Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নোভেল করোনাভাইরাস : জীবাণু অস্ত্র অথবা প্রকৃতির প্রতিশোধ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তবে এতটা প্রবল নয়, পশ্চিমা গণমাধ্যমে তাকে যতটা ভয়ঙ্করভাবে প্রচার করা হচ্ছে। গত ডিসেম্বরের শেষদিক থেকে শুরু হওয়া এনসিওভি বা নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এ সপ্তাহ পর্যন্ত এ লাখ অতিক্রম করেনি। চীন সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে দেড়শ কোটি মানুষের দেশের ব্যস্ততম শহরে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১৭শ’র বেশি। ইতোমধ্যে ২৫টির বেশি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও চীনের সংখ্যার তুলনায় তা খুবই কম এবং গত সোমবার পর্যন্ত চীনের বাইরে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা তিন বা চারজন বলে জানা গেছে। করোনাভাইরাস নিয়ে চীনের সতর্ককতা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের স্থবিরতা প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যায়, নোভেল করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিশেধক বা সুপরীক্ষিত চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকলেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার চেয়ে এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি গভীর ও সুদূর প্রসারী। চীনের এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে চীনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা কৌশলগত অংশীদার রাশিয়াসহ কেউই লাভবান নয়। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফ্যাক্চারিং খাত কাঁচামালের জন্য চীনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় চীনে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরানের আতঙ্ক এবং বড় বড় শহরগুলোর লক-ডাউন অবস্থা বিশ্বঅর্থনীতির জন্য অনেক বড় ধাক্কা। ইতিপূর্বে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে প্রথম এ ধরনের সমস্যার সন্মুখীন হয় চীন। ব্যাপক ভীতি ছড়িয়ে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল চীনা সরকার। প্রায় দুই মাস ধরে চলা করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি ও ভীতি ইতোমধ্যে চীনের জনজীবন ও অর্থনীতিকে যেমন অথর্ব করে তুলেছে, সেই সাথে চীনের উপর পারস্পরিক নির্ভরশীল দেশগুলোও বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যাপকভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল। পদ্মাসেতুসহ দেশের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চীনা বিনিয়োগ, প্রকৌশল ও কর্মীর উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এসব উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। পর্যটন ছাড়াও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, ভোগ্যপণ্য ও গার্মেন্ট পণ্যের কাঁচামাল আনতে প্রতিমাসে হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিক চীন ভ্রমণ করে থাকে। উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর সেখান থেকে ফেরত আসা কয়েকশ’ বাংলাদেশিকে দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে রাখার পর তাদের কারো মধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন, নিবিড় পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে তাদের কেউ কেউ কাজে ফিরে গেছেন। তবে চীনের করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ইতোমধ্যে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে এ সপ্তাহে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়।

চীনের করোনাভাইরাস চীনসহ বিশ্বের জন্য এক চরম পরীক্ষা ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং পরাশক্তিসমূহ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করে চলেছে। একেকটি পরাশক্তি দেশের হাতে যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে তা দিয়ে পুরো মানবসভ্যতাকে ১০ বার ধ্বংস করে দেয়া গেলেও একটি সামান্য ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে, সামদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, জঙ্গলের দাবানল বা ভূমিকম্প-সুনামির কাছে পুরো বিশ্ব সভ্যতাকে অসহায়ভাবে আত্মসমপর্ণ করতে হচ্ছে। গত কয়েক মাসে অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরের সন্নিকটে বনাঞ্চলের দাবানলে হাজার হাজার বন্য প্রাণী, গাছপালা ও ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য অসহায় দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি রাষ্ট্রশক্তিগুলো। