Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনার বিপর্যয় মানুষের অসহায়ত্বের প্রমাণ

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

করোনা ভাইরাসের কাছে পুরো পৃথিবীই আজ বিপর্যস্ত। পৃথিবীর প্রায় দু’শ দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ভয় এবং আতঙ্ক সবাইকে গ্রাস করেছে। উন্নত-অনুন্নত বলে কথা নেই, সব দেশের বড় বড় শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা। শহরে জনগণের কোলাহল নেই, কাজের ব্যস্ততা নেই। কারো সাথে কেউ প্রাণ খুলে কথা বলছে না। রাস্তা-ঘাটে লোক চলাচল নেই বললেই চলে। যারাই চলাচল করছে, তারা সবাই মাস্ক পরে মুখ ঢেকে চলাচল করছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রী নেই, শপিং মল বন্ধ, পর্যটন কেন্দ্রসমূহ বন্ধ, সি-বিচে মানুষ নেই। ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে লোক নেই, রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ, বিশ্ব বিখ্যাত ফুটবল লীগের খেলা বন্ধ। ফুটবল মাঠে খেলা নেই, গ্যালারিতে দর্শক নেই। বিমানে যাত্রী কম, তাই ফ্লাইট সংখ্যা কমে গেছে। হলিউড-বলিউডে কাজ নেই। নাটক সিনেমার শ্যুটিং বন্ধ, নায়ক নায়িকাদের অভিনয় ও বন্ধ। বিখ্যাত গায়কদের গানের কনসার্ট বন্ধ। রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমাবেশ বন্ধ। বিভিন্ন দেশের বড় বড় পুঁজিবাজারগুলোতে ধ্বস নেমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ কমে গেছে। কোথাও আজ উৎসব মুখর পরিবেশ নেই। সর্বত্রই ভয়, আতঙ্ক এবং স্থবিরতা। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাই যেন আজ থমকে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আজ মন্দার ঢেউ।

জ্ঞানবিজ্ঞানের এত আবিষ্কারের যুগে করোনা নামক একটি ভাইরাসের আক্রমণে মানুষ মারা যাবে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তবে তাই এখন সত্য। জ্ঞানবিজ্ঞানে অতি উন্নত এবং অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশসমূহ যখন অতিব ক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের কাছে পরাজিত হয়, তখন মানুষের উচিত বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা এবং গবেষণা করা। মানুষের আজ অহমিকার শেষ নেই, দাম্ভিকতার অন্ত নেই। একটু ক্ষমতা পেলেই বাহাদুরি করতে কোনো কমতি থাকে না। মানুষ বেপরোয়া এবং যখন যা খুশি করে বেড়ায়। অপরের অধিকার কেড়ে নেয় এবং মানুষকে নির্যাতন করে। করোনা নামক একটি ভাইরাসের কাছে মানবজাতির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি আবারো দিবালোকের মতো ফুটে উঠেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানে মানুষের অভূতপূর্ব উন্নতির যুগেও তারা একটি ভাইরাসের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছে না। করোনা আতঙ্কে মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। একে অপরের সাথে স্বাভাবিকভাবে দেখা করছে না, কথা বলছে না এবং সবাই আতঙ্কিত। সুতরাং মানুষের উচিত তার অসহায়ত্বের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা এবং গবেষণা করা। তার উচিত অহমিকা, অহংকার এবং দম্ভ পরিহার করা। তার উচিত অন্যায় কাজকে পরিহার করা এবং সত্য-ন্যায়ের পথে চলা। তার উচিত মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করা এবং মানুষের ওপর দমন-নিপীড়ন বন্ধ করা। তার উচিত স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা এবং অতীত ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা। তা না হলে মানুষের জন্য দুঃখ এবং কষ্টই হবে একমাত্র অর্জন।

এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের আসলে অহঙ্কার করার মতো কিছুই নেই। তার জন্ম এবং মৃত্যুর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার জন্মের সময় এবং জন্মস্থান নিজ কর্তৃক নির্ধারিত নয়। কে কখন মারা যাবে তা জানার কোনো ব্যবস্থা নেই। মানুষ ইচ্ছা করলে নিজের শরীরটাকে ছোট বা বড় করতে পারে না। তার গায়ের রংটাও পরিবর্তন করতে পারে না। ইচ্ছা করলেই মানুষ আকাশে উড়তে পারে না, সাগর তলে বাস করতে পারে না এবং হাজার বছর ধরে বাচঁতেও পারে না। তবু মানুষের এই সব বিষয়ে কোনো ভাবনা নেই। অর্থবিত্ত আভিজাত্যের নেশায় মানুষ মশগুল। ক্ষমতার মোহে অন্ধ। জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। দুর্নীতি করে সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একটি বাড়ি হলে চাই আরো একটি বাড়ি, একটি গাড়ি হলে দরকার আরো একটি গাড়ি। বিলাসিতার শেষ নেই, চাহিদার সীমা নেই। অথচ এই সব অর্থ, সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতার বাহাদুরী সবই ছেড়ে মানুষকে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়। যেই সম্পদ সে অর্জন করে, সেই সম্পদই সে ভোগ করতে পারে না। এটাই অনিবার্য বাস্তবতা। তবু মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই, অহমিকার অন্ত নেই।

