২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মোটা হবেন ৪০০ কোটি মানুষ
২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মোটা হবেন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। সংখ্যার বিচারে যা
শরীর সুস্থ রাখার জন্য আমরা যা কিছু খাই তাই খাদ্য। সহজ করে বলা যায়, আমরা যা খাই তা যদি শরীরে কোন কাজ করে এবং ক্ষুধা নিবারণ করে ও তৃপ্তি দেয় তবে তাই খাদ্য। খাদ্য ছাড়া কোন জীবই বাঁচতে পারে না। তাই বিশ্বের সব মানুষের একই শ্লোগান-সবার আগে খাদ্য চাই, সবার জন্য খাদ্য চাই। আমাদের বাসায় কোনো মেহমান এসে চলে যাওয়ার সময় খাবারের থালা সামনে দিয়ে সুন্দর লবণপাত্রে নিমক দিয়ে সামনে রাখা হয় সর্বপ্রথম। তারপর ভাত ও অন্যান্য রান্না করা তরকারি আনা হয়। সেগুলো পরিবেশনের সময়ও সবিনয় বলা হয় লবণভাতই খেতে হবে। বেশি কিছু এন্তেজাম করতে পারিনি। সে যা-ই হোক, আমরা তরকারি সুস্বাদু করতে পরিমাণমতো লবণ প্রয়োগ করি। এই লবণ কেউ বেশি খান, কেউ কম। কেউ পাতে আলগা লবণ খান। কথা হলো, লবণ খেতে হয় পরিমাণমতো। চিকিৎসকদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য ১ গ্রাম এবং অপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য আরো কম খেতে হবে। তা ছাড়া পাতে কোনো কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, বেশির ভাগ দেশে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ৭ থেকে ১০ গ্রাম লবণ খায়। আরো অবাক হবেন, বাংলাদেশের মানুষ ১০ গ্রামেরও বেশি লবণ খায়। তারা জানে না যে, বেশি লবণ খেলে কী হয়। ঢাকার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক ১৬ গ্রাম লবণ খায়। এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বেশি লবণ গ্রহণের পরিণাম হলো স্ট্রোক, হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাক। এ তিনটি রোগে বিশ্বে বর্তমানে ২৫ লাখ লোক মারা যায়। তাই লবণ গ্রহণ কমাতে হবে। দৈনিক ৬ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া যাবে না। এর কম হলে আরো ভালো। এ কথাটি গুরুত্বসহকারে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
বেশি লবণ খেলে যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, হৃদরোগ ইত্যাদি। এর ফলে হঠাৎ অকালমৃত্যু হতে পারে। এসব রোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ- পৃথিবীর সব দেশে উচ্চ রক্তচাপ রোগটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে প্রায় ১৫০ কোটি লোক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। নগরায়ন ও অসচেতনতার জন্যই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। অধিক পরিমাণে লবণ গ্রহণই উচ্চ রক্তচাপের কারণ বলে হৃদরোগ বিশষজ্ঞদের অভিমত। যে সব মানুষ লবণ খায় না বা কম খায় তারা উচ্চ রক্তচাপের শিকার হয় না। স্ট্রোক বা হার্ট ফেইলিউরও হয় না। দীর্ঘ দিন কম লবণ খেলে বার্ধক্যেও উচ্চ রক্তচাপ হয় না। আসলে উচ্চ রক্তচাপ শুরু হয় শৈশব থেকেই। আবার কারো কারো বংশগত। এক জরিপে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ লোক উচ্চ রক্তচাপ রোগে মারা যায়। এই মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে লবণ কম খেতে হবে।
স্ট্রোক - যেসব অপ্রাপ্ত বয়স্ক লোক হঠাৎ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, মুখমন্ডল বেঁকে যায়, শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যায়, তাদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ফলেই এসব হয়। প্রতি বছর বহু লোক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। ধূমপান ও অধিক লবণ গ্রহণই এর প্রধান কারণ। লবণ সরাসরি দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও লবণ কম গ্রহণ করে এই স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই লবণ কম খান। ধূমপান বর্জন করুন।
হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিউর-হৃদরোগ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করে নিয়ন্ত্রণ করে এসব সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। অধিক লবণ গ্রহণে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে। ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। লবণ কম খান, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি কমবে।
পাকস্থলীর ক্যান্সার- যারা বেশি লবণ খায়, তাদের পাকস্থলীর ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে হেপাটোব্যকটার পাইলোরি নামক ব্যাক্টেরিয়া কর্তৃক পাকস্থলী সংক্রমিক হয়। যেসব লোক বেশি বেশি লবণ খায় তারা পাকস্থলীর ক্যান্সারের আক্রান্ত হয়।
কিডনি রোগ- যাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাদের প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পায়। কিডনি রুগীরা যদি লবণ না ছাড়ে তাহলে রোগ বেড়ে যায়। প্রস্রাবের সাথে অধিক লবণ বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ক্যালসিয়াম নির্গমনও বেড়ে যায়। এ কারণে কিডনিতে পাথর হতে পারে। অধিক লবণ গ্রহণে স্থুলতা বাড়ে। অ্যাজমা হতে পারে।
অস্টিওপরোসিস- হাড় সুস্থ ও সবল রাখতে ক্যালসিয়াম অত্যাবশ্যক । বেশি বেশি লবণ গ্রহণে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
কিভাবে অতিরিক্ত লবণ শরীরে প্রবেশ করে : কোনো কোনো পরিবারে সুন্দর লবণদানিতে সাদা ধবধবে কাঁচা লবণ রাখা হয়। তাদের কাঁচা বা আলগা লবণ খাওয়ার অভ্যাস । তারা খাওয়া শুরুর আগে জিহবায় একটু কাঁচা লবণ দিয়ে খাওয়া শুরু করে। ওদিকে তরকারি রান্নায় একটু বেশি লবণ দেয়া হয়। এসব ওই পরিবারের অভ্যাস। অভ্যাসটি মারাত্মক ক্ষতিকর। তারা সালাদে বেশি লবণ দেয়। বাজার থেকে কিছু কিছু খাবার কিনে আনেন, যাতে বেশি লবণ থাকে। যারা নোনা ইলিশে বেশি লবণ দেখেই কিনে আনেন, শুঁটকি রান্নায় বেশি লবণ দেন। টক বরই, জলপাই ইত্যাদি আমরা কাঁচা লবণ দিয়ে খাই, যা ক্ষতিকর। বাজারের চাইনিজ খাবারে, স্যুপে ও অন্যান্য ফাস্টফুডে বেশি লবণ দেয়া হয় মুখরোচক করতে। আমরা সেগুলো কিনে এনে পরিবারের সবাই মিলে মজা করে খাই। এভাবে আমরা লবণ বেশি গ্রহণ করি এবং নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকি। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। খাওয়ার টেবিল থেকে লবণ সরিয়ে রাখুন। প্রতিজ্ঞা করুন আলগা বা কাঁচা লবণ খাবেন না। তাহলেই অভ্যাস হয়ে যাবে। উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর থেকে রক্ষা পাবেন। তাই বলেছিলাম নিমকহারাম বা লবণহারাম নয়, তবে যথাসম্ভব কম লবণ খেতে হবে। তাহলে সুস্থ থাকতে পারবেন।
এম. লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।