পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘আল কোফরু মিল্লাতুন ওয়াহেদা’। অর্থাৎ কোফরের সকল শাখার মূল একই সূত্রে গ্রথিত। হাদীসের এ চিরন্তন বাণীর সত্যতা যুগে যুগে অকাট্য রূপে পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। তাগুতী শক্তি অর্থাৎ শয়তান কোফর জন্ম দিয়ে থাকে, যার বর্ণনা কোরআনের নানা স্থানে রয়েছে। খোদ আল্লাহতাআলাই শয়তানকে তাঁর এবং মানবের শত্রু রূপে আখ্যায়িত করেছেন এবং শয়তান হতে সতর্ক থেকে আল্লাহরই আশ্রয় প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
শয়তান কীভাবে মানুষকে প্ররোচিত ও প্রতারিত করে দুনিয়াতে অশান্তি, বিশৃঙ্খলাসহ অসংখ্য রকমের ফেতনা-ফাসাদের জন্ম দেয়, তার বিশদ বিবরণ কোরআনে রয়েছে। শয়তান কোফরি কর্মকান্ডের প্রতি মানুষকে ধাবিত করার জন্য যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করে তার একটি হচ্ছে, মানুষের মনে নানা রকমের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করা, যাকে বলা হয় ‘ওয়াসওয়াসা’।
আরবিতে ‘ফামুন’ অর্থ মুখ। এর ব্যতিক্রম বহুবচন ‘আফওয়াহ’ অর্থাৎ বহুমুখ। এ শব্দ দ্বারা গুজবকে বোঝানো হয়ে থাকে। সত্য-মিথ্যা যাচাই-অনুসন্ধান না করে তা প্রচার করে দেয়াই গুজব। এটি একটি ক্ষতিকর এমন সর্বনাশা অভ্যাস, যার ফলে বহু অঘটন ঘটে যেতে পারে। সমাজের নানা স্তরে এভাবে অসংখ্য ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর উদগাতা গুরু ঠাকুর হচ্ছে ইবলিশ শয়তান। অতি সুকৌশলে শয়তান মানুষকে ক্ষতিকর অপকর্মে লিপ্ত করে এবং শয়তানি কর্মকান্ডগুলোকে সুন্দর, আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর ও সুসজ্জিত করে সেদিকে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। সুতরাং, অনেকেই শয়তানের ধোঁকা-প্রতারণার শিকার হয়ে অপচয়ের মত গর্হিত কাজের প্রতি ধাবিত হয়ে পড়ে। অনেক সময় শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা অনুধাবন করতে না পেরে সহজেই পাপাচারে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
মানুষের মধ্যে ‘ওয়াসওয়াসা’ বা কুমন্ত্রণা দেওয়ার জন্য সব সময় শয়তান লেগে আছে। এই শয়তান দুই প্রকারের হয়ে থাকে। এক শ্রেণির শয়তান আছে যারা ‘জি¦ন’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং অপর শ্রেণির শয়তান মানুষেরই এক সম্প্রদায় বিশেষ, যারা শয়তানের চরিত্র, কুপ্রবৃত্তি নিয়ে অজ্ঞ লোকদেরকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই উভয় শ্রেণিকে পবিত্র কোরআন ‘শায়াতীনুল ইনছে ওয়াল জিন্নে’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
শয়তান যে কোনো আকার বা রূপ ধারণ করতে পারে। কোরআনের ভাষায় ‘হিজবুশ শয়তান’ বা শয়তানের দলকে মানবের চর্মচক্ষু স্বাভাবিকভাবে অবলোকন করতে না পারলেও তাদের আচরণ ও কার্যকালাপ সম্পর্কে কোরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনা হতে পরিচয় পেয়ে থাকে। প্রকৃত মুসলমান মাত্রই শয়তানী কার্যকালাপ অনুধাবন করতে পারে। মানব শয়তান যেহেতু কোনো অদৃশ্য শক্তি নয়, তাই তাদের পরিচয় শয়তানী কার্যকালাপের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। মোনাফেকী আচরণ হলো তাদের অন্যতম পরিচয় ও লক্ষণ। এরূপ লোকেরা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করে থাকে, সরল জনসাধারণের মধ্যে বহু মিথ্যা বা কল্প কাহিনী প্রচারের মাধ্যমে শয়তানী ভ‚মিকা পালন করে থাকে। কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে নানা গুজব রটনা বা অলীক কথাবার্তা প্রচার করে দেশে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস পায় এবং তাতেই তারা তৃপ্তি লাভ করে। এ ধরনের লোক সমাজের পক্ষে দারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিভ্রান্তিকর খবর পরিবেশন ও গুজব রটনার পরিণাম অনেক সময় মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, এ কথা যে কোনো চিন্তাশীল ও শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি অনুমান করতে পারেন।
ইসলাম ধর্ম মুসলমানদেরকে একতা, সংহতি ও ঐক্যের শিক্ষা দেয়। তাই ইসলাম গুজব রটনা ও মিথ্যা প্রচারণার প্রশ্রয় কখনই দিতে পারে না। এ সম্পর্কে আল্লাহতাআলা কোরআন শরীফে এরশাদ করেছেন, ‘এবং তাদের নিকট যখন শাস্তি বা ভয়ের কোনো সংবাদ আসে তখন তারা তার প্রচার শুরু করে দেয় এবং তাকে হজরত রাসূলে করীম (সা.) ও তার জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রচারিত খবর বলে তাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। অতঃপর তারা এ সংবাদের সত্যাসত্য অবগত হন। কেননা তারা এধরনের উক্তির পরিণাম অনুধাবন করতে পারেন এবং যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ, করুণা বর্ষিত না হতো তা হলে অবশ্যই কিছু সংখ্যক ব্যতীত তোমরা সকলেই শয়তানের অনুকরণ শুরু করতে।’
