Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

একুশের ইতিহাস : একটি পূর্বাপর পর্যালোচনা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৩২ এএম

প্রতি বছরই একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় শহীদ দিবস হিসাবে। এদিনে আমরা স্মরণ করি বাংলা ভাষার সংগ্রামের অমর শহীদদের। এ দিনে শহীদদের স্মৃতিফলকে মাল্য দান করা হয়। চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, স্মরণসভা ইত্যাদি। বিভিন্ন স্থানে পৃথক সভার মাধ্যমে চলে ভাষা সংগ্রামের শহীদদের বীরগাথা নিয়ে আলোচনা। রাজধানী ঢাকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ দিবস উদযাপিত হলেও দেশের সর্বত্র দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। পত্র-পত্রিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেশের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে পালিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে অনেকেই আলোচনা করেন। বাংলা ভাষার সংকট, সমস্যা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন আলোচনা হয়, তেমনি সংগ্রামের ইতিহাস নিয়েও কথা হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে, বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা কেবলমাত্র বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনের গন্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। অথচ একুশের আন্দোলন বাংলাদেশের বাইরে বলতে গেলে গোটা বিশ্বেই প্রচারিত।

বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ছোট্ট হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার কারণে বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে বাংলা ভাষার স্থান অনেক উচুঁতে, যা স^ীকার করতেই হয়। এটা গোটা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে গৌরবের ব্যাপার। বিশেষ করে, জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষাকে যথোচিত সম্মান প্রদান করায় এ ভাষা দেশের মান ও পরিচিতি যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছে।

বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার জন্যে আমরা গর্বিত। হয়ত বা আরও গর্বিত হওয়া সম্ভব ছিল, যদি বাংলা ভাষা সাবেক বৃটিশ ভারতের সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হতো। আমাদের পূর্ব প্রজন্মের বাংলাভাষী মনীষিরা এ ব্যাপারে তৎপর থাকলেও সঙ্কীর্ণমনা রাজনীতির ডামাঢোলে তা চাপা পড়ে যায়। কংগ্রেস মহল হিন্দির পক্ষে আর প্রভাবশালী কিছু মুসলমান উর্দুর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। এ দু’মতবাদের বিপক্ষে বাংলাভাষী অঞ্চল হতে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার জন্যেও দাবি তোলা হয়। এ নিয়ে বহু বৈঠক হয়। বিভিন্ন বৈঠকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রফুল্ল কুমার সরকার প্রমুখ ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে দেশ ভাগের প্রাক্কালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উর্দুভাষী ড. গিয়াস উদ্দিন আহমদ এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কংগ্রেস স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দিকে গ্রহণ করার পর স্বাভাবিকভাবেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। গিয়াস উদ্দিন সাহেবের বক্তব্যকে খন্ডন করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার স^পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। নিবন্ধটি আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই তারিখে।

‘পূর্ব-পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক নিবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, উর্দু নিয়ে এ ধস্তাধস্তি না করে আমরা যদি সোজাসুজি বাংলাকেই পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তাহলে পূর্বপাকিস্তান প্রবর্তনের সাথে সাথে আমরা বাংলার শিক্ষিত স¤প্রদায় নিজেরাই পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পায়ণে হাত দিতে পারব। এ লেখাটি প্রকাশিত হয় মোহাম্মদীতে ১৯৪৩ সালে।

১৯৪৪ সালে ‘পাকিস্তান- রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শিরোনামের নিবন্ধে কবি ফররুখ আহমদ লিখেন, পাকিস্তানের অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে একথা সর্ববাদী সম্মত হলেও আমাদের এ পূর্ব পাকিস্তানেরই ক’জন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অবার্চীনের মত প্রকাশ করেছেন, যা নিতান্তই লজ্জাজনক। অবশ্য শেষ পর্যন্ততা টিকেনি।

দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের উদ্যোগে ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠে। মোহাম্মদ তোয়াহার ভাষায়, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রমহলে প্রথম চিন্তার সূত্রপাত করে এ সংগঠন। এরাই প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তোলে এবং ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেন। প্রথম দিকে ছাত্র ছাত্রীদের বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে বেশ অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেয়াওত খাঁ ছিলেন অবাঙ্গালী। তিনি অবশ্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থক এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যও ছিলেন। অধ্যাপক খাঁর ভাষায়, পূর্বপাকিস্তানের জনগণ সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। কাজেই বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ন্যায্য, স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত।

১৯৪৮ সালে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে করাচীতে গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে ভাষা প্রশ্নে পূর্বপাকিস্তানের বেশিরভাগ সদস্যই সরকারি প্রস্তাবের উপর সংশোধনী বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, রাষ্ট্রভাষা সে ভাষাই হওয়া উচিত, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করেন। যদি ২৯ নং বিধিতে ইংরেজি ভাষা সম্মানজনক স্থান পেতে পারে, পরিষদের কার্যাবলী উর্দু এবং ইংরেজির মাধ্যমে চলতে পারে, তাহলে বাংলা, যা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের ভাষা, কেন সম্মানজনক স্থান পাবে না? কাজেই এ ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বিবেচনা করা হোক। প্রস্তাবটি সরকারী বেশিরভাগ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে অগ্রাহ্য হয়।

এদিকে গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার পর ঢাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আন্দোলন গড়ে তোলার। তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে সংগ্রামে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন জানান। গড়ে উঠে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও বাংলাভাষা প্রচার তহবিল। সংগ্রামের প্রয়োজনে পরিষদের কলেবর বৃদ্ধি করে ১৯৪৮ এর ৭ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট এবং ১১ মার্চ দেশের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ ১৯৪৮ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিচারপতি আব্দুর রহমানের ভাষায় ১১ মার্চের আন্দোলন না হলে ৫২-এর আন্দোলন হতো না। ৪৮ এর ১১ মার্চ রাষ্ট্র ভাষার দাবি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে তা পূর্ণতা পায়। ভাষা সৈনিকদের মতে, ৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম সংগঠিত গণবিক্ষোভ। সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ, মিছিল ছাত্র-ছাত্রীদের পিকেটিং এবং পুলিশের লাঠি চার্জের ফলে ঢাকা শহর বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয়। গ্রেপ্তার ও পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ১২, ১৩ ও ১৪ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।

পরিস্থিতি বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আলোচনার টেবিলে সাত দফা দাবি সম্বলিত চুক্তি পত্রের খসড়া পেশ করে। আলোচনায় আরো একটি নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইত্তেহাদ তার সম্পাদকীয়তে লিখে, ‘বিরাট শক্তি আর দুর্জয় বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রাম করে বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা যে সাফল্য লাভ করেছে তা ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে।’ কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। তিনি ১৯ মার্চ বিকালে ঢাকায় আগমন করেন। ২১ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে এক সংবর্ধনা সভায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’ ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়েও তিনি বলেন, ‘এটা আমার বিশ্বাস যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত।’ বছর চারেক পর ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় খাজা নাজিমউদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণা ছিল প্রকৃত পক্ষে পূর্বোক্ত চুক্তির খেলাপ।

১১ মার্চের চুক্তিকে স্মরণ করে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপিত হতো। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপন কমিটির নেতৃত্বে নাজিমউদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে দিনই বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার প্রয়োজনে ৪০ জনেরও অধিক কর্মকর্তা নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়।

সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। বিকালে এক জনসভায় লীগ সরকারের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নিন্দা ও বাংলাভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালনের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত ও গৃহীত হয়।

এদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে এক মাসের জন্য ঢাকার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। একুশের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে ১৪৪ ধারা বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। কর্ম পরিষদ জরুরি আলোচনায় বসে। আলোচনা সভায় আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের প্রশ্নে দেখা দেয় বিতর্ক। অবশেষে সভায় ১১-৪ ভোটে গণতান্ত্রিক উপায়ে ১৪৪ ধারা না ভেঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অপরদিকে ফজলুল হক ও সলিমুল্লাহ হলে ছাত্রদের অপর দু’টি সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় জড়ো হয়। বেলা সাড়ে ১২টার সময় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আবেদন জানিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালানোর আহবান জানান। এদিকে আহবায়ক আব্দুল মতিন আন্দোলনের পেক্ষাপটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ছেড়ে দেন। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদের চেতনায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তে অটল থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে অব্যাহতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রতিবাদী মিছিল বের হতে থাকে। প্রতিবাদী মিছিলের গতি রোধ করতে চলে পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস, লাঠিচালনা আর গুলিবর্ষণ। ফলে শহীদ হন রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো ক’জন। বাঙ্গালীর রক্তের বিনিময়ে রচিত হয় ভাষা আন্দোলনের অন্য এক নতুন অধ্যায়। প্রকৃতপক্ষে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার ছিল ২১, ২২, ২৩ এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি অবধি। পরে পুলিশি নিষ্পেষনে তা স্তিমিত হয়ে আসে। শুধু ঢাকা শহরেই এ জোয়ার ছিল না, ছিল তৎকালীন গোটা পূর্ব পাকিস্তানে।

১১ মার্চ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন তৎকালীন সরকারকে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। অথচ রক্ত দিয়েও বায়ান্নতে টলানো যায়নি। ১১ মার্চের আন্দোলনের চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে মূল চুক্তি লঙ্ঘনের প্রশ্নই আসত না। ১১ মার্চের আন্দোলনের পর ১৫ মার্চ যে ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে চুক্তির রূপকার ছিলেন কমর উদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৭৯ সালের জুন মাসে এক সাক্ষাৎকারে দুঃখ করে বলেন, আজও ভাববার বিষয় ভাষার দাবি কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে!

অনেকের মতে, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি। একুশের পর বাইশে ফেব্রুয়ারি অধিক গুলি বর্ষিত হয় এবং সে দিনই বেশি লোক গুলিতে মারা যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মী এবং সে সময় মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের জনৈক ছাত্রের প্রকৃত অভিজ্ঞতায় ২১ ফেব্রুয়ারি মূলতঃ ছিল ছাত্র আন্দোলন আর ২২ ফেব্রুয়ারি তা দুর্বার গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদার স্বীকৃতি পায় ১৯৫৫ সালের আন্দোলনের পর। বায়ান্নর পর থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা দিবস’ উদযাপন করার মধ্য দিয়েই ভাষা আন্দোলন গণমানসে উদ্দীপিত ছিল। ৫৩-৫৪ সালে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না হলেও ১৯৫৫ সালে আন্দোলন ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করে। ৫৪ সালের নির্বাচনের পর ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিছুদিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বপাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারী করে। গভর্নর হয়ে আসেন ইস্কান্দার মির্জা। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচির মধ্যে ছিল শহীদ মিনার ও মাজারে ফাতেহা পাঠ, আমতলায় ছাত্রসভা ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা চলে, গ্রেপ্তার করা হয় দলে দলে ছাত্রদের। গ্রেপ্তারের আওতা থেকে ছাত্রীরাও রেহাই পায়নি। এ বছরই ব্যাপক সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী গ্রেপ্তার বরণ করে। ৫৫ সালের পরই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: একটি পূর্বাপর পর্যালোচনা
আরও পড়ুন