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে এবং সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরাশক্তিগুলো কী না করছে! ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া থেকে কাশ্মির, রাখাইনের রোহিঙ্গা বা উইঘুর পর্যন্ত মানবতার যে অপমান-অবদমন, গণহত্যা ও বাস্তচ্যুতির যে অব্যাহত যাত্রা চলছে তার পেছনে রয়েছে পরাশক্তিগুলোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও নীলনকশা। আর এসব রাষ্ট্রশক্তি যখন প্রকৃতির প্রতিশোধের মুখে অসহায় হয়ে পড়ে, হাজার হাজার মানুষের ভাগ্যে চরম বিপর্যয় নেমে আসে তখন ভুক্তভোগী ভাগ্য বিড়ম্বিত অনেক মানুষের মনে এই বোধ জাগ্রত হয় যে, জুলুমকারীরা হয়তো সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে তাদের আর্তি ও আহাজারিতে এখন বিচারের সন্মুখীন। অস্ট্রেলিয়া- ক্যালিফোর্নিয়ার বুশফায়ার এবং চীনের করোনাভাইরাসের পর দেখা গেল তাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য, প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্রের দম্ভ এবং শতকোটি মানুষকে ভেড়ার পালের মতো নিয়ন্ত্রণের সব কলাকৌশল কোনো কাজে আসছে না। বিশ্বাসী মানুষ একে স্রস্টার গজব বা প্রকৃতির প্রতিশোধ বলেই মনে করছে। গত কয়েকশ’ বছর ধরে মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে ভোগবাদ ও পুঁজিবাদে আসক্ত হয়ে পড়ার সাথে সাথে ভোগ ও জ্বালানির অমিত ব্যবহার সব বিচার-বিবেচনা অতিক্রম করে চলেছে। ফসিল জ্বালানির অমিত ব্যবহারের কারণে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতাবৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানব সভ্যতা এক নতুন বিপর্যয়ের সন্মুখীন হওয়ার চলমান বাস্তবতায় পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে ইতিহাসের নানা বাঁকে এমন অনেক মহামারির ঘটনা দেখা যায় যার একটি সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা রয়েছে। গত চারশ’ বছর ধরে ঠিক ১০০ বছর পর পর বিশ্বে সভ্যতার ভরকেন্দ্রগুলোতে মহামারি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সন্মুখীন হতে দেখা গেছে। মহামারির ইতিহাস আরো অনেক পুরনো হলেও গত চার শতকের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৬২০ সাল থেকে এক শতাব্দী পর পর মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানোর মতো মহামারির তান্ডব দেখা দিয়েছে। ১৭২০ ফরাসি গ্রেট প্লেগে ইউরোপে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৮২০ সালে কলেরায় এশিয়া ও ইউরোপে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, ১৯১৮-২০ সালে স্পেনিশ ফ্লু সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর ১০ কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু। চলতি বছর চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস তার সর্বশেষ উদাহরণ। শত বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা বহুগুণ বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ভোগবাদী প্রবণতা, পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে শোষণ-নিপীড়ন, বৈষম্য ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডও অনেক বেড়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের করোনাভাইরাসে বিশ্বের ৬০ শতাংশ বা চারশ’ কোটি মানুষ আক্রান্ত হতে পারে বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এমন এক সময়ে চীনের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটল, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সূচিত বাণিজ্যযুদ্ধের প্রথম রাউন্ডেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছুটান দিয়ে একটি অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সমঝোতায় পৌঁছতে বাধ্য হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় চীনের প্রভাব এতটাই প্রবল যে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক বিশ্ব চীনা পণ্য ও কাঁচামালের বিকল্প বাজার এখনো গড়ে উঠেনি। অন্যদিকে, গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শুরু হওয়া প্রথম মহাযুদ্ধের জয়পরাজয়ের ফলাফল যখন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত নতুন বিশ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করে দিল তখন তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বের উপর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মহাযুদ্ধের সময় সাইক-পাইকটের চুক্তিতে উসমানীয় খেলাফতের অধীন মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাভাগিতে রাশিয়া, ইতালিসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পশ্চিমা সব ঔপনিবেশিক শক্তির অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর রাশিয়া চুক্তি থেকে বিচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে এক নতুন বাস্তবতার সন্মুখীন হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় রাশিয়াকে আবারো মিত্রশক্তিতে পরিণত করলেও যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে পারমাণবিক প্রতিযোগিতা ও ঠান্ডা লড়াই অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির বিরুদ্ধে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতাপ এক ধরনের ভারসাম্য তৈরি করেছিল। তবে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জায়নবাদী ইহুদিদের নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে উঠে। নতুন নতুন সব সমরাস্ত্রের পেছনে মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বকে নিরাপদ করতে না পারার পেছনে রয়েছে অস্ত্রের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জুজু খাড়া রাখা। একশ’ বছর পেরিয়ে এসে বিশ্বে পরিবর্তন যখন অনিবার্য, বিশেষতঃ ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পদ লুণ্ঠনের ধারাবাহিক প্রয়াস যখন হাতছাড়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, তখন ডিল অব দি সেঞ্চুরি নাম দিয়ে নতুন নীল নকশা বাস্তবায়নের পথে ইরান ও চীন-রাশিয়ার নতুন রাজনৈতিক ও সামরিক মেরুকরণ অনেক বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি নিয়ে এক ধরনের লকোচুরি খেলার পর চীনে করোনাভাইরাস আউটব্রেক হওয়ার সময়টিতে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার সময় হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। তবে ইরানের সাথে আঞ্চলিক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ার বাস্তবতায় চীনের দুর্দিনেও জায়নবাদ প্রভাবিত মার্কিনীরা একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, নিজেদের ইজ্জত রক্ষা করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে চীনের করোনাভাইরাস নিয়ে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এক প্রকার বেøইম গেম উস্কে দেয়ার আশঙ্কা করেছেন রাশিয়ান বংশোদ্ভূত একজন মার্কিন গবেষক। সম্প্রতি প্রকাশিত দিমিত্রি অরলভের নিবন্ধে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কাসহ সামগ্রিক বাস্তবতার একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন তিনি। প্রথমতঃ বায়োলজিক্যাল উইয়েপনস অব মাস ডেসট্রাকশন হিসেবে করোনাভাইরাস যথার্থ নয় বলে মত দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের মর্টালিটি বা প্রাণঘাতের হার শতকরা ২.১ ভাগের বেশি নয়। অন্যদিকে চীনে করোনাভাইরাসে মৃতদের গড় বয়েস ৬৫ বছর। অপেক্ষাকৃত তরুণরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও কোনো রকম উপসর্গ বা লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে না বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। অর্থাৎ এ ধরনের ভাইরাস চূড়ান্ত বিচারে চীনের উৎপাদনশীল শক্তি বা সামরিক বাহিনীকে তেমন কাবু করতে সক্ষম নয়। পক্ষান্তরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ নেতারা এর টার্গেটে পরিণত হতে পারে। যখন বাণিজ্য যুদ্ধে চীনের কাছে হেরে যাচ্ছে, এমনকি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের মিসাইল হামলারও যথোপযুক্ত জবাব দিতে পারছে না, তখন চীনকে ডিস্ট্যাবিলাইজ বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেয়া এবং চীনাদের মধ্যে ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসির বীজ বপণ করা মার্কিন স্টাইলের রিজিম চেঞ্জ’র সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এ ধরনের জীবাণু অস্ত্রই একমাত্র বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

