পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকার ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করার সাথে সাথে রাজধানীবাসীর মাঝে এক হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই ছুটি যে কোনো আনন্দ উপলক্ষের নয়, বরং এক ভয়াবহ বিপদ সামনে রেখে এবং তা সামাল দেয়ার জন্য সরকার বাধ্য হয়ে এ ঘোষণা দিয়েছে, তা অনেকে উপলব্ধি করেনি। তাদের মধ্যে ঈদের ছুটির আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। ঈদের ছুটির সময় মানুষের মধ্যে যেমন রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হওয়ার এক ধরনের তাড়াহুড়া থাকে, জরুরি পরিস্থিতির এই ছুটিতেও তাদের মধ্যে এ ধরনের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। রাজধানী ছেড়ে বাড়িতে যাওয়ার আনন্দে বাস টার্মিনালগুলোতে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। বাসের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। অনেকে বাস না পেয়ে পণ্য পরিবহনের গাড়িতে চড়ে বসে। করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্য যে নিদির্ষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা দরকার তা ভুলে গাদাগাদি করেই গাড়িতে উঠে পড়ে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায়, আনন্দ যাত্রায় একটু কষ্ট করতেই হয়। বাড়ি গিয়ে পৌঁছতে পারলেই সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমাদের দেশের মানুষ যে শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও ছুটির আনন্দ মিস করতে চায় না, তা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির ছুটিতে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ১০ দিনের সাধারণ ছুটিতে রাজধানী ছেড়ে গেছে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখের মতো মানুষ। এটি দেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। সাধারণত ঈদে ৫০-৬০ লাখ বা তার কিছু বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়ে। এবার এই রেকর্ড ভেঙে গেছে। রেকর্ড হয়েছে গাড়ির যাতায়াতেও। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে ঈদের ছুটিতে ২৪ ঘণ্টায় সাধারণত যানবাহন গড়ে চলাচল করে ২৫-২৬ হাজার। ১০ দিনের ছুটির প্রথম দিনে এই সড়কে যানবাহন চলাচল করেছে প্রায় ৫০ হাজার। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-উত্তর বঙ্গ মহাসড়কেও যানবাহন চলাচলে রেকর্ড হয়েছে। অথার্ৎ, করোনাভাইরাস ঠেকাতে সরকারের অঘোষিত লকডাউন দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক-আনন্দ অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখন ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। মূলত এ ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। কারণ ৯ এপ্রিল পবিত্র শবেবরাত। পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার। পরবর্তীতে এ ছুটি বৃদ্ধি করা হবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ১৭ দিন একটানা ছুটি। সরকার কতৃর্ক ঘোষিত ছুটির ক্ষেত্রে এটি এক নতুন রেকর্ড। তবে করোনা মোকাবেলায় এর কোনো বিকল্পও নেই।
আমরা অন্য যে কোনো জাতির তুলনায় একটু বেশি আরামপ্রিয়। গল্প-গুজব করে অলস সময় কাটানোতে আমাদের জুড়ি নেই। সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবী উভয় ক্ষেত্রেই ছুটিপ্রিয়তা বেশি। যে কোনো ছুতোয় ছুটি খুঁজতে থাকে। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। এর প্রতিক্রিয়া দেশের উন্নয়ন কাজেও পড়ে। এমন একটি প্রকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না যা নিদির্ষ্ট সময়ে শেষ হয়েছে। এর সাথে আলসেমি, ঢিলেমি যেমন রয়েছে, তেমনি দুর্নীতিও জড়িয়ে আছে। এই যে সরকার কতগুলো মেগা প্রকল্প নিয়ে উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তার একটিও নিধার্রিত সময়ে শেষ হয়নি। বরং বারবার সময় বাড়াতে হয়েছে। এতে কোনো কোনো প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণও হয়ে গেছে। সরকারকে এ জন্য মাশুলও দিতে হয়। মূলত এ মাশুল সরকার