণে স্বজনপ্রীতি কতখানি? স্বজনপ্রীতি যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা কতখানি রাজনৈতিক ও কতখানি জ্ঞাতিম্পর্কীয়? নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রচুর অর্থ বিবিধ ধরনের ত্রাণ তহবিলে জমা হবে। সে অর্থ কীরূপে ব্যবহার করা হবে তা নির্ধারণে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে এবং বিবিধ ধরনের বিশেষজ্ঞ (যেমন, অর্থনীতিবিদ, হিসাবরক্ষক, পরিসংখ্যানবিদ, চিকিৎসক) নিয়োগ দেয়া হবে। যেহেতু, ত্রাণ ও সেবা সামগ্রী জনগোষ্ঠির সমাজের মানুষের কাছে পৌঁছানোই এরূপ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য, তাই মানুষ নিয়ে যাঁরা অধ্যয়ন করে (যেমন, নৃবিজ্ঞানী), তাদেরকে এই ধরনের পরিকল্পনা দলে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। নৃবিজ্ঞানীদের একাডেমিক প্রশিক্ষণ রয়েছে, যে কীভাবে সেবা ও সামগ্রী বৈষম্যহীনভাবে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে কার্যকরভাবে বিতরণ করা যায়। সময় এসেছে মানুষের বিপদাপন্নতাকে গভীরভাবে ও ক্রিটিক্যালি বোঝা। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ক্যানন বলেন যে, সাধারণত মানুষের বিপদাপন্নতাকে এড়িয়ে চলা হয় এই পূর্বানুমানের ভিত্তিতে যে, এই দুর্যোগ-তাড়িত ভোগান্তিগুলি ‘বিজ্ঞানের সাথে অপ্রাসঙ্গিক’ অথবা ‘এগুলি নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন’।
প্রায়ই দেখা যায় যে, ত্রাণ বিতরণকারী কোনো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে এবং তাকে ঘিরে বহুজন ছবি তুলে তা পত্রিকায় ও সামাজিক ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা হয়নি যে, সাহায্য গ্রহণের ছবি তুলতে সাহায্য গ্রহণকারীরর সম্মতি আছে কি নেই। সাহায্য গ্রহণকারীর কাছে এটি অমর্যাদাকরও হতে পারে, সেটি খেয়াল রাখা জরুরি। বলা বাহুল্য, ব্যক্তির মান-মর্যাদা ও আত্মসম্মান সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মিত ও চর্চিত। এতে একটি বিষয় প্রমাণ হয় যে, সাধারণত সাহায্য গ্রহণকারী গরিব এবং তাদের মান-মর্যাদার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। তাদের কণ্ঠস্বর পলিসি পর্যায়েও অনুপস্থিত। এটি যে বহুদিন ধরে ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত হয়ে এসেছে তা মনে রাখা জরুরি। এরূপ নির্মাণের অবসান অবশ্যই হওয়া উচিৎ। এতে, দুর্যোগ পরববর্তী বৈষম্য ও ত্রাণ বিতরণকারীদের অসমীচীন আচরণ দূর হবে।
বিশ্ব করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি বেড়েই চলেছে। এটি অনুমান করা যায় যে, ঘনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে পারে। সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসাধারণকে অযথা রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতে অনাগ্রহী করছে। চিকিৎসকরা নিজ স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দিচ্ছে। মানবাধিকারী কর্মীরা গরিবদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। যেহেতু এই ভাইরাস মানুষের জীবনে দুর্যোগ নিয়ে এসেছে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তথা সমাজিক জীবনে ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তাই এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সামাজিক বিজ্ঞানীদের বিশেষ করে নৃবিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগানো যেতে পারে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা-দুর্যোগ
আরও পড়ুন