মানুষেরা এই পৃথিবীতে যা কিছুই বানিয়েছে তার সবকিছুর উপাদান কিন্তু প্রকৃতিতেই বিদ্যমান। মানুষ কেবল চিন্তা, গবেষণা এবং পরিশ্রম করে সেটাকে ব্যবহারের উপযোগী করেছে। আমরা লোহা দিয়ে বাড়ি, বিমান, জাহাজ তৈরি করেছি। কিন্তু সেই লোহা তো প্রকৃতিরই দান। আমরা জ্বালানি তেল দিয়ে গাড়ি, বিমান, জাহাজ, কলকারখানা সবই চালাচ্ছি। কিন্তু সেই জ্বালানি তেল ও প্রকৃতিরই দান। মানুষ সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির চমকপ্রদ উপাদান কম্পিউটারের চিপসের মূল উপাদান সিলিকন তো প্রকৃতিরই অবদান। মানুষ গবেষণার মাধ্যমে সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করেছে। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে প্রতিটি জিনিসই প্রকৃতির দান। যে সূর্য পৃথিবীকে আলো দেয়, যে চন্দ্রকে আমরা উপভোগ করি তাও প্রকৃতির দান। আবার সাগর, নদী, পর্বত ও মানুষের হাতে সৃষ্ট নয়। যে অক্সিজেন আর পানি নিয়ে আমরা বেঁচে আছি, সেটাও প্রকৃতির দান। যে খাবার আমরা খাই, তাও সব প্রকৃতির অসীম দান। আর, জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষ সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে না। চিকিৎসাবিজ্ঞান একজন মানুষের রোগ নিরাময়ে সক্ষম। কিন্তু তাই বলে মানুষকে অমরত্ব দানে সক্ষম নয়। নারী গর্ভে থাকা সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে তা প্রসবের আগে জানা সম্ভব। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছামত ছেলে অথবা মেয়ে শিশুর জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। মানুষ তার ইচ্ছামত দিনরাত্রিকে যেমন বড় ছোট করতে পারে না, ঠিক তেমনি রোদবৃষ্টি আর শীতকে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একইভাবে ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বন্ধ করার উপায় ও মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ, মানুষের জ্ঞান এবং ক্ষমতার একটি সীমারেখা আছে, যা অতিক্রম করা কোনো মানুষের পক্ষে কোনো দিনও সম্ভব নয়। এই বাস্তবতাকে মানতেই হবে।
সুতরাং মানুষের উচিত বাস্তবতায় ফিরে আসা, বাস্তববাদী হওয়া এবং এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করা। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই নিজেদেরকে জানি, স্রষ্টাকে জানি এবং তাকে মানি। কীভাবে এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হলো, এই পৃথিবীতে আমাদের কাজ কী এবং মরণের পরে কী হবে সে সব বিষয় জানা এবং সেই অনুযায়ী পথ চলা আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব। তাহলেই কেবল মানুষের জীবন শান্তির এবং সুখের হবে। তা না হলে মানুষের জন্য দুঃখ আর কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নেই, যা কারো কাম্য নয়। এদিকে উন্নত দেশসমূহ অস্ত্র তৈরির পিছনে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এবং এই খরচ বছরের পর বছর ধরে চলছে। আর অনুন্নত দেশসমূহ প্রতি বছর অস্ত্র কেনার পিছনে খরচ করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। অথচ পৃথিবীতে ছয় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু আর একশত কোটি মানুষ দরিদ্র। অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশ যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, তার সিকি ভাগও যদি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করত, তাহলে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং করোনাসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি বহু আগেই দূর হতো আর বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন অনেক উন্নত হতো এবং একইসাথে মানবজাতি সুখী হতো। আর এটাই হতো সত্যিকারের মানবতার কল্যাণ।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৪ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
১০ ডিসেম্বর, ২০২২
১০ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন