দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
বয়ান ও বাগ্মিতা
আল্লাহ তাকে যেমন মেধা ও জ্ঞান দিয়েছেন, তেমনি সেই জ্ঞান বিতরণের জন্য চিত্তাকর্ষক বয়ানের যোগ্যতাও দান করেছেন। তার বয়ান ও ওয়াজ শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ চলে আসতো। তার কোরআন তেলাওয়াত এত সুন্দর ও মুগ্ধকর ছিলো, যা খুব সহজেই যে কাউকে আকৃষ্ট করতো। বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনি নয়, সরাসরি কোরআন-হাদিসের আলোকে ওয়াজ করতেন। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো এতটা দরদমাখা ভাষা ও যুক্তিসহ পেশ করতেন, মানুষ সহজেই অভিভূত হয়ে যেতো। তার ওয়াজকে সাধারণ মানুষের জন্য ‘দরসুল হাদিস’ (হাদিসের পাঠ) ও ‘দরসুল কোরআন’ (কোরআনের পাঠ) হিসেবে গণ্য করা হতো। কারণ তার পুরো ওয়াজেই হয়তো কোরআনের তাফসির থাকতো, না হয় হাদিসের শরাহ বা ব্যাখ্যা। তার প্রায় ওয়াজের মধ্যেই একটি মৌলিক বিষয় হলো, সমাজে প্রচলিত বেদাত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দৃঢ় যুক্তি ও দলিলের আলোকে আলোচনা করতেন। সরাসরি আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরতেন। সুরা ইউসুফকে যে কোরআনে কারিমে ‘আহসানুল কাসাস’ বলা হয়েছে, তা তার বয়ান শুনে উপলব্ধ হতো। তাফসিরের ফাঁকে-ফাঁকে তিনি শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও সুন্দর করে তুলে ধরতেন। মহান আল্লাহ তাকে দরসে কোরআন ও দরসে হাদিসের বিশেষ যোগ্যতা দান করেছেন।
আধ্যাত্মিক সাধনা
তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন মনীষীদের সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী হন। সর্বপ্রথম মুফতিয়ে আজম শায়খ ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর কাছে বাইআত হন। মুফতি সাহেব (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বৃহত্তর রেঙ্গা এলাকার প্রখ্যাত বুজুর্গ আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা (রহ.)-এর কাছে বাইআত হন। তিনি শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর ছাত্র ও খলিফা ছিলেন। দীর্ঘদিন রিয়াজত ও মোজাহাদা করেন। এরপর এক সময় শায়খে রেঙ্গা (রহ.) তাকে বাইআতের অনুমতি ও খেলাফত দান করেন। অধ্যাপনা ও অধ্যয়নের পর তার সময় কাটতো ইবাদত-বন্দেগির মধ্যদিয়ে। বিশেষত রমজান মাসে তার রাতজাগা ও ইবাদত বহুগুণে বৃদ্ধি পেতো। রমজান মাসে দীর্ঘদিন যাবত তাহাজ্জুদের সময় নিজে কয়েক খতম কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করতেন। শায়খুল ইসলাম হজরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর মতানুসারে তাহাজ্জুদের জামাত করতেন। প্রতি রমজানে শেষ দশকের ইতেকাফ নিয়মিত করতেন। তার সঙ্গে রমজানের ইতেকাফে কাটাতে এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষ ও দূর-দূরান্ত থেকে আলেম-উলামারা ছুটে আসতেন। কোনো কোনো বছর পুরো রমজান মাসই ইতেকাফে কাটাতেন।
রাজনৈতিক জীবন
তিনি জীবনের শুরু থেকেই ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ‘নায়েবে রঈস’ (সিনিয়র সহসভাপতি) ছিলেন। ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত। হবিগঞ্জ ও দেশে ইসলামবিরোধী কিছু হলে তিনি জমিয়তের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করতেন। মিছিল, মিটিং করতেন। রাজপথে জনগণের সঙ্গে নেমে একাত্মতা ঘোষণা করতেন।
ইন্তেকাল
দেশের বিশিষ্ট এ হাদিস বিশারদ ও রাজনীতিবিদ দীর্ঘদিন যাবত শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। কিছুদিন আগেও বেশ কিছুদিন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে হার্টের এনজিওগ্রাম করা হয়। ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই অসুস্থ হয়ে লন্ডনের ইউলিয়াম হার্ভে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেও তার হার্টের এনজিওগ্রাম করা হয়। শেষমেষ ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি (রোববার) তার অবস্থার অবনতি হলে বিকেলে হবিগঞ্জ থেকে সিলেট শহরের হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছিলো তাকে। পথিমধ্যে শেরপুরে বিকেল পৌণে ৫টার দিকে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলায়হি রাজিউন)। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এ মনীষীর জানাজা ২০২০ খৃস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি (সোমবার) সকাল ১০টায় হবিগঞ্জ জামিয়া আরাবিয়া উমেদনগরে অনুষ্ঠিত হয়। ইন্তেকালের সময় তার বয়স হয়েছিলো ৮২ বছর। তার ইন্তেকালে সারাদেশের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার ইন্তেকালে জাতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হবার নয়। আমরা এক মূল্যবান রাহবার ও ছায়াস্থলকে হারালাম। দেশ-জাতি ও উম্মাহর যেকোনো দুর্দিনে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনা ছিলো আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।