আল্লাহতাআলা আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই সে সকল মোমেন সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেরা নামাজে অনুনয়, বিনয় ও আল্লাহকে ভয় করে এবং যারা ফজুল ও বেহুদা কথাবার্তা হতে বিরত থাকে।’ কোন বিষয়ে সঠিকভাবে কিছু জানা না থাকলে আন্দাজে তা না বলার জন্য আল্লাহতাআলা নির্দেশ দান করেছেন। সূরা বনি ইসরাইল এ আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস নেই, আন্দাজে তা বলে বেড়াবে না। কেননা চোখ, কান ও অন্তর এ সমস্তরই জওয়াবদিহি করতে হবে।’ এ সকল আয়াত হতে ভিত্তিহীন প্রচারণা ও গুজব রটানোর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তার কথা সহজেই অনুমান করা যায়। নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া এরূপ কোনো খবর কেউ প্রচার করলে তার সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘হে মুসলমানগণ যদি কোনো ফাসেক, মন্দ লোক কোনো খবর আনে, তা হলে তা পরীক্ষা করে দেখবে, যেন অজ্ঞতাবশত কোনো জাতির উপর আক্রমণ করা না হয়। এরূপ করলে তোমাদেরকে নিজেদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অনুতাপ করতে হবে।’ অর্থাৎ, ফাসেক বা মন্দ লোকের খবর বিশ্বাসযোগ্য নয়, যতক্ষণ না তা বিশ^স্ত সূত্রে প্রমাণিত হবে। কোরআনের এই সুনীতির অনুসরণ করা হলে গুজব রটনা বা মিথ্যা প্রচারণায় কোনো মুসলমান বিভ্রান্ত হতে পারে না।
মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান ও বিশ্বাস না করার যেখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মিথ্যা প্রচারের কুফল বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে ন্যায় ও সত্য অনুসরণ এবং তাতে কোনো প্রকারের সংশয় না করারও আদেশ রয়েছে। সন্দেহ এবং সংশয়ের বিষয়গুলো হতে বিরত থাকার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য এবং ভুল ও নির্ভুল বিষয় যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি নির্ধারণ করতে পারে। মিথ্যা বলাকে বিশ্বাস করা এবং তা প্রচার করা যে রূপ পাপ, সত্য ও ন্যায় সম্পর্কে সংশয় বোধ করাও তেমনি অপরাধ। সূরা হুজরাতে আল্লাহতাআলা বলেন, ‘হে মুসলমানগণ! অধিক সংশয় বোধ হতে বিরত থাক। কেননা, কোনো কোনো সংশয় পাপ কার্যের অন্তর্ভুক্ত।’ এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, যারা মুসলমানদেরকে সংশয়গ্রস্ত করে তোলে, তারা কত বড় পাপী। হাদীস শরীফে সংশয় সৃষ্টিকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘সত্য সম্পর্কে তোমরা সংশয় সৃষ্টি হতে বেঁচে থাক। কেননা সংশয় মিথ্যা কথা স্বরূপ।’ একই বর্ণনায় সুফিয়ান বলেন, ‘সংশয় দুই প্রকারের হয়ে থাকে। এক প্রকারের সংশয়ে পাপ হয়, আর এক প্রকারের সংশয়ে পাপ হয় না। যাতে পাপ হয় তা হচ্ছে এই যে, সংশয় মনে করা সত্তে্বও তা বলা বা প্রচার করা এবং যে প্রকারের সংশয়ে কেন পাপ হয় না তা হচ্ছে এই যে, সংশয় সৃষ্টি হলে তা না বলা কিম্বা প্রচার না করা।’ (তিরমিজী) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, ‘রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শয়তান মানুষের আকার ধারণ করে লোকের কাছে আসে এবং তাদের মধ্যে মিথ্যা কথা প্রচার করে। ফলে তারা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্য হতে কোনো লোক বলে উঠে যে, আমি অমুক ব্যক্তির কাছে এরূপ বলতে শুনেছি, তার চেহারা দেখলে চিনি, কিন্তু তার নাম বলতে পারি না।’ (মুসলিম)
মিথ্যা প্রচার ও গুজব রচনা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা.) এর এই স্পষ্ট উক্তিটি বিচার বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, গুজব রটনাকারীরা এ শয়তানী নীতিরই অনুসরণ করে থাকে। ইসলাম মানুষকে সত্য কথা বলার, প্রচার করার এবং তা বিশ্বাস করার শিক্ষা দেয়। আর মিথ্যা কথা বলার, তা প্রচার ও বিশ্বাস করার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। এটা ‘হিজবুস শায়তান’ বা শয়তানের দলের কাজ। এসবের পরিণতি সম্পর্কে সুচতুর শয়তান এক সময় তার দোষ স্খলনের জন্য বলতে বাধ্য হয়, কোরআন এর ভাষায়, ‘যখন সব কাজের ফয়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের ওপর তো আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এতটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি, অতঃপর তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছ। অতএব, তোমরা আমাকে ভৎর্সনা কর না। আমি তোমাদের সাহায্যকারী নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্যকারী নও। ইতিপূর্বে তোমরা আমাকে যে আল্লাহর শরীক করেছিলে আমি তা অস্বীকার করি।’ (সূরা: ইবরাহীম, আয়াত: ২২)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।