পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রবিবারে যখন এই লেখাটি লিখছি তখন করোনা সম্পর্কে একটি সুসংবাদ পাওয়া গেল। শুক্রবারের খবরে বলা হয়েছিল যে, দেশে নতুন কোনো সংক্রমণ নেই, নেই কোনো নতুন মৃত্যুও। শনিবারে এই খবর। নেই কোনো নতুন সংক্রমণ, নেই কোনো নতুন মৃত্যুও। তাহলে কি দেশ থেকে করোনা আপনা আপনিই চলে যাচ্ছে? আমি এতখানি আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ এখনো দেখছি না। এখনো কয়েক হাজার কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। তবে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে আসার জন্য যে বিপুল সংখ্যায় টেস্ট বা পরীক্ষা দরকার সেটি মোটেই সন্তোষজনক নয়। রোগতত্ত্ব ইন্সটিটিউটের তথ্য মোতাবেক ২১ জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত করোনা সন্দেহে পরীক্ষা করা হয়েছে ১০৭৬ জন ব্যক্তিকে। এতগুলো টেস্ট করার পর গত ৮ মার্চ ৩ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে শনাক্ত হয়। এই পরিসংখ্যানে আত্মতুষ্টি লাভের কোনো সুযোগ নাই। কারণ জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ। এর মধ্যে সম্প্রতি যারা দেশে এসেছেন তাদের সংখ্যা ৬ লক্ষাধিক। যারা গত ২১ জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েক ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং অল্প সংখ্যক ব্যক্তিকে নিজ গৃহে কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে স্বল্প সংখ্যক লোককে নেওয়া হয়েছে। সেই ২১ জানুয়ারি থেকে শুরু করে পরবর্তী ২ মাস ৪ দিন পর্যন্ত একটি মাত্র কেন্দ্রেই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সেটি হলো রোগতত্ত্ব ও মহামারী গবেষণা ইন্সটিটিউট। ২৬ মার্চ রোগতত্ত¡ ইন্সটিটিউট ঘোষণা করেছে যে, ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এবং শিশু হাসপাতালেও এখন থেকে পরীক্ষা করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামের ট্রপিক্যাল ও সংক্রামক রোগ ইন্সটিটিউটেও পরীক্ষা করা হবে। তবে দুঃখের বিষয়, পত্রিকান্তরের রিপোর্ট মোতাবেক, শুক্রবার থেকে শনিবার এই ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৮টি পরীক্ষা করা হয়েছে বলে রোগতত্ত্ব ইন্সটিটিউট জানিয়েছে। অথচ সংক্রমণ হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করাটাই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
বাংলাদেশের নোবেল জয়ী ড. ইউনুস এবং বিশ্বের শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তি বিল গেটসসহ সকলেই পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই তারা বলেছেন যে পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। বেসরকারি হাসপাতাল তো দূরের কথা, রোগতত্ত্ব মহামারী ও গবেষণা সংস্থাও বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের সংস্পর্শে আসা স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণ ছাড়া অন্য কোনো কেস পরীক্ষায় অনাগ্রহী ছিলেন।
দুই
এগুলো কিছুটা টেকনিক্যাল বিষয়। বাংলাদেশ এবং বিদেশের প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এই টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষও করোনাকে কেন্দ্র করে এর উৎস, বিস্তার, প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে কিছু কিছু হলেও জেনে গেছেন। তাই আজ স্থান সংকুলান হলে কিছুক্ষণ পরে এসম্পর্কে লেখার ইচ্ছা রইলো। কিন্তু করোনা মোকাবেলায় যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন সেটি দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে। স্বার্থ এবং নিরাপত্তাকে বিসর্জন দিয়ে বিপন্ন মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। করোনা মোকাবেলায় তার দুঃসাহসিক অভিযান আপনাদের সামনে বর্ণনা করার লোভ আমি সামলাতে পারছি না। দৈনিক ‘ইনকিলাবের’ প্রিয় পাঠকদের জন্য নিচে সেই কাহিনী বর্ণনা করছি।
করোনা নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, যে হাসপাতালগুলোতে করোনায় সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা চলছে বা কোয়ারেন্টাইন চলছে সেগুলোতে সারপ্রাইজ ভিজিট করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে মাস্ক, স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অভিযোগ আসার পর নিজে বাজারে গিয়ে নজরদারি চালানো-তার প্রতিটি কাজকেই বাহাবা দিয়েছে সবাই। চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন ‘দয়া করে আপনাদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারাই যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন তবে মানুষই অসহায় বোধ করবেন।’ করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কলকাতা মেডিকেল কলেজকে ‘করোনা হাসপাতাল’ হিসাবে চিহ্নিত করে ৩ হাজার আইসোলেশন বেড তৈরির ঘোষণাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। করোনা মোকাবেলায় ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে রাস্তায় নেমে ইটের টুকরা দিয়ে সুরক্ষা রেখাও টানতে দেখা যায় মমতাকে। পুলিশ কমিশনারকে সঙ্গে নিয়েই পোস্তা, তারাতলা, জানবাজার, গড়িয়াহাটসহ একাধিক বাজার পরিদর্শন করে সাধারণ মানুষের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তার জন্য বাজার খুলে রাখারও নির্দেশ দেন তিনি। সাধারণ মানুষের পেটে যাতে টান না পড়ে, সেদিকে তাকিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এক মাসের রেশনের চাল, গম, এক মাসের মিড-ডে মিলের উপকরণ সরবরাহ, বিধবা পেনশন, কিষাণ পেনশন, জয় জোহারসহ সামাজিক পেনশনের রূপি একসঙ্গে দুই মাসের দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন দুপুরে হাসপাতাল ও কিছু বাজার পরিদর্শন করেন তিনি। লকডাউনের ফলে মানুষ রাস্তায় না বেরোনোয় টান পড়েছে রিকশা চালকদের রুটি রোজগারে। সেই কথাটি মাথায় রেখে এদিন বিকালে অলিপুর সুরক্ষা বলয় মেনেই রিকশা চালকদের হাতে খাবারের (চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, আটা) প্যাকেট তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তার সঙ্গে ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা। পরে কালী ঘাটে নাইট শোলটারে গিয়ে গরিব দুঃস্থদের হাতেও খাদ্য সামগ্রী তুলে দেন তিনি।