নয়, জনগণ দেয়। কারণ, সরকারের নিজস্ব কোনো আয় নেই। সে আয় করে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়। ফলে উন্নয়নমূলক যত প্রকল্প রয়েছে সেগুলো যথাসময়ে শেষ না হওয়ার অর্থ জনগণের ক্ষতি হওয়া। সরকারের তরফ থেকে যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনার পরিসংখ্যান দেয়া হয়, তা নিয়ে অথর্নীতিবিদদের অনেকের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ এ উন্নয়নকে পরিসংখ্যানের উন্নয়ন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ মানুষের উন্নয়ন না বলে ইট, পাথরের উন্নয়ন বলেন। তবে আমাদের উন্নয়নের অন্তর্গত শক্তি কতটা তা করোনা মোকাবেলায় অঘোষিত লকডাউনের সময় কিছুটা হলেও বোঝা যাচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষ, দিন মজুর, নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে নুন আনতে পান্তা ফুরানো শ্রেণির মানুষের কী দুদর্শা শুরু হয়েছে, তা কল্পনার অতীত। ইতোমধ্যে এ শ্রেণির কেউ কেউ এর মধ্যেও ঘর থেকে বের হচ্ছে। অনেককে বলতে শোনা গেছে, করোনায় মরার আগে ক্ষুধায় মরে যাব। উভয় সঙ্কটে পড়ে তাদের এখন ত্রাহী অবস্থা। এদের সহায়তায় সরকারের উদ্যোগ এখনো ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করেনি। এ পর্যন্ত যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল। ৬৪ জেলার জন্য ত্রাণ ও দুযোর্গ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ করেছে ৮ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ খাদ্য এবং অর্থ যে পযার্প্ত নয়, তা পাঠককে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ খাদ্যপণ্যের ব্যাগ নিয়ে এসব মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এ সহায়তা আপৎকালীন, দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। করোনার এ পরিস্থিতি কতদিন থাকবে তা অনিশ্চিত। ফলে অসহায় মানুষের পাশে দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
করোনা মোকাবেলায় প্রথম কাজই হচ্ছে হোম কোয়ারিন্টিন। ঘরবন্দি হয়ে থাকা। তবে কার জন্য কতদিন এই হোম কোয়ারিন্টিন সে বিষয়টি আপেক্ষিক হলেও সাধারণত দুই সপ্তাহ ঘরবন্দি থাকতে হয়। ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকাতে একটি শহর বা এলাকা লকডাউন করা হয়। দেশে এখন মূলত অঘোষিত লকডাউন চলছে। রাজধানীর রাস্তা-ঘাট ফাঁকা। পারতপক্ষে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ঢাকা ছেড়ে এক কোটির বেশি মানুষ সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বলতে গেলে তারা হলি ডে মুডে আছে। গ্রামের বাড়ি গিয়ে মনের আনন্দে ঘুরাঘুরি করছে। কোয়ারিন্টিনের বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। এ আচরণ যেমন কাম্য নয়, তেমনি বিপজ্জনকও বটে। এ অবস্থায় সাবধানতা অবলম্বনের বিকল্প নেই। তবে আল্লাহর রহমতে যেসব এলাকা বিপদমুক্ত সেসব এলাকায় ঢাকা থেকে আগতরা নিজেদের কল্যাণমুখী কাজে নিয়োজিত করতে পারে। এই সুযোগে নিজ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলে দিতে পারে। বেশি বেশি গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন কমর্সূচি গ্রহণ করতে পারে। নিজ এলাকাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারে। এতে একদিকে করোনাভাইরাস মোকাবেলা যেমন সহজ হবে, তেমনি এলাকার উন্নয়নও সাধিত হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার ভয়াবহ প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর যে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষি খাতেও সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এই বোরো মৌসুমেই এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। ধান কাটা এবং মাড়াইয়ে লোকসঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাজারজাতেও সমস্যা দেখা দিবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলো মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে। আগামীতে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমাদের জন্যও এটা কম উদ্বেগজনক