পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় নেতৃত্ব দানের কারণে যে নরেন্দ্র মোদী ‘গুজরাটের কশাই’ হিসাবে কুখ্যাতি লাভ করেছিলেন সেই নরেন্দ্র মোদী এখন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমাসীন রয়েছেন। তাও প্রথম বারের মতো নয়। ‘গুজরাটের কশাই’ নামে এককালের কুখ্যাত নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে সমাসীন রয়েছেন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদ শেষে তিনি যখন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হন, তখন তাঁর দল বিজেপির নেতা-কর্মীরা এই বলে হিন্দু-অধ্যুষিত ভারতের জনগণের কাছে তাঁর প্রতি সমর্থন কামনা করেছিলেন যে, ভারতের মুসলমানদের দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী করা উচিৎ।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল সাক্ষ্য দেবেন, হিন্দু-অধ্যুষিত ভারতের জনগণ বিজেপির নেতা-কর্মীদের এ প্রত্যাশা কীভাবে পূরণ করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে তিনি (নরেন্দ্র মোদী) ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দুর্বল করে দেন। শুধু তাই নয়, কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা কংগ্রেস সমর্থক শেখ আবদুল্লাহ এবং তাঁর পরিবারের মুসলিম নেতাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরের জনগণের উপর নির্যাতন চালানোর লক্ষ্যে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে এবং দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে কাশ্মীরও ভারতের কেন্দ্র-শাসিত রাজ্যে পরিণত করেছেন।
এসব ছাড়াও সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মুসলিম বিরোধী গণহত্যা চালিয়ে এককালের ‘গুজরাটের কশাই’ নামে পরিচিত নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের জনগণের বিরাগভাজন; বাংলাদেশের জনগণ আশা করেছিল গুজরাটের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার পর দিল্লির মুসলিম গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী নরেন্দ্র মোদীকে কোনো অছিলায়ই কোনো দিন বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। বাংলাদেশের জনগণের এই স্বাভাবিক প্রত্যাশার বিরোধিতা করেছেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি (ওবায়দুল কাদের) তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি (কুযুক্তি) দিতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অকৃত্রিম বন্ধু ও সর্বাত্মকভাবে সহায়তাদানকারী দেশ ভারত। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশে আসছেন। যারা তাঁর আসার বিরোধিতা করছেন তাদের উচিৎ নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত জানানো।
কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ওবায়দুল কাদেরের এ সম্পর্কিত বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তারা মনে করেন, নরেন্দ্র মোদীর মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা যিনি গুজরাটের মুসলমানদের রক্তে হাত রাঙ্গানোর পর এই সেদিনও দিল্লির মুসলমানদের রক্তে হাত রাঙ্গিয়ে ‘দিল্লির কশাই’ অভিধায় অভিহিত হওয়ার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করেছেন, তাকে মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের জনগণ কিছুতেই স্বাগত জানাতে পারে না। তারা আরো মনে করেন, বাংলাদেশের মতো মুসলিম-প্রধান দেশে যদি নরেন্দ্র মোদীর মতো এককালের ‘গুজরাটের কশাই’ নামে অভিহিত এবং ‘দিল্লির কশাই’ নামে অভিহিত হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জনকারী নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তার দ্বারা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানকেই অবমাননা করা হবে।
এখানে আমরা এ প্রসঙ্গে একটু ইতিহাসের আশ্রয় নিতে চাই। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘শেখ উপাধিধারী দুই বিখ্যাত নেতার কথা উল্লেখ করতে চাই। এদের দু’জনেরই জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জন। এদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরেকজন শেরে কাশ্মীর শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এদের একজন (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) সঠিক অবস্থান করে বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করে প্রথমে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য অর্জন করেন। অন্যজন (শেখ আবদুল্লাহ) ভুল পথ অবলম্বন করে তার জীবনের লক্ষ্য কাশ্মীরের স্বাধীনতা থাকা সত্তে¡ও কংগ্রেসের সমর্থক হওয়ায় তার জীবনের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতার বেদনা নিয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহর পারিবারিক বন্ধু পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালেই কাশ্মীরের স্বাধীনতা দাবি করার অপরাধে ভারতের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে জীবনের লক্ষ্য অপূরিত রেখে মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য হন।
আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের যে বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, তার প্রমাণ ভারত আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিয়েছিল, একথার মধ্যেও সম্পূর্ণ সত্য নেই। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রধানত ছিলেন হিন্দু। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো কোনো দিনই পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। কারণ, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ছিলেন অখন্ড ভারতের সমর্থক। তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কোনদিনই ভারত বিভাগ ও মুসলিম-প্রধান পাকিস্তান বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সমর্থক ছিলেন না।
এর পরও একথা স্বীকার করতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তারা আমাদের সাহায্য দিয়েছিল। তবে তার কারণ, তারা চেয়েছিল শক্তিশালী পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে দুটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) সৃষ্টি করা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরও বাংলাদেশে কিছু ভারতীয় সৈন্য রেখে যাওয়া।
এখানে আরেকটি বাস্তব ঘটনা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। সেটি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে যারাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসায় গেছেন, তাদেরকে অবিলম্বে ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও নিজে নিজ বাসভবনে থেকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দেন।
ফলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি পাকিস্তান থেকে প্রথম লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে, বাংলাদেশে এখনও কিছু ভারতীয় সৈন্য রয়ে গেছে। সাথে সাথে এ ব্যাপারে তিনি তাঁর ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লি বিমান বন্দরে স্বল্প বিরতিকালে প্রথম সুযোগেই তিনি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম আপনার বাহিনী বাংলাদেশ থেকে কখন ফিরিয়ে আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারণ সহজ হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি তখন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে পাকিস্তান চলে না যেতেন, ভারত তাকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র সত্ত্বার বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব বিরোধী চক্রান্তের সুযোগ পেতো। সে সুযোগ বঙ্গবন্ধু কিছুতেই ভারতকে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ একটা হিন্দু-প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে তিনি ভারতকে সে সুযোগ দিতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না।
এ সম্পর্কে আরেকটি ঘটনার উল্লেখও করা যায় প্রাসঙ্গিক কারণেই। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপর পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসির উদ্যোগে একটি বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন আহূত হয়। সে সম্মেলনে বাংলাদেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু ভারত ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের ব্যাপারে ঘোরতর বিরোধিতা করে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা ভাসানী সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, যদি তুমি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাকো, তাহলে তোমার মনে যা চায়, তাই করো। আর যদি তুমি ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রের নেতা হয়ে থাকো তাহলে ভারত যা চায়, তাই করো। এই জবাবের মধ্যে তিনি আসল জবাব পেয়ে গেলেন এবং লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। বঙ্গবন্ধু যেদিন লাহোর সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা হলেন, সেদিন নয়া দিল্লিতে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। অথচ তখনও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বাংলাদেশের সমর্থনে বক্তব্য দেয়া চলছিল।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হিসাবে শক্তিশালী হয়ে উঠুক তা কখনই চায়নি ভারত। অর্থাৎ ভারত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দান করেছিল এ লক্ষ্যে যে, একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে যাতে দুটি দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অভ্যুদয় হয়। এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধু কখনও বাংলাদেশকে হিন্দু প্রধান ভারতের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাননি। চেয়েছেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম শক্তিশালী মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে। এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বুঝে নিন, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কতটা ছিল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।