তিন
যেসব কারণের জন্য বাংলাদেশে করোনা শনাক্তকরণ এবং এর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে সে সব কারণ শীঘ্রই দূর হবে বলে আশা করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। পরীক্ষা করার সঙ্কট খুব শীঘ্রই দূর হবে বলে মনে হচ্ছে। গণচীন থেকে ২০ হাজার কিট ইতোমধ্যেই এসে গেছে। আরো ১০ হাজার কিট আসবে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনপতি জ্যাক মা অন্ততঃ ৩০ হাজার কিট দেবেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বাধীন বৈজ্ঞানিক টিম গত জানুয়ারি মাস থেকেই বাংলাদেশে কিট উৎপাদনের জন্য কাজ করছিলেন। জানুয়ারির মধ্যেই বোঝা যায় যে, করোনা বৈশ্বিক মহামারীর রূপ ধারণ করতে চলেছে এবং বাংলাদেশও ঐ মহামারীর ছোবল থেকে রক্ষা পাবে না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানতেন যে তার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. বিজন কুমার শীলের সার্স-২ ভাইরাসের কিট উদ্ভাবনে পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। ডা. শীল সিঙ্গাপুরে সরকারি চাকরি করতেন। সেখানে তিনি সার্স-২ এর কিট ও প্রতিরোধক উদ্ভাবনে একটি বৈজ্ঞানিক টিমের সাথে কাজ করেন। সেই সূত্রে তিনি জানতেন যে কোভিড-১৯ সার্স-২ এর পরিবর্তিত কিন্তু ভয়ঙ্কর সংস্করণ। সুতরাং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলার পর তিনি একটি বৈজ্ঞানিক টিম গঠন করেন এবং কোভিড-১৯ এর কিট উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। তারা এই কাজে সফলতা অর্জন করেছেন বলে দাবি করেছেন। বিদেশের একটি কিট দিয়ে কাজ করলে রোগীর অন্ততঃ ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু গণস্বাস্থ্যের প্রস্তাবিত কিটের আমদানিকৃত কাঁচামাল কর ও শুল্ক মুক্ত করলে তারা ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে রোগী পরীক্ষা করাতে পারবেন। আজ মঙ্গলবার ৩১ মার্চের মধ্যেই এই কাঁচামাল ইংল্যান্ড থেকে আসার কথা। এসে পৌঁছলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই গণস্বাস্থ্য কয়েক হাজার কিট সরকার এবং ফার্মেসিগুলোকে সরবরাহ করতে পারবে বলে গণস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আশা করছেন।
এখানে একটি বিষয়ের প্রতি আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও দোকানদাররা বর্তমান সঙ্কটে বিন্দুমাত্র মানবতার পরিচয় দেননি। দুনিয়া জুড়ে যেখানে লাশের মিছিল সেখানেও তারা উচ্চ মুনাফার লালসা ত্যাগ করতে পারেননি। এখন আবার গণস্বাস্থ্যের কিট বিক্রয় নিয়ে তারা যাতে মজুদদারী এবং মুনাফাখোরী করতে না পারে সেদিকে সরকারকে সার্বক্ষণিক নজরদারী রাখতে হবে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো চিকিৎসক এবং সেবক সেবিকাদের নিরাপত্তা সামগ্রী প্রদান, যেটিকে বলা হয় পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই। এ ব্যাপারে সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বিজনেস হাউজ বেক্সিমকো করোনায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই ক্রয়ের জন্য ১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৫ কোটি টাকা দান করেছে। এই অর্থ থেকে সরকার প্রয়োজন মনে করলে ওষুধপত্র ও টেস্ট কিটও সংগ্রহ করতে পারবে। তবে যেসব প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট ইতোমধ্যেই আনা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ‘টি ওয়াই ভিই কে প্রটেকটিভ কাভার অল’, মাস্ক,গ্লাভ্স, গগলস্ ইত্যাদি। এগুলো খুব উন্নতমানের বলে জানা গেছে। প্রথম দফায় এগুলি ঢাকায় সরবরাহ করা হবে। দ্বিতীয় দফায় সারা দেশে ১৫০টিরও বেশি হাসপাতালে সরবরাহ করা হবে।
একটি প্রশ্ন রেখে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। আমি প্রথমেই বলেছি যে, শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে নতুন কোনো সংক্রমণ নাই, নাই কোনো নতুন মৃত্যুও। তাহলে কি ভাইরাসটি বাংলাদেশ থেকে আপনা আপনিই চলে যাচ্ছে? সরকার যেমন কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো তো গত ২৪ ও ২৫ মার্চ থেকে। অবশ্য ১৭ মার্চ স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা, স্বাস্থ্যবিধিসমূহ যথা হাঁচি-কাশির এটিকেট বজায় রাখা, বারবার সাবান-পানিতে হাত ধোয়া, অপরিষ্কার হাতে মুখমন্ডল স্পর্শ না করা, কোলাকুলি না করা, ইত্যাদির সাফল্য পাওয়া যেতে পারে ৫ এপ্রিলের পর বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু ২৭ ও ২৮ মার্চ থেকেই করোনার প্রকোপ কিছুটা কমেছে। এর কারণ সম্যকভাবে অবগত হওয়ার জন্য আমাদেরকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।