Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

খিলগাঁয়ে ২ সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা

দাম্পত্য কলহের বলি শিশু দু’টি

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাজধানীর খিলগাঁওয়ে দুই শিশুকে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে। নিজের হাতেই বটি দিয়ে দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন মা আরিফুন্নেসা পপি। ঠিক মতো স্বামী সংসার খরচ না দেয়ায় জীবনযাপনে দুর্বিষহ হয়ে ওঠায় দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেও শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান বলে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের অবজারভেশন কক্ষে সাংবাদিকদের জানান তিনি। নিহত শিশুরা হলো-মেহজাবিন আলভী (১১) ও জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত (৬)। ময়না তদন্তের জন্য নিহতদের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।

গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে খিলগাঁওয়ের গোড়ান এলাকার ৩৭৯ নম্বর বাসার চারতলার একটি ফ্লাট থেকে শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একইসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টায় নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দগ্ধ পুপিকেও উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ প্রহরায় তার চিকিৎসা চলছে। তার শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, শিশু দুটির লেখাপড়ার খরচসহ না বিষয়ে পপি এবং তার স্বামীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। সাংসারিক শান্তি ছিল না তাদের মধ্যে। এসব কারণে স্ত্রী হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। দুই শিশুকে হত্যার পর তিনি নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। তবে এ ঘটনায় তার স্বামী মোজাম্মেল হক বিপ্লবকেও থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তিনি পপির প্রাথমিক জবানবন্দীর কথা উল্লেখ করে বলেন, শিশুদের বাবা তাদের দেখাশোনা করতো না। মেয়ে দুটো ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে পড়াশোনা করতো। আর মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে ইলেকট্রিকের ব্যবসা করে বিপ্লব। কিন্তু ব্যবসার সব আয় তার ভাই হিসাব করেন। সে কোনো হিসাব রাখে না।
খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান বলেছেন, বাসায় একটি চিঠি তারা পেয়েছেন, যাতে সাংসারিক বিভিন্ন ঝামেলার কথা বলা হয়েছে। এটাকে সুইসাইডাল নোট বলা যায় না, কারণ সব লেখা সরাসরি লেখা নেই। তবে ইঙ্গিত বহন করে বলেন তিনি।

তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অভাবে নয়, অন্য কারনেও হত্যাকান্ড হতে পারে। তবে বিষয় গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পপির স্বামী অধিকাংশ সময় ব্যবসার নাম করে মুন্সিগঞ্জে বসবাস করতেন। তাই এই বিষয় গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে হাসপাতালে পপি সাংবাদিকদের বলেন, দুই সপ্তাহ আগে ৪০দিনের চিল্লায় যায় শিশুদের বাবা। এই ৪০দিন আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি সে। তেমন কোনো খরচও দিয়ে যায়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলেই সে আমাকে তালাক দেবে হুমকি দিতো। অন্যত্র বিয়ে করবে এসব হুমকিও দিতো। বাচ্চাদের পড়াশোনার কথা বলতে গেলেই সে বলে তুমি বাচ্চাদের নিয়ে শ্রীনগরে চলে আসো। বাচ্চাদের এখানে ভর্তি করাবো। এখানে ভালো মাদরাসা আছে।

তিনি আরো বলেন, গত মাসের ২৮ফেব্রæয়ারি সর্বশেষে ঢাকায় আসে বিপ্লব। গত শুক্রবার আবার আসার কথা থাকলেও আসেনি। মোবাইলে বলে বাসায় আসার কথা। এরপর মেয়েদের পড়াশোনার টাকার কথা বললে খারাপ ব্যবহার করে। তখন বাচ্চাদের কেন খুন করলেন, কীভাবে খুন করলেন-জিজ্ঞেস করলেই নিশ্চুপ হয়ে যান পপি। নিহত আলভী খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে, জান্নাত একই স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ছাত্রী ছিল।
পপি আরো বলেন, মুন্সিগঞ্জে তন্নী আক্তার নামের এক মেয়ে সঙ্গে তার স্বামীর দীর্ঘ দিন ধরে মন দেয়া নেয়া চলছে। এই ঘটনা জানাজানি হলে সে আমার সংসারের নিয়মিত খরচ দিতো না। বরং আমাকে নানা ভাবে নির্যাতন করতো। এমনকি সে মাসের মধ্যে দুই এক দিন ঢাকায় থাকতো আর বাকী দিন গুলো মুন্সিগঞ্জে ওই মেয়ের সঙ্গে সময় পার করতো। জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সন্তানদের গলাকেটে হত্যার পর তাদের (সন্তান) শরীরে আগুন ধরিয়ে দেই। নিজের শরীরেও আগুন ধরিয়ে দেই।
পপির বড় ভাই অনিক বলেন, ১৩ বছর আগে পপির বিয়ে হয়। তার স্বামী মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের বাজারে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা করেন। বিয়ের পর থেকে পপি গোড়ানে স্বামী সঙ্গে বাসা ভাড়ায় বসবাস শুরু করেন। তাদের দুই মেয়ে আলভী ও জান্নাতুল। তারা দু›জনেই ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে পড়তো। পারিবারিক অশান্তির কারনে এ ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

খিলগাঁও থানায় বিপ্লব সাংবাদিকদের জানান, প্রতি শুক্রবার তিনি ঢাকায় আসেন। কিন্তু বাড়িতে একটি জমি নিয়ে ঝামেলা থাকায় এবার তিনি আসতে পারেননি। তবে পপির সঙ্গে কথা হয়েছে। গত শুক্রবার রাত রাত ৯টার দিকে কথা হয়। আমি বলেছি, রোববার আসব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার কথায় কোনো রাগ ছিল না। এ রকম একটা যে ঘটনা ঘটাবে, তার সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়নি।
প্রতিবেশী মাহবুব হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এই পরিবারের লোকজন অন্যদের সঙ্গে তেমন মেলামেশা করতেন না। গৃহবধূ পপি পর্দানশিন ছিলেন। তিনি মেয়েদের স্কুলে আনা-নেয়া করতেন। প্রায়ই বাচ্চাদের মারধর করতেন তিনি। বাইরে থেকে তা বোঝা যেত। শনিবার সকালে পপির বাবা খুব জোরে বাইরে থেকে দরজা খোলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছিলেন। কিন্তু দরজা খোলা হচ্ছিল না। পরে আমরাও যাই। এ সময় ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়া হয়। পরে দু’টি বাচ্চাকে হত্যা ও পপির শরীরে আগুন লাগার বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশ উদ্ধার করে ও ওই মহিলাকে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে সিআইডির ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহ করেছে বলেও তিনি জানান।

পপির বাবা আবু তালেব বলেছেন, নিজের দুই মেয়ে শিশুকে হত্যা করেছে পপি। এরপর সে নিজেই নিজের শরীরে আগুন দিয়েছে। শনিবার সকালে আমার মেয়ে পপির তার দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে আমার বাসায় এসে নাস্তা খাবার কথা ছিল। কিন্তু সকালে যখন তারা আসেনি, তখন তাকে ফোন দিতে দিতে অস্থির হয়ে যাই। সে ফোন রিসিভ করছিল না। মেয়ের বাসা আমার বাসার পাশেই; এরপর সেখানে ছুটে যাই।
তিনি বলেন, মেয়ের বাসা ছয়তলা বাড়ির চারতলায়। ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিলেও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিচ্ছিল না। পরে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলারা এসে বলেন, রাতের বেলায় আপনার মেয়ে তার দুই মেয়েকে অনেক মারধর করেছেন। আমরা চিৎকার শুনেছি। একপর্যায়ে আমরা দরজা ধাক্কা দিলে আপনার মেয়ে দরজা একটু খুলে বলেন, কিছু হয়নি, আপনারা ঘুমিয়ে পড়েন।

আবু তালেব বলেন, জোরে জোরে ধাক্কা দিতে থাকলে কিছুক্ষণ পরে গায়ে কম্বল ঝরানো অবস্থায় দরজা খুলে পপি। খুলেই চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলতে থাকে, বাবা আমার দুই মেয়েকে আমি হত্যা করেছি। পরে আমার নিজের গায়ে আমি নিজেই আগুন দিয়েছি।

দুই শিশুকে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহামুদ সাংবাদিক বলেন, গলাকেটে শিশু দুটিকে হত্যার পর তাদের শরীরে আগুন দেয়া হয়েছে। এদের গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। একজনের আনুমানিক পাঁচ ইঞ্চি, আরেকজনের চার ইঞ্চির আঘাত রয়েছে। এছাড়া দুজনেরই শরীর দগ্ধ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আত্মহত্যা

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