নয়, যদিও আমাদের খাদ্য মজুদ আশাব্যঞ্জক। এ বিষয়টি মাথায় রেখে রাজধানী ছেড়ে যাওয়া মানুস স্ব স্ব এলাকায় কৃষিখাতে মনোযোগ দিতে পারে। অনেকে মৎস্য চাষের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। অথার্ৎ লম্বা ছুটি পেয়ে রাজধানী ছেড়ে বাড়িতে গিয়ে নিছক বিনোদনে মেতে না থেকে নতুন কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। এ কথা মানতে হবে, করোনা পুরো বিশ্বের প্রচলিত জীবনধারা বদলে দিয়ে নতুন এক জীবনধারার সূচনা করছে। হুট করে নতুন ধারায় অভ্যস্থ হওয়া সম্ভব নয়। পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে কঠিন পরিস্থিতি সহজে মোকাবেলা করা যায়। এই দীর্ঘ ছুটিতে প্রত্যেককে ভবিষ্যতের কঠিন পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। করোনা আতঙ্কে রাজধানী থেকে প্রায় অর্ধেক লোক চলে গেছে। বতর্মানে যত লোক রয়েছে তাও রাজধানীর তুলনায় বেশি। রাজধানী যে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে তার অন্যতম কারণ এর অতিরিক্ত জনসংখ্যা। অন্যদিকে বাংলাদেশ বলতেই ঢাকাকে বোঝায়। যে কোনো কাজে ঢাকা আসতে হয়। আর নদী ভাঙ্গন থেকে শুরু করে অন্য যে কোনো উপায়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের একমাত্র ঠিকানা হয়ে উঠে ঢাকা। এছাড়া বেকার শ্রেণির লক্ষ্যও ঢাকা। প্রত্যেকেরই ধারণা, একবার ঢাকা আসতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মূলত মানুষের এ মানসিকতার কারণেই ঢাকা জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। করোনা মোকাবেলায় অঘোষিত লকডাউনের মধ্যেও দেখা গেছে ঢাকার বায়ু পুরোপুরি বিশুদ্ধ নয়। তার মানে হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির আগে ঢাকা ছিল পুরোপুরি একটা গ্যাস চেম্বার। করোনা পরবর্তী সময়ে কী পরিস্থিতি হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ঢাকার প্রতি মানুষের মোহ কাটবে নাকি আরও বেশি মোহ জাগবে তা এখন বলা যাচ্ছে না। তবে যারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় ঢাকা এসেছে কিংবা আসতে চায়, তাদের যদি মিনিমাম সুযোগ থাকে তবে নিজ এলাকায় উপাজর্নের ব্যবস্থা করা। কারণ, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি যে করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যাবে না তা এক প্রকার নিশ্চিত।
আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। লকডাউন বা কোয়ারিন্টিন থেকে বের হয়ে কিংবা করোনা বিদায় নেয়ার পর মানুষ এক নতুন পৃথিবীর মুখোমুখি হবে। তার চিরাচরিত আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা অনিবার্য হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় সঙ্কট দেখা দেবে অথের্র সংস্থান নিয়ে। ব্যবসা-বণিজ্য, কমর্সংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে কমর্চারী ছাঁটাই করতে হতে পারে। এতে বেসরকারি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কমর্রত অনেকে চাকরিচ্যুত হতে পারেন। ব্যয় সংকোচনের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হতে পারে। কমর্সংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত এবং চাকরিচ্যুতি মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ সময় সরকার তো অনেক পরের ব্যাপার, আপনজনদের পাশে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়বে। সরকার যতই বলুক সমস্যা হবে না, তবে দীর্ঘ মেয়াদে উদ্ভূত পরিস্থিতি শামাল দেওয়াও তার পক্ষে কঠিন। সামনের দিনগুলোর বাস্তবতা এখন থেকেই সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করার পরিকল্পনা করতে হবে। রাজধানী ছেড়ে কর্মজীবী এবং কর্মপোযোগী যেসব মানুষ ছুটি কাটাতে গ্রামে গেছেন, এ অবসরে তারা নতুন উদ্যোগ নিয়ে ভাবতে পারে। মৎস্য, কৃষি, গবাদিপশুর খামারসহ বৃক্ষায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। অবসরের এ সময়কে কাজে লাগাতে পারলে সামনে যে খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা সামাল দেয়া হয়তো অনেকটাই সহজ হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।