পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রতি বছর কী পরিমাণ জাহাজ ভাঙ্গা হয় তা নিয়ে বেলজিয়াম ভিত্তিক সংস্থা ‘দা এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম’ গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তালিকায় দ্বিতীয় বারের মতো শীর্ষস্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক জাহাজ ভাঙ্গা হয়েছে বাংলাদেশে। এ বছরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশে ২৩৬টি জাহাজ ভাঙ্গার জন্য আমদানি করে, যা ২০১৮ এর তুলনায় ২০.৪১ শতাংশ বেশি।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প খুব দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। মূলত যেসব পণ্যবাহী বা যাত্রীবাহী জাহাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, সেসব জাহাজের মালিকেরা ঐ জাহাজগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিক্রি করে। শ্রমিকের অধিকার আদায় ও পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত একটি অলাভজনক সংস্থা ওয়াই পি এস (ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন) এর মতে, প্রতিবছর ৭০০টি জাহাজ কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই পুরোনো জাহাজ ক্রেতাদের ভিড়ে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস অ্যান্ড রিসিক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বি এস বি আর এ) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ২২১টি জাহাজ, ২০১৬ সালে ২৫০টি জাহাজ, ২০১৭ সালে ২১৪টি জাহাজ, ২০১৮ সালে ১৯৬টি জাহাজ এবং ২০১৯ সালে ২৩৬টি জাহাজ পুনর্ব্যবহারের জন্য ভাঙ্গা হয়।
দেশে এই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের ভিত্তি গড়ে উঠে ১৯৬০ সালের এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের মধ্যে দিয়ে। প্রবল ওই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে গ্রিক জাহাজ এম ডি আলপাইন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের তীরে বিকল হয়ে পড়ে। সেই জাহাজটিই প্রথম সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে, যার ফলে সীতাকন্ডে একটি ব্যাবসায়িক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে মানুষ পাড়ি জমায় কর্মসংস্থানের খোঁজে।
বাংলাদেশের এই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পটি প্রায় ৪২.২ শতাংশ সমুদ্রগামী জাহাজ ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক রিসাইক্লিং মার্কেটের একটা বড় অংশই দখল করে নিয়েছে, যেখানে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারের ২৫.৬ শতাংশ ভারত, ২১.৫ শতাংশ পাকিস্তান, টার্কিরা ২.৩ শতাংশ আর চীনারা ভাঙ্গে ২ শতাংশ জাহাজ।
চট্টগ্রামের উত্তর উপকূল ধরে প্রায় ১২০টি জাহাজ ভাঙ্গার কারখানা রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। যার ফলে তৈরি হয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থান এবং প্রায় ৫০,০০০ মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সাথে জড়িত। অন্যদিকে এ শিল্পের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১,০০,০০০ মানুষ। এই বিশাল শ্রমজীবী মানুষগুলোর অধিকাংশই এসেছে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল থেকে।
জাহাজের আকার এবং মানের উপর ভিত্তি করে একজন জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের মালিক সাধারণত একটি জাহাজ ৫-১০ মিলিয়ন ডলারে কিনে থাকেন। আর একটি জাহাজ ভাঙ্গার জন্য প্রায় ৩০০-৫০০ লোক নিযুক্ত করা হয়। এর পাশাপাশি অনেক কর্মী নিযুক্ত থাকে, যারা জাহাজের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো পুনর্ব্যবহার এর উপযোগী করে তোলে। এর মধ্যে থেকে কিছু পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য রপ্তানি করা হয় এবং বাকিগুলো বিক্রি করা হয় স্থানীয় বাজারে, যেগুলো পুনরায় ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশের জাহাজগুলোতে। ব্যবহারযোগ্য জাহাজের এই অংশগুলোর স্থানীয় অর্থনীতিতে রয়েছে বিপুল চাহিদা।
এই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, স্টিলের এক উল্লেখযোগ্য উৎস এবং এটি ইস্পাত আমদানির প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস করে। আমদানি হ্রাস পাওয়ার ফলে ইস্পাত শিল্পে প্রচুর পরিমাণে অর্থও সাশ্রয় হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্টিলের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫০,০০০ টন, যেখানে আমাদের দেশে নিজস্ব কোনো ধাতব উৎস বা খনি নেই। স্থানীয় ইস্পাত শিল্পের জন্য আমাদের দেশের কাঁচামালের ৬০ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করে এই জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, যা সরকারের জন্য বিশাল পরিমাণ রাজস্বেরও উৎস। প্রতি বছর সরকার নানাবিধ শুল্ক আদায়ের মাধ্যমে এই শিল্প থেকে শত শত কোটি টাকা আয় করছে। তেমনিভাবে যাদের কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই এমন দারিদ্র্যপীড়িত ও অদক্ষ লোকের জন্য এই শিল্প তৈরি করেছে কর্মসংস্থান।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পকে একটি সবুজ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, জাহাজ এবং জাহাজের ভেতরের সকল উপকরণই পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পুনরায় বিক্রয় করা যায়। এই শিল্প যেমনভাবে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের যোগান দিচ্ছে, তেমনিভাবে এই শিল্প থেকে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি।
তবে এই অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো সামাজিক এবং পরিবেশগত ব্যয়ের সাথে একত্রে বিবেচনা করা উচিত। দেখা গেছে, ৮৬.৪৪ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ এই কারখানাগুলো থেকে কোনো চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে না। বাংলাদেশের কিছু স্থানীয় সংস্থা অনুমান করেছে যে, এই শিল্পে কাজ করার ফলে গত ৩০ বছরে ১০০০-২০০০ শ্রমিক মারা গিয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা পুরো দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যার গড়ের উপরে। এছাড়াও এই শিল্পে কাজ করার ফলে অনেক শ্রমিক তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। শ্রমিক সংশ্লিষ্ট এই বিষয়গুলোর প্রতি সরকার ও মালিকদের দৃষ্টি দিতে হবে।
সা¤প্রতিক সময়ে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প খাতটি জিডিপির ক্ষেত্রে এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইকোনমিক টাইমস-এর মতে, সা¤প্রতিক সময়ে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও শিপিং ইয়ার্ড এর ক্রমবর্ধমানতার কারণে এটি অনুমান করা যায় যে, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প আগামী বছরগুলোতে আরও বড় পরিসরে বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে নতুন জাতীয় নীতি এবং আইন চালু করেছে যে, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের পরিবেশগত ও পেশাগত স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা মান উন্নয়ন করতে হবে। যদিও এর বাস্তবায়নে এখনো কোনো আশানুরূপ অগ্রগতি লক্ষ করার মতো নয়।
যাইহোক, তারপরও আমরা আশাবাদী যে, বাংলাদেশ সরকার এই শিল্পের প্রসারে আরও গভীর মনোনিবেশ করবেন। কারণ, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পগুলো আসন্ন বছরগুলোতে আরও বেশি এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখকদ্বয়: শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।