পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধসৃষ্ট বিশ্বমন্দা আরও গভীরতর হচ্ছে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯)। চীনে প্রাদুর্ভূত এই প্রাণঘাতী ভাইরাস বহু দেশে সংক্রমিত হয়ে মহামারীর আকার ধারণ করেছে। গত ৪ মার্চের তথ্য মতে, এই নবতর ব্যাধিতে ৩,২০০ জন মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৯২ হাজার মানুষ! আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ৭০। প্রাণীরা পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে। অথচ এর নিরাময়ী ওষুধ আবিষ্কার হয়নি এখনও। তবে, করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পুর্ডু ইউনিভার্সিটির বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে এই যন্ত্রে। তবুও বিশ্বব্যাপীই মহাআতংক সৃষ্টি হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে। ফলে মানুষ ও পণ্য চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য, পর্যটন, ইত্যাদি স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক খেলা ও সম্মেলন। এই অবস্থা কতদিন চলবে তা বলা কঠিন। ফলে বিশ্বমন্দা প্রকট হচ্ছে, যা ২০০৮ সালের মন্দার পর সর্বোচ্চ সংকট বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তারা আরও জানিয়েছে, এই সংকটের ব্যাপক প্রভাব পড়বে রাজনীতি ও সমাজে। হু গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এটাকে বিশ্বের এক নম্বর শত্রু হিসাবে আখ্যায়িত করে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। এছাড়া, করোনাভাইরাস বিশ্বকে অচেনা পরিস্থিতিতে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছে হু। সংস্থাটি আরও বলেছে, জরুরি সহায়তার জন্য ৬৭.৫ কোটি ডলার সহায়তা দরকার। অন্যদিকে, গত ২ মার্চ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মানবিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংস্থা দুটি তাদের সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। তাদের বিশেষ নজর থাকবে দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা জনগণের দেশগুলোর দিকে।’ বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলো মন্দা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য আলোচনা করছে। এই নবতর ভয়াবহ সংকট থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। বাংলাদেশের সব ধরনের বন্দর বা পোর্টে থার্মো স্ক্যানারের মনিটর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ, এ দেশের নিরাপত্তার জন্য তা খুবই দরকার বলে ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, বাংলাদেশসহ ২৫টি দেশ উচ্চঝুঁকিতে আছে করোনাভাইরাসের। অবশ্য এই ব্যাধিতে এখন পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত না হলেও বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ১৪ দিন ঘরের মধ্যে থাকা এবং একে অপরের সাথে হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু প্রবাসীদের আপাতত দেশে না আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদিকে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। রফতানিও প্রায় বন্ধ হয়েছে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে রাজস্ব আয়, পর্যটন, ওষুধ, ইলেকট্রনিক, নিত্য পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশসহ চীন নির্ভর বিভিন্ন পণ্য আমদানি। কাঁচামালের মজুদ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট শিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এছাড়া, রফতানির ক্রেতা সংকটও হতে পারে। চীনের লোকবল সংশ্লিষ্ট মেগাপ্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতের নির্মাণ কাজ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। কারণ, চীন থেকে আগমনকারীদের ভিসা স্থগিত করা হয়েছে।
অবশ্য দেশের অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে আরও আগে, যা হয়েছে ভয়াবহ ঋণ খেলাপি ও দুর্নীতির কারণে। এসব হয়েছে জবাবদিহিতার অভাবে। ‘গণতন্ত্র কম, উন্নতি বেশি’ এই থিউরি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গণতন্ত্র ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, উন্নতির ধারা নিম্নমুখী হয়েছে। যেমন: যে কোনো দেশের আর্থিক কর্মের হার্ট হচ্ছে ব্যাংক। এ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে ঋণ খেলাপির কারণে, যার পরিমাণ আমানতের প্রায় ১২%, যা বিশ্বে সর্বাধিক! ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যাংক গজিয়ে উঠা ও যাকে তাকে বিপুল অংকের টাকা ঋণ দেওয়া এবং ব্যাংক নীতি পালন না করার জন্যই ব্যাংকের এই করুণ পরিণতি হয়েছে! এ ক্ষেত্রে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মুহিতের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি গত ১৯ ফেব্রæয়ারি প্রকাশিত এক দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থায় নেই, সেটা সত্য। খেলাপি ঋণই বড় সমস্যা তৈরি করেছে। সেখানে কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে বলে মনে হয় না। এটা বছরের পর বছর চলছে। খেলাপি ঋণ কমাতে এখনই উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা নেয়া উচিত। এ অবস্থার জন্য দায়ী আসলে আমরা সবাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোক্তা ছিল না। যারা সুবিধা নিয়েছে, তারা কখনোই উদ্যোক্তা ছিল না। তারা লুটপাট করতে এসেছিল। লুটপাট করে চলে গেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য- সেটা বুঝেও বারবার তাদের সুবিধা দিয়ে গেছি। এজন্য আমিও কিছুটা দায়ী। এসব ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল আমার। আমি পারিনি।’ তার এই মন্তব্য বেসরকারি ব্যাংকের দিকেই বলে মনে হয়। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বিপুল কেন? আসলে বিপুল ঋণ খেলাপির জন্য দায়ী সরকারি নীতি ও হস্তক্ষেপ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া। যা’হোক, দেশের ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এ দেশের কোন কমিশনই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে কমিশনগুলোর সুফল তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সম্ভাব্য ব্যাংক কমিশন নিয়ে বেশি আশাবাদী হওয়া বৃথা। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গত ২ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড হতে পদত্যাগ করেছেন লোপাট হয়ে যাওয়া অর্থ আদায় করা সম্ভব নয় বলে। অন্যদিকে, দেশে ৩৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় রয়েছে। লুটপাট আর নানা অব্যবস্থাপনায় সংকটে পড়া নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে গত ৩ মার্চ একটি বৈঠক হয়েছে। তাতে এ খাতের তারল্য সংকট কাটাতে বিশেষ পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠনের আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু এত বিপুল টাকা সহায়তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ফলে যথা পূর্বং তথা পরং-ই থাকতে পারে এই খাতে। দেশের বীমার অবস্থাও তথৈবচ। হাঁক-ডাক ব্যাপক। কিন্তু ভেতরে ফোকলা। তাই জিডিপিতে অনুপাত মাত্র .০৩% এবং বৈশ্বিক সূচকে ৬৬তম বলে জানা গেছে। কারণ, বীমার অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই মানুষের আস্থাশীল হতে পারছে না দেশের বীমা খাতে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী বীমার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে তাগিদ দিয়েছেন এবার জাতীয় বীমা দিবসে।
দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারকারী অন্য খাতগুলো হচ্ছে শিল্প ও কারখানা। কিন্তু তারও বেশিরভাগ বন্ধ হয়েছে বিশ্বায়ন মোকাবেলা করতে না পেরে। যে সামান্য চালু আছে তাও ব্যাপক লোকসান দিয়ে চলছে। তাই যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে দেশের রফতানির ৮৪% গার্মেন্ট। তারও অবস্থা চরম খারাপ। ইতোমধ্যেই মোট কারখানার ৬০% বন্ধ হয়েছে বিদেশি ক্রেতা সংগঠনের নিরাপত্তা ও পরিবেশ উন্নত করার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরিদর্শন করায়। বাকী যা টিকে আছে, তারও অনেকগুলো বন্ধ হয়ে যাবে পরিদর্শন সম্পন্ন হলে। সর্বোপরি টিকে থাকা গার্মেন্টগুলো হুমকির মুখে পড়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট সংকটে। ইতোমধ্যেই গার্মেন্ট রফতানি গত ৮ মাসে প্রায় ৬% হ্রাস পেয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায়। রফতানি আরও হ্রাস পাবে করোনার কারণে। তাই বিজিএমইএ’র সভাপতি এই পরিস্থিতিকে ‘নাজুক’ বলে অভিহিত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে সরকার হুট করে পানি ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেছে স¤প্রতি। এর ফলে বর্তমান সরকারের আমলে পানির মূল্য বাড়ানো হলো ১২ বার, আর বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হলো ৯ বার। বর্তমান পানি ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব দেশের সব খাতেই পড়বে। তাই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ঊর্ধ্বশ্বাসে উঠবে! স্মরণীয় যে, কম মূল্যের সরকারি বিদ্যুৎ প্লান্টের সংস্কার করার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে অধিক মূল্যের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ক্রয় করার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই ভর্তুকি পরিমাণ গত ১০ বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে বলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন সংসদে। এই বিপুল ভর্তুকি কমানোর জন্যই বিদ্যুতের মূল্য বার বার বৃদ্ধি করা হয়েছে।। তাই জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা ভাড়ার বিদ্যুৎ ক্রয় না করার জন্য বহুবার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সরকার তা শোনেননি। বরং বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে গর্ব করেন অনবরতই। কিন্তু এই বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল তেমন পাচ্ছে না রাজধানীর বাইরের মানুষ। কারণ, প্রায় সময় সরবরাহ বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চালন ব্যবস্থা বৃদ্ধি ও আধুনিক না করার কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তাই অনেক স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও নগন্য।
