Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়নে জবাবদিহি ও পুনঃমূল্যায়ন প্রসঙ্গে

এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

পরীক্ষার্থীর খাতা অবমূল্যায়নে প্রতিবছর কত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত স¦প্ন ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছে, তার হিসাব নাই। এমনকি অনেক জীবন পর্যন্তও বিপন্ন হচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পরীক্ষার খাতা এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত বোর্ড পরীক্ষার খাতাও (এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি) অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। গত ২০১৯ সালে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় সারাদেশে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লক্ষ ৫১ হাজার ৫শত ৫ জন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল ১ লক্ষ ২৯ হাজার ১শত ২৯ জন। এর মধ্যে খাতা কল হয় ২৩ হাজার ১শত ২৩ জনের। ঢাকা বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার ৮শত ৩৫ জন, এর মধ্যে খাতা কল হয় ৫২ হাজার ৯ শত জনের। এতে রেজাল্ট পরিবর্তন হয় ১৫শ ৮৬ জনের। অনেক শিক্ষার্থী রাতদিন পড়াশুনা করে ভালো পরীক্ষা দেওয়ার পরেও খাতা অবমূল্যায়নের ভয়ে দিন কাটায়, তাদের খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন হবে কিনা? শিক্ষার্থীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ জে.এস.সি, এস.এস.সি, এইচ.এস.সি বোর্ড পরীক্ষার খাতা বিভিন্ন কারণে অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। যেমন: অদক্ষ পরীক্ষকদ্বারা খাতা মূল্যায়ন করা, সঠিক নিরীক্ষণ না করা, পরীক্ষকের নিজ হাতে খাতা মূল্যায়ন না করা, স্বল্প সময়ে অধিক খাতা মূল্যায়ন করা, পরীক্ষার উত্তরপত্র ভালভাবে না পড়ে অনুমানের উপর নম্বর দেওয়া, পরীক্ষকের খাতা মূল্যায়নের সময় পারিবারিক বা অন্য কাজে মনোযোগ দেওয়া, খাতা মূল্যায়নের সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি না করা, পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকা, দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে ভালো শিক্ষার্থীর খাতা মিশে যাওয়া, পরীক্ষার মূল খাতার সাথে লুজসিট সুতা দিয়ে সেলাই না করে পিন মারা, খাতা অবমূল্যায়নে শাস্তির বিধান না থাকা, শিক্ষার্থীর খাতা পুনঃমূল্যায়নে (কল) সহজ পন্থা না থাকা, পরীক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন না করা। একজন শিক্ষার্থী নার্সারী-প্লে ক্লাস থেকে শুরু করে ১২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা করে এস.এস.সি পরীক্ষা দেয়, তার ১২ বছরের প্রতি মিনিটের সুফল নির্ভর করে পরীক্ষার ফলাফলের উপর। কিন্তু কোন কারণে পরীক্ষকের অবহেলা, গাফিলতি বা সঠিক নিয়ম না মানার কারণে পরীক্ষার খাতা অবমূল্যায়ন হলে ঐ শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয় সেটা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই তাচ্ছিল্য বা যেনতেনভাবে খাতা মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। খাতা মূল্যায়নের জন্য কোনোভাবেই অদক্ষ পরীক্ষককে খাতা মূল্যায়ন করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। কমপক্ষে ১০ বছর ঐ বিষয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষক নিজ হাতে খাতা মূল্যায়ন না করে বাসার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, এমনকি প্রাইভেট পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা খাতা মূল্যায়ন করে থাকেন। এতে করে শিক্ষার্থীর খাতা একেবারেই মূল্যায়ন হয় না। শুধু অনুমান বা পাতাগুনে নম্বর দেওয়া হয়। এই রকম প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। একজন পরীক্ষককে ৩শত খাতা দেখার জন্য মাত্র ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়, যা একেবারেই কাম্য নয়। একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য কমপক্ষে ৩০ মিনিট হিসাবে ৩ শত খাতা দেখানোর জন্য কমপক্ষে ১৫০ ঘণ্টা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে তাড়াহুড়া বা অনভিজ্ঞদের দিয়ে খাতা মূল্যায়নের জন্য সঠিক মূল্যায়ন হয় না। কোনোভাবেই একসঙ্গে একজন পরীক্ষককে ৩শত খাতা দেওয়া যাবে না। আর যদি দিতেই হয় তাহলে অবশ্যই সময় বেশি দিতে হবে। অনেক পরীক্ষক উত্তরপত্র সঠিকভাবে না পড়ে অনুমানের উপর কলম দিয়ে দাগ দিয়ে পাতা উল্টিয়ে যান এবং মনগড়া নম্বর দেন। এতে করে একজন ভালো শিক্ষার্থীর অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। অবশ্যই প্রত্যেকটি লাইন পড়ে খাতা মূল্যায়ন করতে হবে। অনেক পরীক্ষক বাড়িতে পারিবারিক নানাবিধ সমস্যা, কথাবার্তা কাজকর্মের মধ্যে খাতা মূল্যায়ন করে থাকেন। এক্ষেত্রেও খাতা অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। খাতা মূল্যায়নের সময় অবশ্যই নিরিবিলি পরিবেশ বেছে নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, ইউনিয়ন পরিষদে, উপজেলা পরিষদ হলরুমে অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল কর্মকর্তার উপস্থিতিতে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এতে করে কোনো খাতায় সমস্যা দেখা দিলে আলোচনান্তে সমাধান করা সহজ হবে।

