Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উদার ইসলামের কথা বলে বিপাকে এক সউদী ধর্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা

প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

॥ তিন ॥
ইনকিলাব ডেস্ক : এ সময় সউদী বাদশাহ দেখতে পান তাকে একটি পথ বেছে নিতে হবে : কথিত জিহাদের সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখলে ব্রিটিশের সাথে যুদ্ধ অথবা একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। তিনি শেষেরটাই বেছে নেন। নিজের যোদ্ধাদের একটি গ্রুপ যুদ্ধ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের দমন করেন তিনি। তখন থেকে রাজ পরিবার ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে জোট বজায় রয়েছে যদিও আদর্শগত বিশুদ্ধতার সন্ধান ও আধুনিক রাষ্ট্রের আবশ্যকতার মধ্যকার একটি উত্তেজনা সউদী সমাজে বরাবরই বিদ্যমান ছিল।
২০১৬ সাল পর্যন্ত সউদী আরব দ্রুত অগ্রসর হয়েছে। সময় ও তেল সম্পদ প্রধান খেলোয়াড়দের রূপান্তর ঘটিয়েছে। মরুভূমিতে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাসকরা রাজ পরিবারের অবস্থান আজ বিশাল সব প্রাসাদ ও ব্যক্তিগত জেটবিমানের অধিকারী। ওয়াহাবি আদর্শবাদ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন থেকে স্ফীতকায় রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।  
সউদী আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মীয় বিষয়ে প্রশিক্ষিত স্নাতক তৈরি করছে, আইন ব্যবস্থায় বিচারকরা শরিয়া আইন প্রয়োগ করছেন, শীর্ষ আলেমদের এটি গ্রুপ বাদশাহকে পরামর্শ দেয়, অফিসের একটি নেটওয়ার্ক ফতোয়া প্রদান করে, ধর্মীয় পুলিশের একটি বাহিনী জনগণের আচরণ মনিটর করে এবং রাষ্ট্র জুড়ে হাজার হাজার মসজিদের ইমাম মিম্বর থেকে খোৎবার মাধ্যমে সরকারের বার্তা প্রচার করেন।
সকল মসজিদ ও মলগুলোর ভিতর থেকে প্রতিদিন পাঁচবার আজান ধ্বনিত হয় এবং তা এত স্পষ্ট যে বহু সউদীই তারপর দিনের করণীয় নির্ধারণ করেন। তারা আমাকে বলতেন, চলুন,আমরা মাগরিবের নামাজের পর বসি। আমার মাঝে মাঝে গোলমাল হয়ে যেতÑ কোন সময়ের কথা বলছেন তারা? এরপর আমি নামাজের সময় বোঝার জন্য আমার ফোনে একটি অ্যাপ যুক্ত করি। আজানের ধ্বনি শোনা গেলেই তা সংকেত দিত।
এভাবেই মাগরিবের নামাজের পর আমি মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের ষষ্ঠ প্রজন্মের গর্বিত বংশধর শেখের সাথে দেখা করি। ৪২ বছর বয়স্ক স্থ’ূলদেহী এ ব্যক্তিটি সাদা পোশাক পরা ছিলেন, মাথা ঢাকা ছিল চেক কাপড়ে। তার মুখে ছিল দীর্ঘ দাড়ি, গোঁফ ছিল না। নাকের উপর থাকা রিডিং গ্লাসের মধ্য দিয়ে তিনি তার আইফোন দেখছিলেন।  
রিয়াদের একটি হোটেলে সঙ্গীত মুক্ত একটি লবিতে আমরা কাউচে বসেছিলাম। খেজুর ও কফি খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম। তিনি সউদী আরবে ইসলাম সম্পর্কে আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। তিনি প্রথমেই বললেন, আমি খোলা মনের মানুষ। স্পষ্ট বোঝা গেল যে তিনি আশা করেছিলেন যে আমি মুসলমান হব। দেশের ধর্মীয় কর্তৃত্ববানদের দ্বারা তার জীবন নির্ধারিত হয়েছে। তবে তিনি সউদী আরবে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মধ্যকার জটিলতায় আক্রান্ত বলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি অল্প বয়সে কুরআনে হাফেজ হয়েছেন। তিনি শরিয়া বিষয়ে ডিগ্রি নেয়ার আগে প্রখ্যাত আলেমদের কাছে তালিম নেন। তার থিসিসের বিষয় ছিল প্রযুক্তি কীভাবে শরিয়ার প্রয়োগকে পরিবর্তিত করেছে।
এখন তিনি একজন সফল পেশাদার। ধর্মীয় চাকরি করেন। তিনি শরিয়া আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেন, ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রীর পরামর্শদাতা, বাদশাহকে পরামর্শদাতা আলেমদের জন্য গবেষণা পত্র রচনা করেন এবং মেডগালফ বীমা কোম্পানির শরিয়া বোর্ডে তিনি আছেন। শুক্রবার তিনি তার মায়ের বাড়ির কাছে একটি মসজিদে বক্তব্য রাখেন এবং তার চাচা সউদী গ্র্যান্ড মুফতির সাথে সাক্ষাত করতে আসা লোকজনকে স্বাগত জানান।
তিনি ব্যাপক বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি আমাকে আমেরিকান জেনে বললেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ভালবাসেন। তিনি ওরিগন, নিউইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস ও  লসএঞ্জেলেসে গেছেন। একবার সফরে তিনি একটি সিনাগগ ও আরেক সফরে একটি গির্জা পরিদর্শন করেন। তিনি অ্যামিশ সম্প্রদায়ের সাথেও সাক্ষাত করেছেন যাদেরকে তার আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