দেশের মূল অর্থনীতির আরও দু’টি খাত হচ্ছে: প্রবাসী আয় ও কৃষি। কিন্তু এসবেরও অবস্থা খুব ভালো নয়। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ হ্রাস পাচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে। যেটুকু চাহিদা আছে, তাও দক্ষ লোকের। যা এ দেশে তেমন নেই। সর্বোপরি বিদেশে থেকে ব্যাপক হারে শ্রমিক ফেরত আসছে মেয়াদ শেষ হওয়ায় এবং অবৈধভাবে থাকার কারণে। তাই ভবিষ্যতে রেমিটেন্স হ্রাস পাবে ক্রমান্বয়ে। অন্যদিকে, কৃষিও হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বায়নের কারণে। কারণ, বিভিন্ন দেশের কৃষি খাত সম্পূর্ণরূপে আধুনিক হয়েছে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয় খুব কম। আর আমাদের কৃষি এখনও সেকেলে। উপরন্তু কৃষি শ্রমিকের সংকট ব্যাপক। তাই মজুরী অনেক। এভাবে দেশের কৃষির উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক। তাই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এই অবস্থায় দেশের কৃষিকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক করা ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু সেটাও সময় সাপেক্ষ ও অনেক ব্যয় বহুল। যা সরকারের পূর্ণ আনুকূল্য ছাড়া কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের পর্যটনেরও অবস্থা ভালো নয়। আর শেয়ার বাজার তো ধ্বংস হয়েছে অনেক আগেই। শত চেষ্টা করেও জেগে উঠছে না। শেয়ার কেলেঙ্কারিদের শাস্তি না হওয়ায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগও স্থবির হয়ে আছে অনেকদিন যাবত। তবে সরকারি বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। তাতে কিছু উন্নতি বেড়েছে। কিন্তু সেই উন্নতির সিংহভাগ ভোগ করছে পাপিয়া-সম্রাটরা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ, ‘বিশ্বে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় এখন শীর্ষে বাংলাদেশ। অথচ, এর সঙ্গে সমানতালে বেড়েছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। ব্যাংক, বিমাসহ আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। বাড়ছে অর্থপাচার আর খেলাপি ঋণ। দ্রুত উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে প্রকল্প নির্ধারণে অসততার অভিযোগ রয়েছে। বড় প্রকল্প বানাতে গিয়ে ঋণের চাপ বাড়ছে রাষ্ট্রের কাঁধে। আবার এসব প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় ধরা হয়। বালিশ বা পর্দাকান্ডের মতো কয়েকটি ঘটনায় সারাদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আবার ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, সম্রাট, খালেদ ভুঁইয়া থেকে শুরু করে এনু-রূপণ, পাপিয়াদের উত্থান নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়, যা অর্থনীতির দুষ্টচক্রের প্রমাণ বলেই মনে করেন অনেকে।’ উল্লেখ্য যে, ভয়াবহ দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের বেশিরভাগ টাকা পাচার হয়েছে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা করে এবং তা চলছে প্রায় ১০-১২ বছর যাবত বলে বিভিন্ন খবরে প্রকাশ। এছাড়া, গত ৩ মার্চ প্রকাশিত জিএফআই এর রিপোর্ট মতে, টাকা পাচারে বিশ্বের ১৩৫টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯% পাচার হচ্ছে। টিআই’র বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচক-২০১৯ মতে, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪তম (নিম্নক্রম থেকে), স্কোর ২৬, গত বছর ছিল ১৩তম ও স্কোর ২৬ (তবে এবার উচ্চক্রম থেকে ১৪৬তম, গত বছর ছিল ১৪৯তম)। এই দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তবুও সংশ্লিষ্টরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের বেশিরভাগই সরকার ঘরানোর লোক বলে মানুষের ধারণা। এই অবস্থায় দেশের যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটেনি। বরং তারা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জাঁতাকলে পড়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। কিছু মানুষ সঞ্চয় পত্রে টাকা রেখে তার মুনাফা দিয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করতো। এখন তারাও বিপদে পড়েছে মুনাফা অনেক হ্রাস ও ভ্যাট আরোপ করায়। ফলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ডাকঘর সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে। তাই সরকার ডাকঘর সঞ্চয়ের মুনাফা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয়ের মুনাফার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ফলে একযাত্রায় দু’রকমের ব্যবস্থা হয়েছে, যা চরম বৈষম্যপূর্ণ। অন্যদিকে, সঞ্চয় পত্রের উপর খড়গ নামার কারণে সঞ্চয় পত্রে আমানতের হার হ্রাস পেয়েছে ৭৫%। ফলে সরকারের উন্নয়ন কর্মের জন্য ঋণ করতে হচ্ছে ব্যাংক থেকে। এবং তার পরিমাণ বিপুল। চলতি অর্থবছরের টার্গেট ৭ মাসেই পূর্ণ হয়েছে। তাই বাকী ৫ মাসে এই ঋণ অনেক বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। রাজস্ব আয় হ্রাস পাওয়ার জন্যই সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে বলে জানা গেছে। ওদিকে, সরকার ৬১টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত টাকা, যার পরিমাণ ২.