Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি সমর্থনযোগ্য নয়

| প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০৫ এএম

ফের বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ দুটি পণ্যের দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন আরও টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে যাবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়বে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া অবস্থায় রয়েছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি করা হলো। এ যেন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে বিইআরসির গণশুনানি হয়। তখন থেকেই সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে বিদ্যুতের দাম আবারও বৃদ্ধি করা হবে এবং নতুন করে তাদের আরও চাপে পড়তে হবে। বিইআরসি যখন একবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কথা বলে এবং লোক দেখানো গণশুনানি করে, তখন তারা যে দাম বৃদ্ধি করবেই এবং গণশুনানিতে বিরোধিতাকারিদের মতামত পাত্তা দেবে না, তা সকলেই জানে। বিইআরসি তার ঘোষণা মতোই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে এবং ১ মার্চ থেকেই তা কার্যকর হবে। বিদ্যুতের দাম আবাসিক থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি ৩৬ পয়সা বাড়তি দিতে হবে। ইউনিট প্রতি বাড়ানো হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। প্রতি ইউনিটের দাম ৬.৭৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭.১৩ টাকা করা হয়েছে। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৮.৪ শতাংশ। ইউনিট প্রতি দাম হয়েছে ৫.১৭ টাকা। এবারের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ গত ১১ বছরে দাম বৃদ্ধি করা হলো ১০ বার। বলা যায়, প্রতি বছরই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে পানির দামও ওয়াসা বাড়িয়েছে। প্রতি হাজার লিটারে পানির দাম বেড়েছে আবাসিকে ২.৮৯ টাকা এবং বাণিজিকে ২.৭৪ টাকা। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিইআরসি চেয়ারম্যান যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। তারা শুধু জানে, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বর্ধিত মূল্য তাদের দিতে হবে এবং তাদের জীবনযাপনকে কঠিনতর করে তুলবে।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলেছেন, নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে যখন নেতিবাচক প্রভাব বিরাজমান, তখন এই দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিকে আরও কঠিন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। শিল্পের উৎপাদন খরচ থেকে শুরু করে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। সাধারণ মানুষ অত্যন্ত বেকায়দার মধ্যে পড়বে। তারা বলছেন, বিদ্যুৎ ও পানি-এ দুটি খাত অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ না করে দাম বৃদ্ধি করা কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়নি। বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধিতে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ তারা সরকারেরই অংশ। যত সমস্যা হবে সাধারণ মানুষের। সরকার সাধারণ মানুষের এই সমস্যার কথা বিবেচনা করেছে বলে মনে হয় না। অথচ সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়াসাই সরকার চলে। সরকারের আয়ের উৎস তারাই। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব সরকারেরই। দুঃখের বিষয়, সরকার তা দেখছে না। যেখানে জনবান্ধব হয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখা এবং স্বস্তিতে রাখা সরকারের উচিত, সেখানে তাদের সঙ্গে একধরনের ব্যবসা করে চলেছে। সরকার যদি জনগণের কাছে ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে, তবে তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। সরকারও জনগণের কাছে সেবক হিসেবে গণ্য হয় না। দিল্লীতে কেজরিওয়ালা যে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন, তার মূল কারণ তার সরকার জনবান্ধব হয়ে কাজ করেছে। নির্বাচনের আগে তার সরকার দিল্লীবাসীর জন্য দুইশ’ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল ফ্রি করে দিয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করেই এ কাজ করা হয়েছিল। ফলে জনগণও সন্তুষ্ট হয়ে আবারও তাকে নির্বাচিত করেছে। জনগণের সরকার এমন হওয়াই উচিত। আমাদের দেশে এ ধরনের সরকার জনগণ দেখে নাই বললেই চলে। বরং জনগণ দেখছে, যতভাবে পারা যায় সরকার তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরিবর্তে অসুবিধার সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে বলেছেন, বিদ্যুৎ ও পানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা তা যদি বন্ধ করা যেত, তবে দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ থাকত না। ভর্তুকির যে কথা বলা হচ্ছে, তা দূর হয়ে যেত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাদ্বয়ের দুর্নীতির খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে। তাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ভর্তুকি দিতেই বারবার দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তারা এটা বুঝতে চাইছে না, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধির সাথে সব ধরনের পণ্যের দামও জড়িয়ে আছে। যদি এমন হতো এ দুটি পণ্যের দামবৃদ্ধির সঙ্গে অন্য কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না, তাহলে হয়তো জনসাধারণ তা সহ্য করত। এখন এই দাম বৃদ্ধির ফলে সার্বিক অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষ যে দুর্দশার মধ্যে পড়বে, এ দায় কি বিদ্যুৎ ও পানি কর্তৃপক্ষ নেবে? এর মাধ্যমে সরকার লাভ করবে, তবে জনসাধারণের মধ্যে তার প্রতি যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে, তা সরকার পোষাবে কি করে?

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানে সর্বত্র এর ‘চেইন রিঅ্যাকশন’ হওয়া। কলকারখানা, কৃষিসহ উৎপাদনমুখী সব শিল্পে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। এর কুফল ভোগ করবে সাধারণ মানুষ। সরকার তা বিবেচনা করেছে বা করছে বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, জনগণের কল্যাণের সাথে যেসব সেবা সরাসরি সম্পৃক্ত সেগুলোর দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের গভীর চিন্তা ও বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সরকার যদি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা আমলে না নেয়, তবে তাদের উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধি এটাই শেষ নয়, এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ভর্তুকি ও বিভিন্ন অজুহাতের কথা তুলে ধরে এ দাম বৃদ্ধি চলতেই থাকবে। বিদ্যুৎ ও পানি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো দূর করার উদ্যোগ না নিয়ে দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। পাশাপাশি পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়া এবং তাদের সচেতন করে তোলাও জরুরি। পানি ও বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা গেলে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে জবাবদিহিতা ও সততাবোধ জাগলে দামবৃদ্ধির প্রয়োজন হওয়ার নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি
আরও পড়ুন