পেন্টাগন সারাবিশ্বে শত শত স্থানে সামরিক ঘাঁটিসহ জীবাণু অস্ত্রের গবেষণাগার তৈরি করেছে, যেখানে নানা রকম প্যাথোজেন এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠির ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগে কয়েকজন মার্কিন চরের রাশিয়ান নাগরিকদের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে দেশের বাইরে পাচার চেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন দিমিত্রি অরলভ। কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠির ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে ডিএনএ জেনিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এমন জীবাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব যা শুধুমাত্র ওই বিশেষ জনগোষ্ঠির উপর কার্যকর হতে পারে। এ কারণে জনগোষ্ঠির ডিএনএ স্যাম্পল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ‘ডেস্ট্রয়িং লিবিয়া এন্ড ওয়ার্ল্ড অর্ডার’সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক, মার্কিন গবেষক, আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মী ইউনিভার্সিটি অব ইলিয়নয়স’র আন্তর্জাতিক আইনের প্রফেসর ড. ফ্রান্সিস বয়েল জিওপলিটিক্স এন্ড অ্যাম্পায়ার ব্লগের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নাইন-ইলেভেনের পর জীবাণু অস্ত্রের গবেষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে। এছাড়া রাশিয়া, চীন, ইসরাইল, ইউকে এবং ফ্রান্সের নিজস্ব জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচি রয়েছে। রাশিয়া এনথ্রাক্সকে জীবাণু অস্ত্র হিসেবে সৃষ্টি করেছে বলে তিনি মনে করেন। অন্যদিকে আফ্রিকায় ভয়াবহ মারণঘাতি ইবোলা ভাইরাস নিয়ে সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণার নামে কর্মতৎপরতাকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করেন বয়েল। তাঁর মতে, বিএসএল-৪ গবেষণাগার নামে পরিচিত যে সব ল্যাবরেটরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলো চালু রেখেছে তার সবই জীবাণু যুদ্ধের মহড়া ছাড়া আর কিছুই না। এ বিষয়ে ড. ফ্রান্সিস বয়েল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্জ করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৮৯ সালে তিনি ‘বয়োলজিক্যাল উইয়েপন এন্ড এন্টি-টেররিজম অ্যাক্ট’ নামে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিলের খসড়া প্রণয়ন করেন যা সিনেটে ও হাউজে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বুশ স্বাক্ষর করেছিলেন। জীবাণু যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রীয় বা অন্যকোন সংস্থার কার্যক্রমকে তিনি ডেথ সায়েন্স ওয়ার্ক নামে অভিহিত করেন। এ খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে বলে ড. ফ্রান্সিস বয়েল দাবি করেন। ২০০৩ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাসকেও জীবাণু অস্ত্র বলে অনেকে মনে করেন। তবে এবারের করোনাভাইরাস সার্স ভাইরাসের গবেষণা থেকেই উদ্ভূত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ড. বয়েলের মতে, উহানের করোনাভাইরাসটি কানাডার একটি ল্যাবরেটরি থেকে চুরি করা ভাইরাসকে চীন হয়তো জীবাণু অস্ত্রে পরিণত করতে চেয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে বিএসএল-৪ ল্যাবরেটরিগুলো মূলত জীবাণু অস্ত্র নিয়ে কাজ করলেও এসব ল্যাবরেটরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনও পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পক্ষে কাজ করা এবং তাদের কাছ থেকে ফান্ড গ্রহণের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন অনেকে। কানাডার যে গবেষণাগার থেকে চীনা এজেন্টদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস চুরি করে উহান ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে কথিত হচ্ছে, সে বিষয়ে অন্যতম সাক্ষী ও তদন্তকারী হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্ক প্লামার সম্প্রতি কেনিয়ার নাইরোবিতে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে অ্যাসাসিনেশনের শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়। উহানের করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যে সব অভিযোগ ও কাহিনীর ডালপালা বিস্তার করছে তার কতটা বাস্তব আর কতটা ব্লেইম গেম ও কনস্পিরেসি তার সত্যাসত্য নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন কাজ। গ্রেট গেইম ইন্ডিয়া নামের একটি অনলাইন জার্নালে এ বিষযে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। তবে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফে এক ধরনের তথ্যযুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে উহানে ছড়ানো করোনাভাইরাস আমাদের নাগরিক সমাজের গোপনীয় তথ্য ও সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য অনেক বড় সতর্ক সঙ্কেত।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নোভেল করোনাভাইরাস
আরও পড়ুন