পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানবিক গুণসমৃদ্ধ যা কিছু অর্জন তাই শিক্ষা। আর প্রাথমিক পর্যায়ে বা জীবনের শুরুতে যে শিক্ষা অর্জন করে তাই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক পর্যায়ে বা জীবনের শুরুতে বিদ্যালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী যে শিক্ষা অর্জন করে তাই প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা। একটা সময় ছিল, এই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পাড়ি দিতে হতো দীর্ঘপথ। তৎকালীন সময়ে সে কারণে শিক্ষার হার ছিল নগন্য। বিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রী ছিল সংখ্যায় কম। শিক্ষক ছিল অপ্রতুল। বই কিনতে হতো অর্থ দিয়ে লাইব্রেরি থেকে। ফলে দারিদ্র্যের কারণে ঝড়ে পড়ত অনেক শিক্ষার্থী। সবকিছু মিলিয়ে পড়ালেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল কম। বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ধারে-কাছেই। রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষক রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক। বই দেওয়া হচ্ছে সরকার থেকে বিনামূল্যে, যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে এখন বিদ্যালয়মুখী। তাছাড়া পড়ালেখার ব্যাপারে এখন মানুষ অনেক সচেতন। সন্তানের পড়ালেখা করাতে অনেক পরিবারই দরিদ্রতাকে জয় করছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক থেকেই গুরুত্বসহকারে তৈরি করছে। আমাদের সময় যে যত্নটার অভাব ছিল বর্তমান সময়ে সেই যত্নটা প্রাক-প্রাথমিক থেকেই পাচ্ছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। আর কেনই বা করবে না, একটি বাড়ির ভিত্তি যদি মজবুত না থাকে তাহলে সেই বাড়ি কিন্তু বেশিদূর পর্যন্ত উঁচু করা যাবে না। ঠিক তেমনি একটি সন্তানকে যদি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই যত্ন না করা যায় তাহলে রত্ন হবে না। যেমন, আপনি যদি শুরু থেকেই আপনার সন্তানের হাতের লেখা সুন্দর করতে জোর না দেন তাহলে পরবর্তীতে তার লেখার কাঠামো পরিবর্তন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আবার শিশুবেলা থেকেই যদি একজন শিক্ষার্থীকে বই রিডিং পড়ার উপর জোর না দেওয়া যায়, তাহলে সে পরবর্তী শ্রেণিতে গিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণসহকারে পড়তে পারবে না। তাই প্রাথমিক শিক্ষাই শিক্ষার মূলভিত্তি।
এই সময়ে অভিভাবকদের উচিত মানসম্মতভাবে গড়ে তোলা এবং গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়া ও সন্তানের যত্ন নেওয়া। আর সেই কারণে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তারপরও কিছু অচেতন অভিভাবক আছে, যারা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায় না বা শিক্ষার মর্মটা উপলব্ধি করে না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ বছরের প্রথম দিনে দেশের ৪ কোটি ২০ লাখেরও বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৫,৩১,৪৪,৫৫৪টি বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি ৫৪ লাখ ২ হাজার ৩৭৫টি বই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে, যা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মাইলফলক। সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। এছাড়াও চালু রয়েছে বৃত্তিমূলক ব্যবস্থা। সরকারি শিক্ষকদের বেতন হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু যত সুবিধা দিচ্ছে তার থেকে ভালোটা কম পাচ্ছে বলেই মনে হয়। শিক্ষার দিক থেকে যদি বলি তবে সবকিছুর মাঝেও দেখা যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কিছু ঘাটতি রয়েছে। দুর্বল শিক্ষার্থীদের উন্নতি করাতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। আবার মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও মানসম্মত উন্নতি করাতে পারছে না। আর কেজি স্কুলগুলো সেই সুযোগটা লুফে নিচ্ছে। তবে পূর্বের প্রাথমিকের কিছু চিত্র বর্তমানে অনেকাংশে কমেছে। পূর্বে যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ক্লাস হতো না। শিক্ষিকদের ক্লাসে না গিয়ে মাঠে বসে রোদ পোহাতে দেখা যেত। ক্লাস না করে ক্লাসচলাকালীন সময়ে বাজার করতে দেখা যেত। বর্তমানে তা বহুলাংশে কমেছে। এখন যে বিষয়গুলোতে ঘাটতি আছে বলে মনে হয় তা হলো: (১) এক ক্লাসে অধিক ছাত্র-ছাত্রী, (২) শিক্ষার্থী অনুপাতে ক্লাসের সময়সীমা স্বল্প, (৩) শিক্ষকদের যোগ্যতা আর সবচেয়ে বেশি যে বিষয় এবং (৪) পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নকাঠামো। সরকার বইপ্রদানসহ বিভিন্ন সুযোগ দিলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো একটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রী রয়েছে অধিক পরিমাণে। ফলে শিক্ষকরা যথাযথভাবে ক্লাস নিতে পারছে না। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার এয়ারপোর্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য থেকে জানতে পারি, সেখানে একটি শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৮৬ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তার বিপরীতে ক্লাসের সময় ৫৫ মিনিট। একটি শিক্ষার্থীকে ১ মিনিট করে যদি পড়া ধরা হয় সেখানে সময় লাগবে ৮৬ মিনিট। এর সাথে শিক্ষককে পড়াটা বোঝানোর একটা ব্যাপার থাকে। লেখানো ও লেখা দেখার একটি বিষয় থাকে। কারণ অনেক অভিভাবকই বাড়িতে গেলে শ্রেণির কাজ দেখতে চায়। আসলে কীভাবে শিক্ষকরা পড়াটাকে বুঝিয়ে যাচাই-বাছাই করবে বা লেখাবে? অভিভাবকদের আবেদন কিন্তু থাকে যে, শিক্ষক প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন ধরবে। যদি শ্রেণিকে স্বল্প শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করা যায় অথবা ক্লাসের সময় বাড়ানো যায় তবেই পড়াটা বা ক্লাসটা আরও কার্যকর হতে পারে। স্বল্প সময়ে শিক্ষকরা বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না বলে বাধ্য হচ্ছে প্রাইভেট পড়াতে। আর অভিভাবকরাও বাধ্য হচ্ছে প্রাইভেটে দিতে।
এইবার আসা যাক যোগ্যতা প্রসঙ্গে। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণির যে সিলেবাস বা প্রশ্নকাঠামো তাতে দক্ষ ইংরেজি শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষকদের মন্তব্য থেকে জানা যাই, পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়টি তুলনামূলক জেএসসি থেকে কঠিন। কিন্তু সেখানে অনেক শিক্ষিক-শিক্ষিকা রয়েছে যারা এসএসসি পাশ। তাদের যোগ্যতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। একসময় সৃজনশীল ছিল না বা পড়ালেখার কারিকুলাম এমন ছিল যা সেই সময়ের জন্য উপযুক্ত ছিল। ইংরেজি ও গণিতে ভালো করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। আর প্রাথমিকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নকাঠামো। এখনো প্রশ্নকাঠামো দেওয়া হয় নাই বা আগামী ২০২১ সালের বই তৈরির কাজ হয়ত এখনো শুরু হয় নাই। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা প্রশ্নকাঠামোর দিকে তাকালে লক্ষ করা যায় সেখানে কিছু অংশ পাঠ্যপুস্তকবর্হিভূত। যদি বাংলার বিষয়ে বলি, সেখানে রয়েছে বিরামচিহ্ন। অথচ বিরামচিহ্নের যে নিয়মটা রয়েছে কোথায় কী থাকলে কোন চিহ্ন হয় তা পাঠ্যপুস্তকে নাই। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করছে। ইংরেজির প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশ থাকে পাঠ্যপুস্তকবর্হিভূত। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো গ্রামার নাই অথচ পরীক্ষাতে আসছে ডব্লিউ এইচ কোশ্চেন। এটা করতে গেলে সাবজেক্ট, নম্বর, ভার্ব, টেন্স জানা দরকার। এগুলো না পড়িয়ে রিয়ারেঞ্জ বা ডব্লিউ এইচ কোশ্চেন করালে ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ দেবার মতো পরিস্থিতি করা হয়। তাছাড়া যেখানে টেন্স শেখানো হচ্ছে না সেখানে আনসিন প্যাসেজ দিলে কীভাবে লেখা সম্ভব? ধাপে ধাপে না শেখালে ভিত্তি কীভাবে মজবুত হবে? অনেকের মতে তৃতীয় শ্রেণি থেকে কিছু কিছু গ্রামার যোগ করা দরকার। তাছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হিমশিম খেতে হয়। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান ও ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন আসে কিন্তু কোনও অধ্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা নেই। পূর্বে কেমন প্রশ্ন হবে তার নমুনা দেওয়া হতো, এখন কেন নেই? তাতে কি গাইড বিক্রেতাকে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে না? নমুনা দিলে কি খুব ক্ষতি হত? জানি, জাতীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি অতি দক্ষ ও মেধাবী তবুও আমার মতো স্বল্প মেধার একজন নাগরিকের কাছে এই বিষয়গুলো পরিবর্তন বা সংযোজন প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। যে সৃজনশীলতা নিয়ে জাতি গঠনে এগিয়ে চলছে তাতে পাঠ্যপুস্তক সংশ্লিষ্ট প্রশ্নকাঠামো করলে উদ্দেশ্য বেগবান হবে। ফলাফল আরও সুন্দর হবে, সর্বোপরি সৃজনশীলতা এগিয়ে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।