তার এক আত্মীয় আলাস্কার মন্টগোমারিতে থাকেন। তিনি সেখানে আনন্দময় কয়েকটি মাস কাটিয়েছেন। স্থানীয় ইসলামিক সেন্টারে প্রায়ই যেতেন। তার কাছে যা সমস্যা ছিল তাহল সেখানে বার ছাড়া খাবারের দোকানের সংখ্যা খুবই কম।
তিনি বলেন, ইসলাম ইহুদি বা খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের ব্যবসা বা বন্ধুত্ব করা নিষিদ্ধ করেনি। তিনি শিয়া মতাদর্শ ও তাদের আচারের বিরোধিতা করেন। তবে  ইসলামিক স্টেট সকল শিয়াকে যেমন তাকফির বা কাফের বলে তা ভুল। জন্মদিন সম্পর্কে তিনি বলেন, বহু সউদী আলেমই যার নিন্দা করেন, তিনি জন্মদিন পালনের বিরোধী নন। কিন্তু তার স্ত্রী তার বিরোধী। তাই তাদের ছেলেমেয়েরা জন্মদিনের কোনো পার্টিতে যায় না। তবে তারা নিজস্ব আনন্দ-উৎসব করেন। তিনি ফোনে একটি অনুষ্ঠানের ছবি দেখান যা তার ১৫ বছর বয়স্ক ছেলে আবদুল্লাহর কুরআনে হাফেজ হওয়া উপলক্ষে আয়োজন করা হয়। সেখানে আলো জ্বালানো ও আনন্দ করা হলেও গান গাওয়া হয়নি।
সঙ্গীতের প্রতি তার অনুরাগ আছে। বহু ওয়াহাবির কাছেই তা হারাম। তিনি বলেন, রেস্তোরাঁয় পশ্চাৎপটে গান বাজলে তার আপত্তি নেই, কিন্তু প্রকাশ্যে গান গাওয়ার তিনি বিরোধী যা মদের মত শ্রোতাদের নেশাগ্রস্ত করে ফেলে। তখন তারা লম্ফঝম্প দেয় ও মাথা দোলায়। তিনি বলেন, আমাদের এর চেয়ে ভালো জিনিস আছে। আপনি কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পারেন।
সউদী আরবে নারীদের সাথে পার্থক্য করার ব্যাপারে আমি একজন রক্ষণশীল সউদী নারীর সাথে কথা বলতে চাই যা এক কঠিন ব্যাপার। কারণ, অধিকাংশ সউদী নারীই অনাত্মীয় কোনো পুরুষের সাথে সাক্ষাত করেন না। আমি এক সউদী নারী সাংবাদিক শেইখা আল-দোসারির মাধ্যমে শেখের স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমার সাথে সাক্ষাত করতে রাজি হন।
আমি শেখের অনুমতি চাই। তিনি বলেন, সে খুব ব্যস্ত। অন্য প্রসঙ্গে চলে যান তিনি।
শেখের স্ত্রী দোসারির সাথে রিয়াদে মেয়েদের একটি কফি শপে সাক্ষাত করেন। সেখানে মেয়েরা মুখ ও মাথা খোলা রাখতে পারে। তাদের বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে। তারা চাচাতো ভাইবোন। তার বয়স তখন ছিল ১৬, শেখের ২১। বিয়ের আগে তাদের মধ্যে একবারই দেখা হয়েছিল। শেখ তার মুখ দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি এত লাজুক ছিলেন যে তার দিকে তাকাতে পারেননি। তিনি বিয়ের জন্য শর্ত দেন যে তাকে লেখাপড়া করতে দিতে হবে। শেখ তাতে রাজি হন। তাই তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। তিনি এখন চার সন্তানকে দেখাশোনার পাশাপাশি শিক্ষায় ডক্টরেট করছেন।
সউদী নারীরা অধিকার বঞ্চিত বলে পশ্চিমা ধারণার তিনি বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, তারা মনে করে গাড়ি চালাতে দেয়া হয় না বলে আমরা নিপীড়িত, তা ঠিক নয়।  তিনি বলেন, সউদী আরবে নারীরা বহুভাবে সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে থাকে যা আপনি পাশ্চাত্যে দেখতে পাবেন না। শেখের  স্ত্রীও শেখ আবদুল ওহাবের বংশধর। তিনি গর্বের সাথে বলেন, তার পিতামহ সউদী ধর্মীয় পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা।
ফতোয়া
সউদী সরকার ধর্মীয় মতের প্রবাহকে সরকারী ফতোয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তবে রাষ্ট্র অনুমোদিত ফতোয়া অনেক সময় হাস্যরসের সৃষ্টি করে। যেমন পোকমন সামগ্রীতে অর্থ ব্যয় করা মানে পাপ ও অপরাধে সাহায্য করার ফতোয়া।
সরকার যখন দেশের কর্মীবাহিনীতে অধিক সংখ্যক নারীকে চাইছে তখন রাষ্ট্রের ফতোয়া সংস্থা কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগ দেয়ার বিপদ সম্পর্কে প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা বলছে, এট সমাজ ধ্বংসের কারণ হবে।
সশস্ত্র উগ্রপন্থীদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় যৌক্তিকতা রয়েছে বলে ফতোয়া আছে। সূত্র : দি নিউ ইয়র্ক টাইমস। (অসমাপ্ত)
*নিবন্ধকার বেন হাবার্ড, দি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক।  



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