১২ লাখ কোটি টাকা, তা সীজ করেছে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জনবলের মধ্যে অবসরোত্তর পাওনা নিয়ে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি ঋণের পরিমাণও বিপুল।
অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। তাই চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৬% এর বেশি হবে না বলে অনেকের অভিমত। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফও প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া কথা বলেছে। কিন্তু সরকার এসব প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের অভিমত হচ্ছে: ‘দেশের অর্থনীতির কোনও সূচকই ভালো নেই। প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। আমদানি-রপ্তানি আয়ে কোনও প্রবৃদ্ধিই নেই, রাজস্ব আয়ে রয়েছে বড় ঘাটতি। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিপদ সংকেত লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কিছু সেক্টরে দেখা যাচ্ছে কালো মেঘ। অন্যদিকে ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতির ফলে সরকারকে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ তো বহু বছর ধরেই স্থবির। সরকারের ঋণ নেয়াতে শিল্প বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রভাব ফেলছে ব্যাংক খাতেও। এমনকি মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব পড়ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।’ দেশের আর এক সংকট আসছে ২০২৪ সালে। তখন বাংলাদেশসহ ১২টি দেশ এলডিসি থেকে মুক্ত হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ যদি তা হতে সক্ষম হয়, তাহলে দরিদ্র দেশের যেসব সুবিধা তথা জিএসপি, ঋণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সুবিধা পেত, তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সব ক্ষেত্রে প্রচন্ড প্রতিযোগিতায় পড়বে, যা মোকাবেলা করা অনেক কঠিন হতে পারে। কারণ, এসব সুবিধা থাকতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টিকে থাকা যাচ্ছে না, সে অবস্থায় সুবিধা উঠে গেলে টিকে থাকা অনেক কঠিন হবে। তাই তার প্রস্তুতি এখন থেকেই গ্রহণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ মহল অনেকদিন থেকে বলছেন। কিন্তু তার লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সম্প্রদায়কে উত্তরণ হতে যাওয়া দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন সিপিডির ফেলো ও জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি কমিটির সদস্য ড. দেশপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘে নিযুক্ত এলডিসির রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফিংয়ে তিনি এই তাগিদ দিয়েছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। কিন্তু তার এই অভিপ্রায় ফলদায়ক হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।
দেশের বর্ণিত সমস্যা ছাড়াও আরও অনেক মারাত্মক সমস্যা আছে, যার অন্যতম হচ্ছে: দক্ষতার ঘাটতি, মানুষের স্বাস্থ্য সংকট, আয় বৈষম্য, বাল্য বিবাহ, ভেজাল, আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গুর, পুষ্টিহীনতা, বৈদেশিক ঋণ, যানজট, পণ্যজট, জলজট, সব ধরনের দূষণ, দুর্ঘটনা, সর্বত্রই দলীয়করণ, রোহিঙ্গা ইত্যাদি। এই অবস্থায় সরকার রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন। যার সারমর্ম হচ্ছে: ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ওই সময়ে হতদরিদ্রের হার কমে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। আর জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হবে ৯.৯। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, প্রিটেস্টে পাশ করতে পারলেই টেস্টে অংশগ্রহণ এবং তাতে পাশ করতে পারলেই ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। নতুবা নয়। তাই ৪১ নিয়ে ভাবনার আগে বর্তমান তথা ২০ নিয়ে ভাবতে হবে। তথা চলতি সংকট মোকাবেলা করতে হবে। এর পর আছে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নবতর সংকট। এসব সংকট মোকাবেলায় সফল হলেই তারপর রূপকল্প ৩০ ও ৪১ নিয়ে ভাবনা। আর ব্যর্থ হলে সবই শেষ। তাই চলতি সংকট ও আসন্ন সংকট মোকাবেলা করে সফল হতেই হবে। নতুবা ভবিষ্যৎ নিয়ে সব স্বপ্নই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, যা দেশবাসীর কাম্য নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।