খাতা মূল্যায়নের জন্য বোর্ড থেকে বণ্টনের পর পরীক্ষকদের সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় পরীক্ষক দায়বদ্ধতা হারান। অবশ্যই তদারকি ও যোগাযোগের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ- মাঝে মধ্যে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীর পরীক্ষার সিট প্ল্যানে অধিক দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে অনেক ভালো পরীক্ষার্থীর খাতা মিশে খাতা অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। পরীক্ষক পরপর কম নাম্বার পাওয়া খাতা মূল্যায়ন করতে, করতে মন-মানসিকতা ঐভাবে তৈরি হয়ে যায়। এ কারণে কম নাম্বার পাওয়া খাতার সাথে মিশে অনেক ভালো শিক্ষার্থীর খাতাও সঠিকভাবে না পড়ার কারণে অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। এজন্য প্রতিটি খাতায় প্রত্যেকটি লাইন পড়ে মূল্যায়ন করতে হবে। কোনোভাবেই মনে করা যাবে না, বান্ডিলের সব খাতাই দুর্বল শিক্ষার্থীর। পরীক্ষার মূল খাতার সাথে অতিরিক্ত লুজশিট সুতা দিয়ে সেলাই না করে অনেক ক্ষেত্রে পিন মারা হয়। এতে করে পিনের মাথা অল্প আটকানোর কারণে অনেক খাতার চাপে লুজশিট খুলে যাবার আশঙ্কা থাকে। কোনোভাবেই সেলাই ছাড়া পিন মারা যাবে না।

শিক্ষার্থীর খাতা পুনঃমূল্যায়নের জন্য সহজ শর্তে পুনঃমূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু নাম্বার যোগ দিয়ে নয়, প্রথম মূল্যায়িত নম্বর লিখে রেখে খাতায় দেওয়া প্রত্যেকটি নাম্বার ফ্লুইড দিয়ে মুছে পুনরায় ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দায়িত্বে মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে হবে। অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর পুনঃমূল্যায়নেও অভিযোগ থাকলে প্রয়োজনে দ্বিগুন ফি জমা নিয়ে তার উপস্থিতিতে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে পরীক্ষককে একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য মাত্র ২৫ টাকা দেওয়া হয়। এটা একেবারেই অপ্রতুল। অবশ্যই প্রতিটি খাতাকে মূল্যায়নের জন্য পারিশ্রমিক যুক্তিসংগতভাবে বাড়াতে হবে এবং অভিজ্ঞ পরীক্ষকদের অধিক মূল্যায়ন করতে হবে।

শিক্ষাই যেখানে জাতির মেরুদন্ড সেখানে অপরিকল্পিত অনিয়মে খাতা মূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নাই। বর্তমানে অপরিকল্পিত কারিকুলামে এবারের এস.এস.সি. পরীক্ষায় ১২টি ১১শত ৫০ মার্কের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সৃজনশীল ৭ সেট ও নৈর্ব্যক্তিক ৩০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে শিক্ষার্থীকে গোটা বইয়ের প্রতিটি শব্দই মুখস্ত রাখা দরকার। এমনও দেখা গেছে, একজন শিক্ষার্থীর রাতদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৭/১৮ ঘণ্টা পড়েও সিলেবাস শেষ করতে পারছে না। এতবড় সিলেবাসে কোনো শিক্ষার্থী যদি ভালো ফলাফল করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে তার জীবন থেকে আনন্দ, বিশ্রাম, খেলাধুলা এমনকি পারিবারিক অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে সে আগ্রহ হারাবে। এমনকি শরীর সুস্থ রাখার জন্য প্রতিদিন যে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজনে তাও তার জীবন থেকে বিদায় নেবে। এই কারিকুলামে প্রতিটি সন্তানের সচেতন মা তার বাচ্চার মানসিক, স্বাস্থ্য নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভাবনার বিষয়। এরপরেও পরীক্ষকের অবহেলায়, অনিয়মে উত্তরপত্র যদি অবমূল্যায়ন হয় তাহলে ঐ শিক্ষার্থীর ও অভিবাবকদের সান্ত¦না পাওয়ার আর কিছুই থাকে না। তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে তাচ্ছিল্যভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক: সাংবাদিকও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • RedwanAhmed RedwanAhmed ৩ জুন, ২০২০, ৫:৫৯ পিএম says : 0
    Redwan
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Nasir Uddin ৪ জুন, ২০২০, ৪:৩৩ পিএম says : 0
    চলতি বছর থেকে এস.এস.সি.খাতা মূল্যায়নের সময় বাড়ানো হয়েছ।
    Total Reply(0) Reply
  • MD:ALAMGIR HOSSAIN ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:৪৪ পিএম says : 0
    আমি ইংরেজি পরীক্ষা ভালো দিয়েছি
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন