পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া বাল্যবিবাহমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন জনসাধারণ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করেছে। তথাপিও বাল্যবিবাহের পরিমাণ আশাতীত হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান রাখে। কিন্তু এ জ্ঞানের বহিপ্রকাশ ঘটায় বা জ্ঞানটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে এমন পরিবারের সংখ্যা এখনো আশাপ্রদ নয়। সরকারিভাবে প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহ বন্ধে অভিভাবকদের আহবান, শাস্তির ব্যবস্থাসহ সচেতনতার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বেসরকারিভাবেও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবুও কোনভাবেই পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ।
আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে একটা সময় ধুমধাম করে, রঙ মাখামাখি করে বিয়ের উৎসব হতো। বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই মজার সব আয়োজন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এমন আয়োজন খুব একটা চোখে পড়ে না। এখন দেশে প্রতিদিন গড়ে যতগুলো বিয়ে হয় তার অর্ধেকের বেশি হয় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কোথাও কোথাও এমন গোপনে বিয়ে হয় যে, পাড়া পড়শিও জানতে পারে না। এমনও দেখা যায়, এক বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে অথচ পাশের বাড়ির লোকজন বিষয়টি জানেই না। কেন এমন গোপনীয়ভাবে বিয়ে হচ্ছে? কেনই বা এতো রাখঢাক? কারণ কী? আসলে কারণ একটাই, এক সময় আমাদের দেশে বিয়ের কোন বয়স ছিল না। তথ্যানুসন্ধ্যানে এমন ঘটনাও পাওয়া যায়, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে গ্রামাঞ্চলে ৬/৭ বছরের কোন মেয়ে শিশুর সাথে ৮/১০ বছরের ছেলে শিশুর বিয়ে পর্যন্ত হয়েছে। দুই পক্ষের অভিভাবকদের ইচ্ছেতে বিয়ে হলেও বিয়ের বর ও কনে জানতোই না বিয়ে কী জিনিস। বর্তমান সময়ে ৬/৭ বছর বয়সী মেয়ে শিশুর বিয়ের খবর কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও অনেক গ্রামে এখনো ১১/১২ বছরের মেয়ে শিশুর সাথে ১৫/১৬ বছরের ছেলে শিশুর বিয়ের খবর শোনা যায়। কোথাও কোথাও দরিদ্র পরিবারের ১১/১২ বছরের মেয়ে শিশুকে এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের বয়োবৃদ্ধের কাছে বিয়ে দেবার নজিরও চোখে পড়ে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। আর এসব বিয়েতে সহায়তা করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি ও স্থানীয় কাজী। জনপ্রতিনিধিরা মেয়ে বা ছেলের বয়স বাড়িয়ে বা নাম বদলে জন্মনিবন্ধন করার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্য।
গ্রামের সমাজপতিরা অনেক ক্ষেত্রে এসব বিয়ের খবর জানেন। গোপনে এসব বিয়ে আয়োজনের খবর জেনেও তারা চুপচাপ থাকেন। কখনো কখনো বাল্য বিয়ে সম্পর্কে সমাজের সচেতন মানুষ জানার পর প্রতিবাদ করলে মেয়ের পরিবার থেকে বলা হয়, স্কুলে বা বাড়িতে বখাটে যুবকরা মেয়েটিকে যন্ত্রণা দেয়। যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে মেয়েকে দ্রুত পাত্রস্থ করতে হচ্ছে। কোনো কোনো পরিবার থেকে বলা হয়, গরিবের সংসারে মেয়েটি অনেকটা বোঝা। তাই ভালো বা পয়সাওয়ালা অথবা প্রবাসী পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এমন অনেক অজুহাত থাকে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে। এ অবস্থায় কখনো কোন সচেতন মানুষ বা প্রশাসনের কেউ যদি খবর পেয়ে বিয়ের মজলিসে উপস্থিত হন তবে তাকে সদ্য কিনে নিয়ে আসা নতুন জন্মসনদটা দেখানো হয়। বিয়ে মজলিসে কেউ উপস্থিত হলে মানবতার দোহাইও দেয়া হয়। বলা হয়, ‘আজ বিয়ে ভেঙ্গে গেলে এ মেয়েকে নিয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না।’ সমাজে বর্তমানে এভাবেই চলছে বাল্যবিবাহ।
গ্রামাঞ্চলের অনেক অভিভাবক ভাবেন তার পরিবারের মানসম্মানের কথা, ভাবেন তিনি সমাজের অতি দরিদ্র একজন মানুষ। যেদিন তার কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলো সেদিন থেকেই যেন পরিবারের কর্তার মাথায় একটা পাহাড়সম বোঝা চেপে বসলো। সেদিন থেকেই চিন্তায়-চিন্তায় তার জীবন যেন অন্ধকারময়! মেয়েটা একটু একটু বড় হবার পর অভিভাকের চিন্তার মাত্রাটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কোনো মতে ১১/১২ বছর হলেই পরিবারের কর্তার দিনরাত দৌড় শুরু হয়ে যায় ঘটকের পিছনে। যেন কোনমতে বিয়েটা দিতে পারলেই তিনি দম ফেলে বাঁচেন।
আসলেই কি তাই? মেয়েকে অপরিণত বয়সে বিয়ে দিয়ে পরিবারের কর্তা কি বাঁচলেন? অনেক ক্ষেত্রে এমন ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। পরিবারের কর্তা নিজ হাতে তার কন্যার একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করলেন। তিনি নিজেও ডুব দিলেন অমানিষার কালো অন্ধকারে। অপরিণত বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেবার পর অধিকাংশ সময়ই প্রথম যে জিনিসটি সামনে আসে তা হলো-বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েটি এসে আর স্বামীর বাড়ি ফিরতে চায় না-এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। যখন তাঁর পুতুল খেলার বয়স তখনই যদি থাকে সংসার নামক শৃঙ্খলে বন্দি করা হয় তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি হয়ে থাকে। যখন অভিভাবকরা কোন মতেই বুঝিয়ে-সুজিয়েও মেয়েকে আর স্বামীর বাড়ি পাঠাতে পারেন না তখন সমাজপতিরা এ নিয়ে বিচার-শালিসে বসেন। অথবা মামলা, থানা, আদালত করে সময় কাটাতে হয় অভিভাবকদের। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই তালাকের মাধ্যমে বিয়ের কবর রচিত হয়। আজকাল আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।
অল্প বয়সে বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যু প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর মূল কারণ কিশোরী বয়সীদের মা হওয়া। কিশোরী মায়ের মৃত্যুঝুঁকি প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চারগুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়ে মা হওয়ায় কিভাবে শিশুকে পরিচর্যা করবে সে সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকে না। এর ফলে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুও ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মা ও শিশুর মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।